যে ঢাকিদের বায়না হলো না
পুজো শেষ। সারা বছরের রোজগার নিয়ে গ্রামে ফিরবেন ঢাকিরা। কিন্তু যারা বায়নাই পেলেন না, তাদের কী হবে?
ঢ্যাম কুর কুর
ঢাকের আওয়াজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকে পুজো। পালক দিয়ে সাজানো ঢাকের ঝুঁটি নাড়াতে নাড়াতে, ঢ্যাম কুর কুর বোল তোলা মানুষগুলোর অনেকে পুজোর সময়ে ঢাক বাজানোর বরাত পেলেও, এদের অনেককেই সারাবছর অন্য পেশায় জুড়ে থাকতে হয়। পেটের দায়ে।
চাষের ফাঁকে ঢাক
দুর্গাপুজো এলে পশ্চিম বাংলার কয়েকটি জেলা থেকে এরা কলকাতা শহরে আসেন বায়না পাবার তাগিদে। সারাবছর ক্ষেতখামারি করার পাশে পুজোর কয়েকটা দিনের একটু বাড়তি রোজগার।
বায়না পাবার নিয়ম
শিয়ালদা স্টেশন চত্বর, নতুনবাজার, দমদমের মতো কয়েকটি জায়গায় এরা দুর্গাপূজার দু-তিনদিন আগে থেকে এসে ঢাক বাজানো শুরু করেন। আশা একটাই, পুজোকমিটির লোকেরা এসে তাদের বাজনা শুনে দরদাম করে বায়না করে নেবেন।
কঠিন প্রতিযোগিতা
কপাল ভালো থাকলে কারো প্রথম দিনেই বায়না জুটে যায়। কেউ কেউ মন্দ কপাল নিয়ে সপ্তমীর সকালে কলাবউয়ের স্নান পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন। কম পারিশ্রমিকেও হয়তো একটা বায়না জুটে যাবে, এই আশায়।
রাতের খাবার মুড়ি
শহরে পা রাখার পর থেকে বায়না না পাওয়া পর্যন্ত এই মানুষগুলোকে খাওয়া থাকার খরচ নিজেদের পকেট থেকেই চালাতে হয়। হোটেলে থাকার বিলাসিতা ভাবনাতেও আসে না। সপ্তমীর অপেক্ষায় যখন পয়সা ফুরিয়ে আসে, মুড়ি খেয়েও রাত কাটাতে হয়।
করোনা আতঙ্ক
গত দু’বছরে করোনা পরিস্থিতি জীবিকায় থাবা বসিয়েছিল। এই বছর সামাজিক পরিস্থিতি ছন্দে ফিরেছে দেখে আশায় ছিলেন রুনু বাউড়ি। ভালো টাকার একটা বায়না পেলে মেয়েকে স্মার্টফোন কিনে দেবেন ভেবেছিলেন। ভালো টাকা তো দূরস্ত, বায়নাই পাননি।
কেবলই মন খারাপ
আক্ষেপের সুর কার্তিক সেনাপতির গলায়। ''কিছু ঢাকি আছে যারা লোকশিল্পী ভাতা পায়, আবার তাদের ফোনে ফোনেই বায়না হয়ে যায়। আমরা আর শিল্পী হতে পারলাম কই? কাঠমিস্ত্রিই রয়ে গেলাম।''
আট বছরের সহশিল্পী
ঢাকের তালে কাঁসর বাজানোর জন্য সঙ্গে এনেছিলেন আটবছরের পুত্রসন্তানকে। তৃতীয়ার রাতে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে করে কলকাতা পোঁছেছিলেন। সপ্তমীতেও কপালে কাজ জোটেনি। ''কলকাতার লোভ না করে আউশগ্রামে থেকে গেলেই হতো। অন্তত কিছু পয়সা পেতাম”''
পুজোই পাখির চোখ
বছরভর নানান পুজো থেকে ডাক এলেও শারদ-মরসুমকেই পাখির চোখ হিসেবে দেখেন এই বাজিয়েরা। কৃষিকাজ ছাড়াও অনেকেই দিনমজুর বা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন বছরের বাকি সময়গুলো। ঢাকের মতো এক প্রাচীন তালবাদ্য পেটের টানে বাজান বলে মানুষ এদের শিল্পী বলে ভাবেন না, এরা নিজেরাও ভাবেন না।
আর আশা নেই
সপ্তমীর বেলা বাড়তেই সব আশা শেষ। ব্যাগপত্তর গোছানোও হয়ে গিয়েছে ভারত, কার্তিক, রুনুদের। কয়েকদিনের ব্যর্থ শহর-সফর সেরে তারা ফেরার গাড়িতে উঠবেন। ছোট্টো ছেলেটাকে একবার আলিপুরের চিড়িয়াখানাটা দেখিয়ে নিয়ে যাবেন ভেবেছিলেন অর্জুন। ফেরার টিকিটের পয়সা থাকবে না বলে সে আশও মেটেনি।