1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যত কিপটামি স্যানিটারি প্যাডেই

২৮ নভেম্বর ২০২০

স্কটল্যান্ডে সম্প্রতি পাশ হয়েছে ঋতু-পণ্যকে বিনামূল্য করার আইন৷ কিন্তু এই স্কটিশ বেল পাকায় ভারতীয় কাকের কী? বাস্তবচিত্র কী বলছে?

https://p.dw.com/p/3lx39
স্যানিটারি প্যাড
ছবি: IANS/B. Manna

স্কটল্যান্ডে সম্প্রতি পাশ হয়েছে একটি আইন, যা সেদেশের নারীদের হাতে সব ধরনের ঋতু-পণ্যকে বিনামূল্যে পৌঁছে দেবে৷ ভারতের প্রেক্ষিতে এই তুলনা টানা সত্যিই অসম্ভব৷ খবরটা দেখেই এক ঝটকায় নিজের বয়োসন্ধির দিনগুলিতে ফিরে গেলাম৷ তখন সদ্য ‘নারীত্বে' পদার্পণ করেছি৷ নিত্যনতুন নিজের শরীরের তাল-বেতাল দেখে অবাক হওয়ার পালা প্রতিদিন৷ যা-ই দেখি তা-ই দেখে আমার প্রশ্নের কোনো শেষ নেই৷ অথচ উত্তর পাব কোথা থেকে?

টিভিতে স্যানিটারি প্যাডের বিজ্ঞাপন দেখে আমার অবাক হওয়া আরো বাড়ে৷ কিছুতেই বিজ্ঞাপনের সাথে নিজেকে মেলাতে পারিনা৷ ওই যে সুন্দরী মডেল প্যাডের বিজ্ঞাপন করে, সাদা প্যান্ট পড়ে ফটাফট লাফায়, তাকে দেখে অবাক হই৷ আরো অবাক হই বিজ্ঞাপনের নীল রঙা পদার্থের সাথে নিজের শরীরের লাল বাস্তবতাকে না মেলাতে পেরে৷ সত্যের সাথে পর্দার কোনো মিলই পাই না৷

এদিকে তখন আমি আরো অবাক হচ্ছিলাম শুধু আমার একার জন্য মাসের বাজারের সাথে আসা বাহারি প্যাডের প্যাকেট দেখে, কারণ আমি বাদে বাসার আর কোনো নারীই তা তখন ব্যবহার করতেন না৷ সবার জন্য বরাদ্দ ছিল পুরোনো কাপড় বা সবচেয়ে সস্তার খসখসে কাগজের প্যাড৷ এর কারণ ছিল প্যাডের দাম, যা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে স্রেফ বিলাসিতা৷ আর এই বাস্তবের পরিবর্তন আজও হয়নি৷ আজও ভারতে প্যাডের দাম আকাশছোঁয়া৷ আর ট্যাম্পন বা মেনস্ট্রুয়াল কাপ কী জিনিস, তা হলফ করে বলতে পারি দেশের দুই শতাংশও জানেননা৷

Shabnam Surita Dana
শবনম সুরিতা, ডয়চে ভেলেছবি: Melissa Bach Yildirim/AU Foto

আমার কৈশোরে প্রতিমাসের জন্য বরাদ্দ ছিল দু'প্যাকেট স্যানিটারি প্যাড, প্রতি প্যাকেটে আটটি করে প্যাড৷ এই এক প্যাকেটের দাম আজকের দিনে অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ রুপি বা আরও বেশি৷ যদিও ডাক্তাররা বলেন যে কোনো নারীর একটানা পাঁচ ঘন্টার বেশি একটা প্যাড ব্যবহার করা উচিত নয়, তা মানা হতো না মোটেও৷ আমি ও আমার অন্যান্য বান্ধবীরা মনে আছে খুব হিসাব করে খরচ করতাম সেই প্যাড৷ গর্ব করে গল্প করতাম নিজেদের অসাধারণ সাশ্রয়ী কর্মকাণ্ডের৷ তখন কেউ আমাদের বলেনি এর ঠিক কী প্রভাব আমাদের শরীরে পড়তে পারে৷

তবে একা একা আকাশকুসুম ভাবনাচিন্তা করার সময় ভেবে অবাক হতাম যে, যেসব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন চাল, ডাল, লবণ এসব ব্যবহার করতে এত কিপটেমি কেউ দেখায় না৷ কিন্তু যত কিপটেমি ওই প্যাডের বেলাতেই কেন? ওই স্যানিটারি প্যাড, যার ব্যবহারের প্রয়োজনের ওপর আমার নিজস্ব কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই, পুরোটাই শরীরের খামখেয়ালের ওপর ছাড়া!

