যেমন চলছে বাংলাদেশের মডেল মসজিদ
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করছে সরকার৷ গত বছরের ১০ জুন উদ্বোধন করা হয়েছে ৫০টি মসজিদ৷
উদ্দেশ্য
ইসলামের ভ্রাতৃত্ব, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধসহ সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালে সারাদেশে মডেল মসজিদ তৈরির এই প্রকল্প নেয় সরকার৷ পদ্মা সেতুর পর এটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রকল্প৷
বিশ্বে প্রথম
প্রকল্পের পরিচালক নজিবর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে পরিচালিত এ মসজিদগুলো বিশুদ্ধ ইসলাম চর্চা ও প্রচারের পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত হবে৷ বিশ্বের আর কোনো মুসলিম শাসকের একসাথে এতগুলো মসজিদ নির্মাণের নজির নেই৷’’
সরকারি বেতন
৫৬০টি মডেল মসজিদ পরিচালনার জন্য প্রায় সাত হাজার জনবল নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে৷ এ প্রসঙ্গে শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, ‘‘মডেল মসজিদে নিযুক্তরা সরকারি বেতন পাবেন৷ দেশের বিভিন্ন মসজিদের অনেক আয় হলেও ইমাম-মুয়াজ্জিনদের তেমন বেশি নয়৷ আবার অনেক মসজিদের আর্থিক অবস্থা খারাপ৷ মসজিদে নিযুক্তরা সরকারি বেতন পেলে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হতে পারে৷’’
যেসব সুবিধা থাকছে
নারী-পুরুষের আলাদা নামাজ-ওজুর ব্যবস্থা, প্রতিবন্ধীদের আলাদা নামাজের সুবিধা, ইসলামিক বই বিক্রয়কেন্দ্র, ইমাম ট্রেনিং সেন্টার, হেফজখানা, দেশি-বিদেশি মেহমানদের আবাসন, মরদেহ গোসল, হজ্ব যাত্রীদের ডিজিটাল নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ভৌত সুবিধাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মডেল মসজিদগুলোতে৷
অবকাঠামো
অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী, ৪০ শতাংশ জায়গার উপর জেলা পর্যায়ে চারতলা, উপজেলা পর্যায়ে তিনতলা এবং উপকূলীয় এলাকায় চারতলা মডেল মসজিদ নির্মাণ কাজ বাস্তবায়িত হচ্ছে৷ উপকূলীয় এলাকার মসজিদগুলোকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে৷
সামাজিক দায়বদ্ধতা
সাভার উপজেলা মডেল মসজিদের ইমাম হাফেজ মোঃ মারুফ বিল্লাহ বলেন, ‘‘আমাদের নবিজীর যুগেও কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র ছিল মসজিদগুলো৷ শুধু মুসলমানদের কাছেই না, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী যারা আছেন, তাদের কাছেও ইসলামের যে মূল মর্মবাণী তথা ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য, সেটি পৌঁছে দেওয়াসহ আরও কর্মকাণ্ডে মসজিদগুলোকে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্যে সরকার এ মসজিদগুলো তৈরি করেছেন৷’’
তিন ক্যাটাগরির মসজিদ
সরকারি অর্থায়নে নির্মিত এ মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো এ, বি, সি এই তিন ক্যাটাগরিতে নির্মাণ করা হচ্ছে৷ ‘এ’ ক্যাটাগরিতে ৬৪টি জেলা শহর এবং সিটি কর্পোরেশনে মোট ৬৯টি, ‘বি’ ক্যাটাগরিতে উপজেলায় ৪৭৫টি ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে উপকূলীয় এলাকায় ১৬টি মসজিদ নির্মাণ করা হবে৷ জেলা শহরের প্রতিটি মসজিদে এক হাজার ২০০ এবং বাকিগুলোতে ৯০০ মুসল্লি নামাজের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷
‘ভালো উদ্যোগ’
সাভারের ব্যাংক কলোনির বাসিন্দা হাজী মোফাজ্জল হোসেন জানান, ‘‘আমি প্রায়ই এই নতুন মসজিদে নামাজ পড়ি৷ শুনেছি এখানে নামাজ ছাড়াও আরো অনেক রকমের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা রেখেছে সরকার, এটা অবশ্যই একটা ভালো উদ্যোগ৷ তবে যেহেতু উঁচুতে, বয়স্কদের জন্য সিঁড়ি বেয়ে মসজিদে উঠাটা একটু কঠিন হয়ে গেছে৷ চলন্ত সিঁড়ি বা অন্য ব্যবস্থা রাখলে আরও ভালো হতো৷’’
শুধু নামাজ চালু হয়েছে
সাভার উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সেক্রেটারি মোঃ বদরুজ্জামান বলেন, ‘‘আমাদের এখানে আপাতত মহিলা-পুরুষদের নামাজের ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছু চালু হয়নি৷ অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হলেও কার্যক্রম শুরু করা যায়নি৷ এ ব্যাপারে উপরমহলের নির্দেশের অপেক্ষায় আছি আমরা৷’’ তিনি বলেন, ‘‘মসজিদে প্রবেশের বিশেষ র্যাম্প পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় প্রতিবন্ধীদের নামাজের সুবিধা আমরা এখন দিতে পারছি না৷’’
প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় শুধুই বাড়ে
প্রকল্পের শুরুতে সৌদি সরকারের অর্থায়নের কথা থাকলেও পরে তারা এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে৷ শুরুতে আট হাজার ৭২২ কোটি টাকা খরচের কথা থাকলেও পরবর্তীতে তা ১০ শতাংশ বেড়ে নয় হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা হয়েছে৷ তাছাড়া দুই বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা তিন দফা বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে৷
পর্যটনকেন্দ্র
ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলা মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে শুক্রবারের জুম্মার নামাজে উপচে পড়া ভিড়৷ স্থানীয়সহ এলাকার বাইরে থেকে যারা নামাজ পড়তে আসছেন, তারা সবাই ছবি তুলছেন৷ ধামরাই থেকে আসা জাফর আহমেদ বলেন, ‘‘এলাকার পাশেই এতো সুন্দর একটা মসজিদ হয়েছে, তাই এখানে নামাজ পড়তে এসেছি৷ শুধু আমি না, আমার মতো অনেকেই এখানে নামাজ পড়ার পাশাপাশি মসজিদও দেখতে আসে৷’’
‘ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে’
শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদ ইবাদতকেন্দ্রিক৷ ইসলামে মসজিদের যে মূল ধারণা, তা হলো, ইবাদতের পাশাপাশি মসজিদগুলো সামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হবে৷ এই ক্ষেত্রে মডেল মসজিদগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে৷’’