1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মুক্তিযুদ্ধের করুণ স্মৃতি এখনও কাঁদায় জিনাতের মন

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১১

স্বাধীনতা আর মুক্তি৷ পরম আনন্দের, পরম পাওয়া৷ কিন্তু এর অর্জন কখনই সহজ নয়৷ সম্মুখ যুদ্ধ, গোপন হামলা, গুপ্তচরবৃত্তিসহ অসংখ্য ত্যাগ, তিতিক্ষা আর হারানোর স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সাথে৷

https://p.dw.com/p/10Pqw
জিনাত রহমানছবি: DW/Mahfuzur Rahman

জিনাত রহমান৷ নারায়নগঞ্জে জন্ম ১৯৬২ সালের ১ জানুয়ারি৷ পিতা নুরুল ইসলাম এবং মা আছিয়া বেগম৷ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো এখনও জীবন্ত হয়ে জেগে আছে জিনাত রহমানের জীবন দর্পনে৷ কম বয়স হওয়ার কারণে সম্মুখ যুদ্ধের সুযোগ না পেলেও কৌশলে গুটি গুটি পায়ে বোমা পেতে রেখে শত্রুব্যুহ ধ্বংস করার মতো কাজ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন জিনাত৷ ডয়চে ভেলের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন কীভাবে নৌকায় রেখে আসেন বোমা ভর্তি মাছের ডোলা আর পাক সেনারা সেই নৌকায় উঠলে বোমা বিস্ফোরিত হয়ে সেখানেই মারা যায় শত্রু সেনারা৷

তিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা শহর থেকে গ্রামে চলে যায়৷ কিন্তু তারপর একদিন খবর আসে পাক সেনারা গ্রাম ঘিরে ফেলেছে৷ ফলে বাবা, চাচা, মা, বোন সবার সাথে গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে যাচ্ছি৷ এমন সময় নদীর কাছে এসে মানুষের ভিড়ে আমি বাবা, চাচাদের হারিয়ে ফেলি৷ বেশ খানিকটা পেছনে পড়ে যায়৷ ফলে ভয় পেয়ে যায় আমি৷ এমন সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা এসে আমাকে বলেন, আমি যদি তাঁর হাতে থাকা মাছের ডোলাটা নদীর তীরে থাকা নৌকায় রেখে আসতে পারি, তাহলে তিনি আমাকে আমার বাবা-ভাইদের কাছে পৌঁছে দেবেন৷ আমি রাজি হয়ে যায়৷ দৌড় দিয়ে এগিয়ে যায় নৌকাটির দিকে৷ কিন্তু পেছন ফিরে দেখি সেই লোক নেই৷ আমি থমকে দাঁড়ালে তিনি আবার শস্য ক্ষেতের মাঝ থেকে হাত ইশারা করে জানান যে, তিনি সেখানে লুকিয়ে আছেন৷ এরপর আমি নৌকার মধ্যে রেখে আসি ঐ মাছের ডোলা৷ ফিরে এসে তাঁর সাথে কিছুক্ষণ ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে থাকলাম৷ প্রায় ২০ মিনিট পর দেখলাম ৫০ থেকে ৬০ জন পাক সেনা এসে ঐ নৌকায় উঠল নদী পার হওয়ার জন্য৷ ঠিক তখনই বোমাগুলো বিস্ফোরিত হলো৷ আর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো সবগুলো পাক সেনা৷

Kaptai Lake in Bangladesh Flash-Galerie
নৌকায় বোমা রেখে পাক সেনাদের মেরেছেন নয় বছরের জিনাতছবি: DW

