মহানায়কের স্মৃতিপথে ছায়াসঙ্গী শম্ভু
২৪ জুলাই ২০১৭মহানায়কের ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাংলা চলচ্চিত্রের সেই ডাকসাইটে অভিনেতা, তথা শম্ভু ভট্টাচার্যের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায় মেতেছিল ডয়চে ভেলে৷ চিত্র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য গবেষক গোপাল দাস৷
২৪ জুলাইয়ের কথা পাড়তেই সেই দিনটায় ফিরে গেলেন ‘সন্ন্যাসী রাজার' নিতাই৷ তাঁর ঋজু স্বাস্থ্য কেড়ে নিয়েছে সময়৷ ছবির সেই দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ মানুষটির সঙ্গে আজকের শম্ভু ভট্টাচার্যকে মেলানো যায় না৷ এখন অনেকটাই শীর্ণকায়, তবে কণ্ঠস্বরের বলিষ্ঠতায় তিনি এখনও সেই চম্বলের ডাকাত লাখন সিং৷ ২৪ জুলাই এলেই সেই ফোনটা এখনও তাঁর কানে বাজে৷ উত্তমকুমার তখন হাসপাতালে ভর্তি৷ ফোন এসেছিল বাংলার আরেক দিকপাল অভিনেতা রবি ঘোষের৷ কী বলেছিলেন তিনি? শম্ভুবাবু বলেন, ‘‘রবিদা বললেন, শম্ভু শুনেছিস খবরটা? আমি বললাম, কী খবর? রবিদা বললেন, উত্তমদা আর নেই৷ কথাটা শুনেই বুক ফেটে গেল৷ রবিদা ময়রা স্ট্রিটে চলে যেতে বললেন৷ তখন রাত ১০টা বেজে গেছে৷ ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম৷ তখনই সেখানে বেশ ভিড়৷ রবিদা, তরুণদা (তরুণ কুমার) ছিলেন৷''
আর কে কে ছিলেন সেখানে? প্রবীণ স্মৃতি হাতড়ে বলেন, সবার কথা মনে পড়ে না৷ তবে সুচিত্রা সেনের ছবিটা চোখে ভাসে৷ ময়রা স্ট্রিটে পৌঁছে উত্তমদার দেহের দিকে অপলক চেয়ে ছিলেন৷ অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়াননি...৷
এ সব কথা বলতেই একতলার ঘরটায় যেন উত্তম কুমার এসে বসলেন৷ ছবিতে তখনও হাসিতে উচ্ছ্বল মহানায়ক৷ তাতেই যেন বিষাদের ঘনঘটা কেটে যাচ্ছিল৷ গোপাল দাস খেই ধরিয়ে দিলেন, ‘সন্ন্যাসী রাজা', ‘অমানুষ', ‘ধনরাজ তামাং', ‘সব্যসাচী' – এ রকম অনেক ছবিতে আপনি উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন৷ সেই গল্প আমাদের একটু বলুন না৷
এই প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধের চোখমুখ পর্দার মতো দৃপ্ত হয়ে ওঠে৷ বলেন, ‘‘কত ছবিই তো করেছি৷ ২৬-২৭টা তো বটেই৷ সব কটা ছবির নাম এখন আর মনে করতে পারি না৷ উত্তমদার সম্পর্কে বলতে গেলে কোথা থেকে শুরু করব, বুঝতে পারি না৷'' প্রবীণকে ফের খেই ধরিয়ে দিতে হয়৷ বললাম, আপনার সঙ্গে মহানায়কের প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটা বলুন৷ এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার জন্য এক মুহূর্তও ভাবতে হয় না শম্ভুবাবুকে৷ যেন এই সে দিনের ঘটনা৷ বৃদ্ধ বলেন, ‘‘তখন আমি বাগবাজারে থাকতাম৷ আমরা কয়েকজন উত্তমভক্ত মিলে ঠিক কর লাম মহানায়কের শুটিং দেখব৷ ৪-৫ জন মিলে টালিগঞ্জের এন টি ওয়ান স্টুডিওতে হাজির হলাম৷ আমরা একেবারে শুটিং ফ্লোরে চলে গেলাম৷ প্রোডাকশনের একজনকে বললাম, আমরা উত্তমবাবুর ভক্ত৷ ওঁর সঙ্গে দেখা করেই চলে যাবো৷ ভাবিনি এত সহজে তাঁর দেখা পাবো৷ খবর পেয়ে কিছুক্ষণ পর উনি ফ্লোরে এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ করলেন৷ আমরা তখন তাঁকে দেখে মুগ্ধ৷ আমাদের অবাক করে বললেন, যখন ইচ্ছে হবে, তখনই চলে আসবেন৷''
