1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে মি-টু আন্দোলন

রাজীব চক্রবর্তী নতুন দিল্লি
১৮ অক্টোবর ২০১৮

সমস্ত পেশায় অবাঞ্ছিত স্পর্শের শিকার নারী৷ এতদিন নিপীড়িতাদের মুখে কুলুপ আঁটা ছিল৷ মাত্র একটা স্ফুলিঙ্গ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে৷ টুইটার, ফেসবুকে ক্ষোভের আগুন ধেয়ে আসছে বহু খ্যাতনামার দিকে৷

https://p.dw.com/p/36lQg
ছবি: Fotolia/DW

ভারতে যৌন হয়রানির কথা উঠলে ‘আট থেকে আশি’ কিংবা ‘ধর্ষণ’, এমন কোনো শব্দের সীমারেখায় আর আটকে রাখা চলে না ঘটনাগুলিকে৷ আট বছরের বালিকা নয়, সদ্যোজাত শিশুকন্যারও রেহাই নেই৷ ন্যক্কারজনক ঘটনায় অভিযুক্ত পুরুষ৷ রাস্তাঘাট,মাঠ-ময়দান, স্কুল-কলেজ, ট্রেন-বাসে তো বটেই, এরপর সমাজ ও পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে কর্মস্থলে পৌঁছালে সেখানে ওঁত পেতে থাকেন দপ্তরের ‘বস’৷ তাঁরা ‘সুযোগের সদ্ব্যবহার’ করেন৷ অধস্তন মহিলা কর্মীকে এঁরা কেউ হোটেলে নিয়ে যেতে চান৷ কেউ নিজের ফাঁকা বাড়িতে৷ কেউ রিসর্টে৷ কেউবা অফিসের কেবিনকেই নিজের রাজত্ব ভেবে বসেন৷ বহু ক্ষেত্রে অধস্তন নারী চূড়ান্ত নির্যাতিতা হয়েও মুখে কুলুপ এঁটে রাখেন৷ ভয় কাজ করে৷ কাজ হারানোর ভয়৷ সমাজে কলঙ্কের ভয়৷ প্রভাবশালী ‘বস’দের ক্ষমতার ভয়৷ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই ছবিটা অনেকটা একইরকম৷

সম্প্রতি ভারতে সোশ্যাল মিডিয়াতে এক আন্দোলন বেশ গতি পেয়েছে৷ তার নাম ‘মি-টু’৷ টুইটারে হ্যাশট্যাগ মি-টু আক্ষরিক অর্থেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে৷ এই ছোট্ট শব্দ দুটি ভাষা জোগাচ্ছে শত-সহস্র নারীকে৷ এই ক্যাম্পেনে বিশেষত নির্যাতিতা মহিলারা তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন৷ আর তাতেই উঠে আসছে একের পর এক তাবড় ব্যক্তিদের নাম৷ প্রায় কোনো ক্ষেত্রটিই এই অভিযোগের বৃত্তের বাইরে নেই৷ সিনেমা জগত, ক্রীড়া জগত, সংবাদ জগত কোনোটিই বাকি নেই৷ এক মার্কিন অভিনেত্রী ‘মি-টু’ আগুনটা জ্বেলে ছিলেন৷ তারপর মুহুর্তে সেই আগুন ছড়িয়ে এবার চলে এসেছে ভারতেও৷ হলিউড প্রযোজক হার্ভি উইনস্টেইনকে বিশ্বমঞ্চে বেনাকাব করে ছেড়েছে এই ক্যাম্পেইন৷ রাতারাতি একাধিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হারাতে হয়েছে হার্ভিকে৷ ভারতে শুরুটা হয়েছিল অভিনেতা নানা পাটেকর দিয়ে৷ অভিযোগকারিনী তনুশ্রী দত্ত৷ তারপর একে একে ‘মি-টু'তে অভিযুক্ত হয়েছেন অনেক নামী ব্যক্তিরা

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মহিলাদের হেনস্থা করার যেন ‘অধিকার’ পেয়েছে উচ্চপদস্থরা: দীপ্সিতা ধর