এরপর তিনি আমাকে নিয়ে দৌড়ে সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পৌঁছে দিলেন৷ সেখানে পরে আমাকে খুঁজে পান আমার আত্মীয় স্বজন৷ কিন্তু সেসময় শিবিরগুলোতে খাদ্য সংকট এমন ছিল যে, আমরা প্রায় সারাদিনই তেমন কিছু খেতে পাইনি৷ এরপর পাশের আরেক গ্রাম থেকে বালতিতে করে ডাল আর ভাত নিয়ে আসল কেউ একজন৷ কিন্তু এতো মানুষের জন্য তা মোটেও যথেষ্ট নয়৷ তখন বড়রা বললেন যে, ছোটদের আগে খেতে দাও৷ বড়রা পরে খাবে৷ তখন অল্প অল্প করে সেই ডাল আর ভাত খেয়েই ক্ষুধা মেটাই আমরা৷ ডাল-ভাতই তখন আমাদের কাছে মনে হয়েছিল যেন খুব সুস্বাদু খাবার৷ এরকম অনেক কষ্টের দিন গেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়৷

Zinat Rahman Dinajpur The Daily Uttarbangla Bangladesch
দিনাজপুর থেকে প্রকাশিত নিজের পত্রিকা ‘দৈনিক উত্তরবাংলা’য় কাজে ব্যস্ত জিনাতছবি: DW/Mahfuzur Rahman

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কীভাবে প্রতিদিন মাথায় করে খাবার বহন করতেন জিনাত, তার গল্প শোনান তিনি৷ বললেন, ‘‘এরপর দাদির বাড়িতে কাটিয়েছি আমি যুদ্ধের অনেকটা সময়৷ তখন দাদি আমাকে প্রতিদিন ভাত, রুটি, খিচুড়ি জাতীয় খাবার রান্না করে সেগুলো একটা গামলায় গামছা দিয়ে বেঁধে দিতেন৷ সেই খাবারগুলো আমার মাথায় তুলে দিয়ে বলতেন, এগুলো ধান ক্ষেতের কাছে রেখে আয়৷ তখন আমি ঠিক বুঝতাম না যে, ওগুলো কেন ক্ষেতের কাছে রেখে আসবো৷ দাদি বলতেন, ওখানে রেখে আয়৷ ওগুলো আমাদের জন্য নয়৷ কাজের লোকেরা খাবে৷ আমি বলতাম যে, কই মাঠে তো কেউ কাজ করছে না৷ তবুও তিনি সেখানে রেখে আসতে বলতেন৷ আর ফুফুরা সব যুবতী ছিল তাই তারা বাসায় থাকতো না৷ অন্য জায়গায় থাকতো, বাংকারে ঢুকে থাকতো পাক সেনাদের ভয়ে৷ কারণ সুন্দরী মেয়েদের পাক সেনারা ধরে নিয়ে যেতো, ধর্ষণ করতো৷ তাই বাসায় শুধু বুড়া-বুড়ি আর আমরা ছোটরা বাসায় থাকতাম৷ তাই প্রতিদিন আমি ধান ক্ষেতের কাছে খাবার দিয়ে আসতাম৷ আর গ্রামের যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল তাদের দু'য়েক জন এসে খাবার নিয়ে যেতো৷ খাবার খেয়ে প্রশিক্ষণ করতো, যুদ্ধ করতো৷

আরেকদিনের নির্মম ঘটনা স্মরণ করে এখনও প্রাণ কাঁদে জিনাতের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় দশ-পনেরো দিন আগে পাক সেনারা আবার আমাদের গ্রাম ঘিরে ফেলে৷ সেদিন ছিল শুক্রবার৷ জুমার নামাজের পর মসজিদ থেকে বের হয়েই পাক সেনাদের আসার খবর পায় সবাই৷ তখন গ্রামের তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ সবাই আবার মসজিদে আশ্রয় নেয়৷ কিন্তু তবুও রক্ষা পায়নি গ্রামের প্রায় সাড়ে তিনশ' পুরুষ৷ তাদেরকে পাশেই নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা৷ মেরে সবাইকে নদীতে ফেলে দেয়৷

মুক্তিযুদ্ধের এমনই সব করুণ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন জিনাত রহমান৷

প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই

সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন