1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মানুষ মরলে ক্ষতিপূরণ আছে, আর কী চাই!

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

খাতায় কলমে সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া আছে৷ বাস্তবে ছবিটা আলাদা৷ মানুষ, সরকার, মিডিয়া সকলেই অসচেতন৷ সচেতন হলেই তো মুশকিল৷

https://p.dw.com/p/4Ha1d
কলকাতার এক বাজারে আগুন লাগার পর দমকল কর্মীদের তৎপরতা
কলকাতার এক বাজারে আগুন লাগার পর দমকল কর্মীদের তৎপরতাছবি: DW/S. Bandyopadhyay

নিরাপত্তা? তা তো আছেই৷ তাই বলে দুই-একটা বিচ্যুতি থাকবে না, তা কি হয় নাকি! যেমন, বেড়াতে গিয়ে মানুষ রোপওয়ে চড়বেন৷ তা রোপওয়ের দড়ি ছিঁড়ে তা নীচে পড়তেই পারে৷ দুই-একজন মারা যেতেই পারেন৷ তাতে কী হয়েছে? তাই বলে রোপওয়ে চড়া বন্ধ থাকবে নাকি? মানুষকে বিনোদনের সুয়োগ দেয়া হচ্ছে, সেটাই তো বড় কথা৷ নিরাপত্তার কথা এত ভাবলে চলে!

সে তো কলকাতার রাস্তায় বর্ষায় জল জমে, তাতে খোলা বিদ্যুতের তার গিয়ে পড়ে৷ মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান৷ তাই বলে বর্ষা হলে কি রাস্তায় জল জমবে না৷ না কি তারের জঙ্গলে ঘেরা কলকাতা শহরে দুই-একটা সজীব তার থাকবে না! তাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মানুষ মারা যাবে না! অত নিরাপত্তা কে দেবে, সম্ভব নাকি!

এই যে কিছুদিন আগে প্রথমে ই-স্কুটার কারখানায় আগুন লেগে তা উপরের হোটেলে ছড়িয়ে গেল, তাতে মানুষ দমবন্ধ হয়ে, আগুনে পুড়ে মারা গেলেন, তাই বলে কি ই-স্কুটারের শোরুম হবে না অথবা তার উপরে হোটেল থাকবে না! কিছুদিন আগে গুজরাটে একটি বাণিজ্যিক এলাকায় কোচিং সেন্টারে আগুন লেগে প্রচুর ছাত্রছাত্রী মারা গেলেন, তাই বলে কি কোচিং সেন্টার তুলে দিতে হবে, তাহলে বাচ্চারা পড়বে কোথায়?

তাছাড়া নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা তো নেয়া হয়৷ কোনো ঘটনা ঘটলেই তদন্ত হয়৷ তার রিপোর্ট জমা পড়ে৷ সেই অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ জারি হয়৷ সেটাই বা কম কীসের?  কেউ সেই নির্দেশ মানলো কি না, সে সব তো অন্য প্রশ্ন৷ সবসময় সরকারি কাজের, মানুষের সচেতনতা নিয়ে অত খুঁত ধরলে চলে?

এই তো ডিডাব্লিউতেই আমরা কলকাতার সব বাজার ঘুরে ছবিতে দেখিয়েছিলাম, সেখানে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা কীরকম আছে৷ বারবার কলকাতার বাজারে আগুন লাগার পরে কী সুন্দর সচেতনতা রয়েছে৷ আগুন নেভানোর ব্যবস্থার উপর ডাঁই করে রাখা জিনিস, অগ্নি নির্বাপনের যন্ত্র দেখলে মনে হয়, তার মেয়াদ কবে শেষ হয়ে গেছে, তারের জঙ্গল ঝুল-কালি মেখে আগের মতোই বিরাজমান৷ কিন্তু তাতে কী?  আগুন লাগার পর ব্যবস্থা তো নেয়া হয়েছে৷ এনিয়ে যেমন পুরসভা, বাজার কমিটি, পুলিশ ও প্রসাসন সতর্ক, তেমনই সতর্ক বাজারের বিক্রেতারা এবং সাধারণ মানুষও৷ এত সতর্ক যে তারা নিরাপত্তা নিয়ে মাথাই ঘামাতে পারেন না৷ ঘামানও না৷