‘মি-টু’ ক্যাম্পেইন নিয়ে সাক্ষাৎকারে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেত্রী দীপ্সিতা ধর ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘এই ক্যাম্পেইনে শুধুমাত্র যৌন নির্যাতনের বিষয়টা সামনে আসছে৷ অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটেছে চার দেওয়ালের মধ্যে৷ আসলে এতদিন এই ধরনের ঘটনাকে আমরা (সমাজ) যৌন হয়রানি বলে মনেই করতাম না৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মহিলাদের হেনস্থা করার যেন ‘অধিকার’ পেয়েছে উচ্চপদস্থরা৷ এখন সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে অনেকেই নিজের মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা যন্ত্রনা প্রকাশ করছেন৷ তবে, যে মহিলারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁরাই বলতে পারছেন৷ অনেক সময় পার হয়ে গেছে সেই কারণেই৷ হয়ত আগে বলার মতো পরিস্থিতি তাঁরা পাননি৷’’

তিনি মনে করছেন, যেসব ঘটনা এখনো অবধি প্রকাশ পেয়েছে, তা আসলে হিমশৈলের চূড়া মাত্র৷ যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সমাজে হাজার, লাক্ষ এমন ঘটনা ঘটেছে৷ দীপ্সিতার কথায়, ‘‘এই সমস্যার বীজ অনেক গভীরে৷ শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে বা প্রচার করে এর সমাধান সম্ভব নয়৷ এর জন্য কতকগুলো প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত প্রয়োজন৷ সবার আগে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যাদের আছে, এমন সংস্থা ও তাদের পরিচালকদের মানসিকতা বদলানো প্রয়োজন৷’’

বিবেক অগ্নিহোত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এম জে আকবর, আলোক নাথ, সুহেল শেঠ, সুভাষ ঘাই, উৎসব চক্রবর্তী, রণ খাম্বা, বিকাশ বেহেল, প্রকাশ ঝা, সিদ্ধার্থ ভাটিয়া, রজত কাপুর, কৈলাশ খের, কে আর শ্রীনিবাস, গৌতম অধিকারী, মনোজ রামচন্দ্রণ, মায়াঙ্ক জৈন, অনুরাগ বর্মা এবং সাজিদ খানরা অভিযুক্তের তালিকায়৷ তাদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন অনেক নারী৷ কলকাতায় নাট্যপরিচালক প্রেমাংশু রায়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে৷ ‘মি-টু’ ঝড় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের দিকে ধেয়ে এসেছে৷ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সিইও রাহুল জোহরির বিরুদ্ধেও যৌন হেনস্থার অভিযোগ৷

এইসব ঘটতে থাকলেও ভারতে এতদিন তেমনভাবে কেউ মুখ খোলেননি৷ কিন্তু একজনের পর একজন করে বর্তমানে ‘মি-টু’ ঝড় বইছে ভারতজুড়ে৷ অগুনতি মহিলা সরব৷ পুরুষরাও যৌন নির্যাতনের শিকার৷ তাঁরাও অকপটে মুখ খুলছেন৷

কাউকে বদনাম করতে ‘মি-টু’ র সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে: ডাঃ পার্থ কুণ্ডু

কলকাতা শহরের মনরোগ চিকিৎসক পার্থ কুণ্ডু বলেন, ‘‘নারী বা পুরুষ যে কেউই উচ্চপদে অবস্থান করলে শুধু যৌন হেনস্থা নয়, অন্য নানাভাবে অধস্তনকে হয়রান করা হয়৷ সবটাই নির্ভর করে উচ্চপদস্থের মনস্তাত্তিক গঠনের ওপর৷ প্রায়শই এমন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ চিকিসার জন্য আসেন৷ এতদিন ধরে যেসব ঘটনা ঘটে এসেছে, এখন তা প্রকাশ পাচ্ছে একটা পোশাকি নামের ওপর ভিত্তি করে৷ কারণ, প্রথাগত মিডিয়া টিভি, সংবাদপত্র বা রেডিও-তে এই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা প্রচার করা হতো না৷ তাই এখন যখন সোশ্যাল মিডিয়ার দাপট বেড়েছে, তখন অনেক গোপন কথা, কষ্টের কথা, নিপীড়নের কথা অকপটে বলতে পারছেন৷’’

ডা. পার্থ কুণ্ডু অবশ্য উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করেছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘সব ক্ষেত্রে অভিযোগগুলি যে ঠিক, তা জোর গলায় বলা যাবে না৷ কাউকে বদনাম করতে ‘মি-টু’ র সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে৷ এর পেছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি অথবা পুরোনো শত্রুতা থাকতেই পারে৷ যেমন, আজ যিনি নিপীড়িত বলে দাবি করছেন, অতীতে তিনি কোনো বড় মাপের সুযোগ নিয়ে নিজের সম্মান বিকিয়েছেন, এমনটাও হতে পারে৷ এমন দাবি অনেক ক্ষেত্রে উঠছে৷’’