অনেক পরে বড় হয়ে জানলাম যে এই কিপটেমি শুধু আমার পরিবার নয়, দেশের আর সবক'টি মধ্যবিত্ত পরিবারই মেনে আসছে৷ মনে পড়ে, স্কুলের রিসেপশানে গিয়ে চাইলে দশ রুপির বিনিময়ে একটা খসখসে কাগজের প্যাড আমাদের ধরিয়ে দেওয়া হতো যা ব্যবহার করে একটা গোটা দিন স্কুলে কাটাতে বেশ কষ্টই হতো৷ কিন্তু ওই যে, ভালো মানের প্যাডের জন্য দাম হবে বেশি, যা হয়তো সব শিক্ষার্থীরা দিতে পারবে না৷ এভাবেই আমার দেখা ভারতে প্রশ্রয় পেয়েছে ঋতুকালীন শ্রেণীবৈষম্য৷ মোটা চাল আর সরু চালের তফাতের মতোই এখানেও মোটা আর সরু প্যাডের মাঝে বিস্তর ফারাক৷

তবে দিন যেতে যেতে ভারতে অন্তত শহুরে নারীদের মধ্যে বেড়েছে ঋতুবিষয়ক সচেতনতা৷ বেড়েছে এবিষয়ে নানা ধরনের সরকারি-বেসরকারি পরিকল্পনার ঝোঁক৷ সাথে খোলা বাজারের নিয়ম মেনে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্যাডের দামও৷ যদিও ২০১৮ সালে বাড়তি কর কমানো হযে প্যাডসহ বিভিন্ন ঋতু-পণ্যের ওপর, তবুও ভাবার বিষয় এটাই যে, যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দামে সরকার সাধারণত ভর্তুকি দেয়, তা স্যানিটারি প্যাড বা ট্যাম্পনের ক্ষেত্রে আজও নেই৷ কোনো কোনো রাজনীতিকরা এটাও মনে করেন যে আদতে এই পণ্যগুলি মোটেও প্রয়োজনীয় পণ্য বা ‘এসেনশিয়াল কমোডিটি' নয়৷ ফলে, হয়তো যে নারীদের কথা ছিল সচেতন হয়ে প্যাড ব্যবহারের দিকে ঝোঁকার, তারা বাড়ন্ত দাম দেখে আরও বেশি করে প্যাডবিমুখ হয়েছেন৷

এরপরেও আশার বিষয় যে গত কয়েক বছরে নারীস্বাস্থ্য ও বিশেষ করে ঋতুস্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা বেড়েছে৷ অক্ষয় কুমারের সাকুল্যে বলিউড শিখেছে প্যাড নিয়ে চিত্রনাট্য লিখতে৷ এসবই ভালো কথা, কিন্তু তারপরেও ভারতে এখনও নারীদের মধ্যে যেসব প্রজননজনিত রোগ দেখা যায়, তার ৭০ শতাংশের পেছনেই রয়েছে ঋতুকালীন অপরিচ্ছন্নতা৷ শুধু তাই নয়, দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা এই নারীদের মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশের কাছে এই প্যাড বা ট্যাম্পনের মতো ঋতু-পণ্য কেনার সামর্থ্য রয়েছে৷

ঋতু-পণ্যের ওপর যে কর এতদিন ছিল, তাকে হিন্দি ভাষায় বলে ‘লহু কা লগান', অর্থাৎ রক্তের কর৷ এপ্রসঙ্গে, দুর্বল ভারতীয়দের প্রতি নিষ্ঠুর ব্রিটিশ শাসকের রাগ ঝাড়ার মুহূর্তের একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে৷ দৃশ্যটি ছিল আমির খান অভিনীত বিখ্যাত ছবি ‘লগান'-এ৷ তার একটা ডায়লগ মনে পড়ছে, যেখানে ক্যাপ্টেন রাসেল আমির খানের চরিত্র ‘ভুবন'কে বলছে, ‘‘তুম সালা কুত্তালোগ হামারি জুতি কে নিচে রাহেগা''৷ অসচ্ছ্বল চম্পারন গ্রামে সেবছর কোনো বৃষ্টি হয়নি৷ তাই ফসলের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না সেই গ্রামের বেচারা চাষীদের৷ তবুও বিনা দোষে তিনগুণ কর দিতে বাধ্য করেছিল শাসক৷ শাসকদের নিজেদের খেলা ক্রিকেটে হারিয়ে তবেই সেই কর থেকে মুক্তি পেয়েছিল আমির খানের গ্রাম চম্পারন৷

জানি এই তুলনাটা একটু ফিল্মি, কিন্তু না টেনে পারছি না৷ সিনেমার সেই চম্পারনের বৃষ্টি আর বাস্তবের নারীদের ঋতুর রক্তপাতের মধ্যে উভয়পক্ষেরই কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ তবুও ‘লগান' দিতে হচ্ছেই৷ ঠিক কোন খেলায় কাকে হারালে নারীদের এই আজীবনের রক্ত-কর মকুব হবে, জানেন কি?