অবশ্য এতে কারো কিছু যায় আসে না৷ কারণ, মানুষের প্রাণ সবচেয়ে সস্তা৷ মারা গেলে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিলেই হলো৷ খুব বেশি হলে পাঁচ লাখ৷ কারণ সরকার জানে, মহান জনগণ, মহোত্তম সংবাদমাধ্যম জানে, হইচই দুই-চার দিনই হয়৷ তার বেশি নয়৷ ফলে এনিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর দরকার নেই৷ খুব বেশি খুঁত ধরলে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, দাদারা এসে হুমকি দিতে পারে৷ তার থেকে দিব্যি চারবেলা খাচ্ছি, মাঝেমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে নিরাপদে একটু প্রতিবাদ করছি৷ মেলায় ঘুরছি, আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল তা নিয়ে তর্ক করছি, রাশিয়া-ইউক্রেন নিয়ে ধুন্ধুমার আলোচনা করছি৷ যতক্ষণ নিজের গায়ে আঁচ না লাগছে, ততক্ষণ নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার তো কোনো দরকার নেই৷ এমনকী নিজের বাড়িকে নিরাপদ রাখতেও আমাদের যত অনীহা৷ তাতে টাকা খরচ হয় যে৷ 

হাসপাতালে আগুন

স্ক্রোলডটইন ২০২০-র অগাস্ট থেকে ২০২২-এর মার্চ পর্যন্ত মিডিয়া রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছে, ২০ মাসের মধ্যে ভারতে ২৯টি হাসপাতালে আগুন লেগে ১২২ জন মারা গেছেন৷ ২৯টির মধ্যে ১২টি হাসপাতাল সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত৷

মহারাষ্ট্রে একটি হাসপাতালে আগুন লেগে ১০ জন মারা যাওয়ার পর রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, সব হাসপাতালে ফায়ার সেফটি অডিট হবে৷ সেইমতো ৪৮৪টি হাসপাতালে অডিট হয় এবং দেখা যায়, ৯০ শতাংশ হাসপাতাল দমকলের কাছ থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট বা এনওসি নেয়নি৷ হাসপাতাল চালুর আগে ফায়ার ডিপার্টমেন্ট আগুন নেভানোর ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে এবং এনওসি দেয়৷ এনওসি ছাড়া হাসপাতালগুলি চালু হয় কী করে, সেই জটিল ও কুটিল প্রশ্ন করে কী আর লাভ হবে? অপ্রতুল হাসপাতালের দেশে কিছু হাসপাতাল তো চলছে৷ তাতে নাই বা থাকলো রোগীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা৷

স্ক্রোল দিল্লি সহ দেশের হাসপাতালের অবস্থা জানতে চেয়ে তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত আবেদন জমা দেয়৷ তারা জানতে চায়, কতগুলি হাসপাতাল এনওসি ছাড়া কাজ করছে৷ কয়েকটি হাসপাতাল সাড়া দেয়৷ তাতে দেখা যাচ্ছে, চারটি কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতাল এনওসি ছাড়া বা আংশিক এনওসি নিয়ে কাজ করছে৷ এর মধ্যে দিল্লির অত্যন্ত ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ রামমনোহর লোহিয়া এবং লেডি হার্ডিঞ্জ হাসপাতাল আছে৷ চণ্ডীগড়, ভুবনেশ্বরের বড় হাসপাতাল আছে৷ চণ্ডীগড়ের হাসপাতালে তো ২০১৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৩৮৫টি আগুন লাগার ঘটনা ঘেটেছে৷ পাঁচ দশমিক ছয়দিন পরপর একবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে সেখানে৷ হতে পারে ছোট আগুন৷ কিন্তু আগুন মানে তো আগুনই৷ ছোট আগুন বড় হয়ে উঠতে আর কতক্ষণ?

জতুগৃহের মধ্যে বসবাস আমাদের৷ মাইকেল তো লিখেই গেছেন, ‘‘জন্মিলে মরিতে হবে৷ অমর কে কোথা কবে৷ চিরস্থির কবে নীর হায় মা জীবন নদে৷’’ তাই আমাদের অত নিরাপত্তা নিয়ে ভাবলে চলে না৷ ও সব খাতায় কলমে আছে, থাকবে৷ না থাকলেই বা কী হবে? কয়েকটা প্রাণ যাবে৷ সরকারের কয়েক লাখ টাকা গচ্চা যাবে৷ আমাদেরই তো করের টাকা৷ গেল না হয় কিছু৷

সড়ক দুর্ঘটনা

২০২১-এ এক লাখ ৫৫ হাজার ৬২২ জন মারা গেছেন বিভিন্ন যানের মধ্যে সংঘর্ষে এবং পথ দুর্ঘটনায়৷ এরমধ্যে দ্বিচক্রযান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬৯ হাজার ২৪০ জন৷