উত্তমকুমারের সঙ্গে শম্ভু ভট্টাচার্য প্রথম অভিনয় করেন ‘ছিন্নপত্র' ছবিতে৷ তখন থেকেই দু'জনের সখ্য৷ আমাদের আড্ডার ফাঁকে চলে এসেছে চা-বিস্কুট৷ উত্তমকুমারের ছবি দেয়াল থেকে নেমে তখন শম্ভুবাবুর কোলে৷ ছবিতে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে বৃদ্ধ বলেন, ‘‘দাদার জন্য বড় বড় ছবিতে আমি কাজের সুযোগ পেয়েছি৷ তাঁর কথায় পরিচালক শক্তি সামন্ত আমাকে ‘অমানুষ' ছবিতে কাজের সুযোগ দিয়েছিলেন৷ বাংলা ও হিন্দি দু'টো ভার্সানেই৷ দাদার কথায় আমি শক্তিদার কাছে গেলাম৷ পরিচালকের আমাকে পছন্দ হলো৷ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, রেমুনারেশন কত লাগবে? আমি বললাম, উত্তমদা পাঠিয়েছেন, তাই টাকা আমি নিতে পারব না৷ কিন্তু শক্তিদা নাছোড়৷ তখন আমি প্রতিদিন একটাকা করে চাইলাম৷ শক্তিদা খুশি হয়ে বললেন, আপনি সিলেক্টেড৷ আর টাকা পয়সার ব্যাপারটা আমি বুঝে নেব৷''
বয়সের সঙ্গে তারুণ্য বিদায় নিয়েছে৷ কিন্তু আড্ডার আসরে শম্ভুবাবুকে দেখে সেটা মনে হচ্ছিল না৷ মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়া, নড়বড়ে শরীরে লাঠি হাতে চলাফেরা করা প্রবীণ ৬০-৭০ দশকের তেজ যেন ফিরে পেয়েছেন৷ এমন একজন মানুষের কাছ থেকে ব্যক্তি উত্তমকুমার সম্পর্কে জানার তাগিদ থাকেই৷ সেই প্রশ্ন করতেই আবার গল্পে ফিরে গেলেন বৃদ্ধ৷ চোখদু'টো চিকচিক করে উঠল৷ বললেন, ‘‘সে তো কত ঘটনা! আমার ওপর দাদা খুব ভরসা করতেন৷ যেখানেই শুটিং হতো, দাদা পরিচালকদের বলে দিতেন, শম্ভুকে যেন আমার পাশের ঘরে থাকতে দেওয়া হয়৷ একসঙ্গে কত সুন্দর সময় কাটিয়েছি৷''
‘‘তবে ব্যক্তি উত্তমকে জানতে হলে একটা ঘটনার কথা বলতেই হয়৷ তারিখটা আমার মনে পড়ে না৷ তবে মনে পড়ে, কলকাতার একটা নার্সিংহোমে ‘সন্ন্যাসী রাজার' পরিচালক পীযূষ বসু মারা গেলেন৷ ঐ একই নার্সিংহোমে সেদিনই উত্তমদার বড় ছেলে গৌতমের মেয়ে জন্ম নিয়েছিল৷ পাবলিকের হাঙ্গামা এড়াতে অনেক রাতে দাদা নার্সিংহোমে এলেন৷ একতলায় পীযূষদাকে শেষবার দেখে দোতলায় আর নাতনিকে দেখতে যাননি৷...''
চায়ে চুমুক দিয়ে বৃদ্ধ বলে চলেন, ‘‘বাবাকে গৌতম বলল, তুমি নাতনিকে একবার দেখবে না বাবা? দাদা জবাব দিলেন, না গৌতম, আজ আমি পীযূষদাকে দেখতে এসেছি৷ নাতনিকে আজ আমি দেখতে আসিনি৷ খ্যাতির শীর্ষে থাকা এক অভিনেতা পেশাদারিত্ব ছাপিয়ে তাঁর পরিচালকের সঙ্গে কতটা জড়িয়ে পড়েছিলেন, এটাই তাঁর প্রমাণ৷ ব্যক্তিগত সম্পর্কে আমিও এই উষ্ণতা পেয়েছি৷''
প্রবীণের এই কথার রেশ ধরে গোপাল বাবু আরেক পরিচালকের কথা পাড়লেন৷ তিনি ‘ধন্যি মেয়ে', ‘অগ্নীশ্বর', ‘মৌচাক' এবং ‘নিশিপদ্ম'-র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়৷ এই ছবিগুলিতে উত্তমকুমারকে নায়কের ঘেরাটোপ থেকে বের করেছিলেন অরবিন্দ বাবু৷ সদ্যপ্রয়াত পরিচালকের জীবন ও কাজের উপর নিরন্তর গবেষণা করে চলা গোপালবাবু ব্যক্তি উত্তমের আরেকটি ছবি আড্ডায় তুলে ধরলেন৷ ‘অগ্নীশ্বর'-এর জন্য বিএফজেএ পুরস্কার পেয়েছিলেন মহানায়ক৷ কিন্তু সেই পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করেন৷ কেন? এই গল্প গোপালবাবু অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকেই শুনেছেন৷ বলেন, ‘‘মহানায়ক জানতে পারেন যে অভিনয়ের জন্য শুধু তাঁকেই পুরস্কৃত করা হচ্ছে, ছবি বা ছবির পরিচালককে পুরস্কারের জন্য বাছা হয়নি৷ এটা শুনে মহানায়ক পুরস্কার নেননি৷''
স্মৃতির সরণী ধরে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে ফিরে এলাম বর্তমানে৷ ২৪ জুলাই টিভির পর্দায় বিভিন্ন ছায়াছবি বা অনুষ্ঠানের মঞ্চে বাঙালির মহানায়ক ফিরে ফিরে আসেন৷ সে সবে চোখ রাখেন বছর তিরাশির শম্ভুবাবু৷ তাঁর স্মৃতিপটে ‘দাদা' যে আজও অমলিন৷