1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যেখানে দুর্গাপূজা সার্থক করেন মুসলমানরা

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৬ অক্টোবর ২০১৮

ধর্মান্ধতার রাজনীতি যখন সারা দেশে মানুষে মানুষে প্রাচীর তোলার চেষ্টা করছে, তখন মৈত্রী অটুট রাখার যুদ্ধে অক্লান্ত বেলগাছিয়ার আমন কমিটি৷

https://p.dw.com/p/36390
ছবি: Privat

তিন দশক ধরে দুর্গাপুজোর চার-পাঁচটা দিন পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখেন সংখ্যালঘুরা৷

তিলোত্তমা কলকাতা দুর্গাপুজোয় জনঅরণ্যে ভেসে যায়৷ লক্ষাধিক মানুষের ঢল বা যান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কলকাতা পুলিশ ও পুজো কমিটিগুলো নানা উদ্যোগ নেয়৷ কিন্তু এসব তো হাল আমলের৷ তার অনেক আগে থেকে মুসলমান অধ্যুষিত বেলগাছিয়া অঞ্চলের ‘আমন কমিটি' দুর্গোৎসবের দিনগুলিতে এলাকায় পুজোর ভিড় সামলাতে বা যান নিয়ন্ত্রণ করার কাজ করে আসছে৷ আমন কমিটির পরিচালনায় স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়৷

টালা থেকে শুরু করে বেলগাছিয়া জায়গাটা কম বড় নয়, ১০-১২টি বড় মাপের সর্বজনীন দুর্গাপুজো হয়৷ ছোট-বড় নানা বাজেটের এই পুজোগুলিতে উপচে পড়া ভিড় হয়৷ পুজোর উৎসাহী দর্শনার্থীরা যখন সকাল থেকে রাত অবধি এক মণ্ডপ থেকে আরেক মণ্ডপে চক্কর কাটেন, তখন তাঁদের গাড়ি পার্কিং থেকে শুরু করে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার কাজও করেন এঁরাই৷ কলকাতার পুলিশের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তাঁদের এই উদ্যোগ৷ পুজোর যানজট নিয়ন্ত্রণে, ভিড় সামলাতে বা ইভটিজিং রুখতে আমন কমিটির ৬০-৭০ জন স্বেচ্ছাসেবকই এলাকার ভরসা৷ এমনকি মণ্ডপে ঝামেলা হলে সেটাও আমন কমিটিই নিষ্পত্তি করে৷ তিন দশক ধরে কাজই তাঁদের পরিচয় হয়ে উঠেছে৷ 

‘গ্রামাঞ্চলে দেখেছি হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকে৷ কিন্তু শহরের দিকেই সমস্যা দেখা যায়’

বেলগাছিয়া মোড়ে পুজোর দিনগুলোতে ক্যাম্প করেন তাঁরা৷ আমন কমিটির সম্পাদক সওকত আলি ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ১৯৮৫ সাল থেকে শুধু দুর্গাপুজো নয়, বরং রথযাত্রা, দোল, মহরম সব ক্ষেত্রেই আমন কমিটির স্বেচ্ছাসেবকেরা দায়িত্ব নিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজটি করেন৷ দুর্গাপুজোয় এ কাজের জন্য টাস্ক ফোর্সও গঠন করা হয়৷ প্রতিটি পুজো কমিটির সঙ্গে এই টাস্ক ফোর্স যোগাযোগ রাখে৷ কখনো কখনো ৫ দিনের ক্যাম্প বেড়ে ৬-৭ দিনও হয়৷    

আমন মানে শান্তি৷ সারা দেশে যখন মানুষের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার বারুদ ঠাসছে রাজনীতি আর অসহিষ্ণু পরিবেশ, তখন তিন দশক ধরে আমন কমিটি কীভাবে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির বার্তা বজায় রাখছে? অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সওকত বলেন, ‘‘আমরা মানুষের বিশ্বাস পেয়েছি আমাদের কাজের জন্যই৷ রাজনীতিকে আমরা একেবারেই ঢুকতে দিইনি এসবে৷ এলাকার মানুষ, থানা পুলিশ সবাই আমাদের ওপর ভরসা রাখেন৷ পুজোর জন্য চাঁদার জুলুমও হয় না আমাদের এলাকায়৷''

এবার ১৬ অক্টোবর থেকে শুরু হবে আমন কমিটির ক্যাম্প৷ এখন রাত জেগে চলছে মিটিং৷ পুজোর এই আনন্দ উৎসব যাতে নির্বিঘ্নে চলতে পারে, তার জন্য সবরকম প্রস্তুতি নেওয়া প্রায় শেষের পথে৷ কমিটির মতে, এবার এর জন্য খরচ হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা৷ কিন্তু সেই খরচ চালাবে কীভাবে? সওকত বলেন, ‘‘আমরা সদস্যরা চাঁদা দিই, কিছু মানুষ ডোনেশন দেন৷ তাতেই খরচ চলে৷''