তারপরেও দিল্লির রাস্তায় মোটরসাইকেল আরোহীদের দেখে মনে হয়, তারা জিমন্যাস্টিক্সের খেলা দেখানোর জন্য রাস্তায় নেমেছেন৷ দুইটি গাড়ি বা ট্রাকের মাঝখানে সরু ফাঁকের মধ্যে দিয়ে গলে যাবেন, রাস্তায় একদিন থেকে অন্যদিকে সমানে ব্যালেন্সের খেলা দেখাতে দেখাতে যাবেন, কোনো নিয়ম না মেনে, লাল বাতি ভেঙে চরম গতিতে এগিয়ে যাবেন৷ অনেকের মাথায় হেলমেটও থাকে না৷ যেন মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তারা৷

দিল্লির পাশে নয়ডা, গুরুগ্রাম, গাজিয়াবাদে যান, দেখবেন খুব কম মানুষ গাড়িতে বেল্ট লাগাচ্ছেন৷ যেখানে ক্যামেরা লাগানো আছে, সেখানে গাড়ির গতি কম করছেন৷ আবার ক্যামেরা পেরিয়েই গতির বান ডাকছে৷ নিজের নিরাপত্তা, পথচারীর নিরাপত্তা, অন্য গাড়িতে থাকা মানুষের নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা তাদের নেই৷ কেউ ট্রাফিক নিয়ম মানলে তারা রক্তচক্ষু দেখান, সমানে হর্ন বাজাতে থাকেন৷ কী বলবেন এদের? এরা দিল্লির রাস্তায় চলমান বিভীষিকা৷

আইন আছে, আইনের রক্ষকেরা আছে, তাতে কী৷ নিয়ম না ভাঙলে তো নিয়মের অর্থই হয় না৷ তাই তারা যা খুশি করতে পারেন৷ দিল্লিতে গভীর রাত পর্যন্ত পার্টি করে অডি, মার্সিডিজ বা বিএমডাব্লিউ নিয়ে ভয়ঙ্কর জোরে চালাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার ডিভাইডারে বা ফুটপাথে শোয়া মানুষদের পিষে মেরে ফেলতে পারেন৷ অসুবিধা কী? প্রাণের দাম তো কয়েক লাখ টাকা মাত্র৷ সেটাও করদাতাদের পকেট থেকে যায়৷ মামলা হয়৷ তাতে জামিন পাওয়া যায়৷ প্রভাবশালীদের বাঁচার অনেক রাস্তা আছে৷ 

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

নৌকাডুবি

গত ১১ আগস্ট উত্তরপ্রদেশের বান্দাতে যমুনা নদীতে নৌকাডুবি হয়ে ২০ জন মারা গেছেন৷ তার আগের বছর সেপ্টেম্বরে উত্তরপ্রদেশে গ্রামের মেলা দেখে ফেরার সময় নৌকাডুবিতে তিনজন মারা যান৷ তার আগের বছর অন্ধ্রে নৌকাডুবিতে ৩০ জন মারা যান৷ প্রতিবছর ছোট-বড় অসংখ্য নৌকাডুবি হয়৷ কেন হয়? কারণ, পর্যটক আকর্ষক জায়গায় বোটিং করার সময় লাইফ জ্যাকেট থাকে৷ কিন্তু অন্য কোনো জায়গায় নদী পারাপার বা নৌকায় লাইফ জ্যাকেট চাইলে মাঝি হাসবে৷ তার অভিধানে লাইফ জ্যাকেট বলে কোনো বস্তু ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে কিনা সন্দেহ৷

নৌকায় ধারণক্ষমতার থেকে অনেক বেশি মানুষ উঠবেন, সেই নৌকা বর্ষাকালে উত্তাল নদী দিয়ে দুলতে দুলতে চলবে৷ গুটি কয়েক ডুবতেও পারে৷ মানুষ মারা যাবেন৷ এ আর এমন কী কথা৷ শেষ পর্যন্ত সেই তো কয়েক লাখের মামলা৷

সরকার না হয় কয়েক লাখ দিয়ে পার পেয়ে যায়, কিন্তু যে মহান অসচেতন জনগণ এভাবে নিরাপত্তাহীন হয়ে থাকেন, তারা কেন যান? কারণ, তাদের যেতে হয়৷ তাদের কথা কে আর কবে শুনেছে? একটু ভারতের গ্রামগঞ্জে গিয়ে মানবাধিকারের কথা বলুন তো, সিংহভাগ মানুষ হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন৷ গ্রিক-ল্যাটিন মনে করে চুপ করে থাকবেন৷ অসচেতন হয়ে থাকাটাই তাদের জন্মগত অধিকার৷ যে যত জানবে, সে তত চাইবে, তত প্রশ্ন করবে৷ তার থেকে এই তো ভালো৷ অসচেতন হয়ে নিরাপত্তাহীন হয়ে, ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান' বলে চিরশান্তিতে চলে যাওয়া৷ ১৩৫ কোটির দেশে কিছু মানুষ চলে গেলে, তাদের স্বজন ছাড়া কারই বা দুঃখ হয়!