যেভাবে সমুদ্র টিকিয়ে রাখছে প্রাণের অস্তিত্ব
গোটা বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশই সমুদ্র৷ এই নীল জলরাশির কারণেই পৃথিবী প্রাণীর বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠেছে৷ তবে সমুদ্রের নিজের প্রাণভাণ্ডারই এখন অস্তিত্ব সংকটে, জলবায়ু পরিবর্তন আর মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে৷
নীল পৃথিবী
পৃথিবীর ৭১ ভাগই সমুদ্রের নীল জলরাশি বেষ্টিত৷ বাস্তুসংস্থানের নব্বই ভাগই বলতে গেলে সমুদ্রনির্ভর৷ সমুদ্র না থাকলে এই পৃথিবীতে প্রাণের অস্তত্বই তৈরি হতো না৷ কিন্তু কোথা থেকে এর সূচনা তা আজও বিজ্ঞানীদের কাছে এক রহস্য৷ ধারণা করা হয়, আজ থেকে ৪৪০ কোটি বছর আগে সমুদ্রের উদ্ভব হয়েছিল৷
অতল রহস্য
সমুদ্রের আকার যতটা বড়, হদিস মিলেছে তার সামান্য৷ বলতে গেলে এই জলরাশির গভীরতার ৮০ ভাগই এখনো অজানা, যার কোনো মানচিত্রও তৈরি করা যায়নি৷ তবে এই রহস্য ভেদ করতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা, যার মাধ্যমে জলবায়ু সংক্রান্ত অনেক তথ্য জানার পাশাপাশি তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপর্যয় ঠেকানোর উপায়ও হয়তো বের করা সম্ভব হবে৷
জলবায়ু নিয়ন্ত্রক
সৌর বিকীরণ শুষে নিয়ে পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করে সমুদ্র৷ নিয়ন্ত্রণ করে আবহাওয়াকেও৷ অক্সিজেন উৎপাদন আর কার্বন নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে সমুদ্র৷ কিন্তু এই ভারসাম্য এরই মধ্যে হুমকির মুখে পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে৷
প্রাণের বৈচিত্র্য
এখন পর্যন্ত সমুদ্রে ২৩ লাখ প্রাণের অস্তিত্ব জানা গেছে৷ প্রবাল থেকে শুরু করে সেই তালিকায় আছে বর্ণিল সব মাছ৷ আছে নানা তৃণ আর গুল্মও৷ গভীর সমুদ্র ঠাঁই দিয়েছে হাঙ্গর, তিমির মতো বিশাল প্রাণীদেরও৷
অবাক সৃষ্টি
বিজ্ঞানীদের ধারণা, এখনো মহাসমুদ্রের দুই-তৃতীয়াংশ প্রাণীরই তারা হদিস পাননি৷ তবে আশার কথা, প্রতি বছরই নতুন কোনো-না-কোনো জীবের সন্ধান পাচ্ছেন তাঁরা, যার কোনো কোনোটি এই পৃথিবীর চেনাজানা কোনো প্রাণের সাথেই মেলানো যাবে না৷ যেমন, ছবির এই প্রাণীটি৷ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের কেলিবস সাগরে ২০০৭ সালে এর সন্ধান মিলেছে৷ ধারণার বাইরে আরো কত অবাক প্রাণীই না জানি আছে!
সতর্ক সংকেত
যেই জলরাশি এই পৃথিবীর প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখেছে, তার নিজের ভারসাম্যই এখন চাপের মুখে৷ এর বড় উদাহরণ, গোটা বিশ্বে প্রবাল প্রাচীরগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে৷ প্রবালের উৎপত্তি মূলত কিছু বিশেষ শেওলা থেকে৷ কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধি আর মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কারণে তাদের জীবন প্রণালী এখন বাধাগ্রস্ত৷
বিপদে বাসিন্দারা
জলবায়ু পরিবর্তন সমুদ্রের অন্যান্য প্রাণকেও হুমকিতে ফেলছে৷ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমিতে থাকা প্রাণীদের চেয়েও দুইগুণ বেশি গতিতে হারিয়ে যাচ্ছে মাছ, শামুক আর কাঁকড়ার জনসংখ্যা৷ সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এর বড় কারণ৷ উদ্বেগের বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে পারছে না সমুদ্রের বেশিরভাগ প্রাণীই৷
গলছে বরফ
সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে শুধু সেখানকার বাসিন্দারা বিপদে পড়েছে তা-ই নয়৷ গলতে শুরু করেছে বিশাল সব বরফ খণ্ডও, যার কারণে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা৷ তলিয়ে যাচ্ছে ভূমি৷ বাড়ছে সমুদ্র থেকে বিকিরণ হওয়া বিষাক্ত গ্যাসও৷
শতকোটি জীবনের হুমকি
যেভাবেই দেখা হোক না কেন এই পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকাটা নির্ভরশীল সমুদ্রের উপরই৷ তার মধ্যে সরাসরি সমুদ্রের উপর নির্ভর বিশ্বের কয়েক মানব সম্প্রদায়, যারা উপকূলগুলোতে এলাকাগুলোতে বসবাস করে আসছে শত বা হাজার বছর ধরে৷ বর্তমানে বিশ্বে একশ’ কোটি মানুষের বসবাস উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর নিম্নভূমিতে৷ সমৃদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি মানুষের বাস্তুসংস্থান আর জীবনকে হূমকিতে ফেলছে৷
নাগাল না পাক মানুষ
মানুষের জীবন সমুদ্রনির্ভর, অন্যদিকে বিশাল এই প্রাণভাণ্ডারকে ধ্বংসের কারণও মানুষ৷ বলা হয়ে থাকে, মহাসাগরগুলোর মাত্র ১৩ ভাগ মানুষের কর্মকাণ্ডের বাইরে আছে৷ যত প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটছে, সমুদ্রে মানুষের অভিযাত্রাও ততই বাড়ছে৷ পদচারণা বাদ থাকছে না মেরু অঞ্চলেও৷ মানব সভ্যতার এই ‘অগ্রযাত্রার’ হাত থেকে এসব অঞ্চলকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ৷