‘ভোর ৬ টা থেকে দুটো শিফটে আমাদের কাজ হয়’

আমন কমিটির কোনোরকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নেই, নেই অনুদানও৷ অন্যদিকে রাজ্যের ২৮ হাজার দুর্গাপুজো ক্লাবকে ১০ হাজার টাকা করে সরকারি অনুদান দেওয়া হচ্ছে৷ এই প্রসঙ্গ টেনে ইমাম, মোয়াজ্জিমদের ভাতা বাড়ানোর দাবিতে শহরের পথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মিছিলও হয়েছে৷ সেখানে আমন কমিটি নিজেদের কাজটা করেই সন্তুষ্ট৷ সে কাজ দুর্গাপুজো হোক বা ভোটের শান্তি রক্ষা হোক৷  

সওকত বলেন, ‘‘৪৭ টি শান্তি কমিটি ছিল কলকাতায় সে সময়ে৷ আজ এখন আমরাই টিকে আছি শুধু৷ দেড় লাখ মানুষের শান্তি, নিরাপত্তার দায়িত্ব আমন কমিটির কাঁধে৷ কমিটিতে স্বেচ্ছাসেবকসহ ৩০০ মানুষের যোগদানই এ কাজকে এত সুন্দরভাবে করতে সাহায্য করছে৷''      

পুজো এখন আর চারদিনের নয়৷ মহালয়া থেকেই শুরু হয়ে যায় মণ্ডপ উদ্বোধন৷  প্যাণ্ডেল হপিং শুরু হয়ে যায় সকাল থেকেই৷ তাই দায়িত্ব এখন আরো অনেক বেশি৷ আমন কমিটির সদস্য শাহিদ আখতার বললেন, ‘‘ভোর ৬ টা থেকে দুটো শিফটে আমাদের কাজ হয়৷ রাত ১২ টা অবধি চলে৷ কখনো কখনো রাত দুটো অবধিও করতে হয়৷''

বেলগাছিয়া মোড়ে দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ঋভু পত্রনবীশ ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘কাছেই টালা বারোয়ারির মতো বড় পুজোও হয়৷ এই পুজোয় দৈনিক যেখানে ৪ লাখ দর্শনার্থীর ভিড় হয়, এই জনস্রোতটা সামলানো যথেষ্ট কঠিন৷ দুর্গাপুজোয় এভাবে আমন কমিটির ক্যাম্প সত্যিই আমাদের ভরসা জোগায়৷ জনজোয়ারে ক্লান্ত মহানগরীতে এক গেলাস জল ধরিয়ে দেওয়ার লোকও তখন বড় দরকার হয়ে ওঠে৷''

‘দেড় লাখ মানুষের শান্তি, নিরাপত্তার দায়িত্ব আমন কমিটির কাঁধে’

একসময় বেলগাছিয়া বস্তির অসামাজিক কাজকর্ম রুখতে তৈরি হয়েছিল বেলগাছিয়া পিস কমিটি বা আমন কমিটি৷ নানাভাবে মানুষের বিশ্বাস বেড়েছে৷ তাই বেড়েছে তাদের কাজের পরিধিও৷ হিন্দু-মুসলিম দুর্গোৎসবের গণ্ডি পেরিয়ে ৩১ ডিসেম্বরের বর্ষশেষের রাত, মাদকবিরোধী দিবস, ট্রাফিক সচেতনতা দিবসেও কাজ করেন পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে৷ কমিটির সদস্যদের মুখেই শোনা যায়, ১৯৯২-র ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে মেটিয়াবুরুজের একদল ধর্ম উন্মত্ত যুবক বেলগাছিয়ার পরেশনাথ মন্দির ভাঙতে উদ্যত হয়৷ আমন কমিটিই তাদের আটকায়৷ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে আমন কমিটি আজও এ ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়৷     

কলকাতা, তথা পশ্চিমবঙ্গের দুর্গোৎসবে মুসলমান জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বঙ্গ সংস্কৃতিতে নতুন নয়৷ বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন আইপিএস অফিসার ডঃ নজরুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘এ ধরনের উদ্যোগ সবসময়ই স্বাগত৷ বিশেষ করে শহরাঞ্চলে৷ আমরা গ্রামাঞ্চলে বড় হয়েছি, দেখেছি  হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকে৷ কিন্তু শহরের দিকেই সমস্যা দেখা যায়৷ এখানে বিষয়টা এত স্বাভাবিক নয়৷ তাই শহরে এ ধরনের উদ্যোগ জরুরি৷'' 

দুর্গাপুজোয় শাহিদদের নতুন জামা-কাপড় হয় না ঠিকই, কিন্তু দুর্গোৎসব তাঁদেরও উৎসব! এই উদযাপনে তাঁরাও সামিল৷

আপনার কোন মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