1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মধুপুরে ‘মায়ের মাটি'তে লেক খনন নিয়ে গারোদের উদ্বেগ

১৩ জুন ২০২২

গারোরা মধুপুর অঞ্চলকে বলেন ‘আবিমা', তাদের ভাষায় এর অর্থ ‘মায়ের মাটি৷ সেই মাটি হারানোর শঙ্কায় ক্ষোভ বাড়ছে আমতলী বাইদের গারোদের৷ সেখানে ৪৫ বিঘা কৃষি জমিতে পর্যটকদের জন্য লেক বানাতে চায় বন বিভাগ৷

https://p.dw.com/p/4CciQ
প্রতীকী ছবিছবি: Dipayan Khisa

বাইদ বলতে মধুপুর গড়ের বাসিন্দারা বনের নীচু জমিকে বোঝান৷ এক সময় এই বনের চালা বা উঁচু জমিতে জুম চাষ হত৷ বনের আগাছা পুড়িয়ে এবং লাঙল দিয়ে মাটি বিদীর্ণ না করে চাষাবাদ করা হল জুমচাষ৷

১৯৬৫ সালে আইন করে জুম চাষ নিষিদ্ধ করা হলে বনজীবীরা বাইদে  লাঙল চালিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন৷ আমতলী বাইদের অবস্থান টাঙ্গাইলের মধুপুর জাতীয় উদ্যানের দোখলা ও চুনিয়া গ্রামের মাঝামাঝি এলাকায়, ১১ নম্বর শোলাকুড়ি ইউনিয়নের পীরগাছা মৌজায়৷

ওই বাইদে জমি আছে ৪৫ বিঘা, গারো জাতিগোষ্ঠীর ১৩টি পরিবার সেখানে বংশপরম্পরায় চাষাবাদ করে আসছে৷ তাদের দাবি, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ওই জমির কাগজপত্রও আছে তাদের কাছে৷

বন বিভাগ এখন ওই জমিতে ‘স্থানীয় ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সহায়তায় মধুপুর জাতীয় উদ্যানের ইকো ট্যুরিজম উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনা' শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে লেক খননের উদ্যোগ নিয়েছে৷ গত ২২ এপ্রিল সেখানে ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল' লেখা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷

সীমানা প্রাচীরসহ আরবোরেটাম বাগান, দ্বিতল গেস্টহাউস, ভূগর্ভস্থ জলাধারসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে৷ প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় বন বিভাগের দাবি, ওই জমি ‘গারোদের নয়'৷

অন্যদিকে ধারাবাহিকভাবে এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে গারোদের বিভিন্ন সংগঠন; যে কোনো মূল্যে লেক খনন প্রকল্প প্রতিহত করার ঘোষণা দিচ্ছে তারা৷

‘‘কোনোভাবেই ফসলি জমিতে পর্যটকের প্রমোদ বিহারের জন্য লেক বানাতে দেবে না গারোরা,” বলছিলেন গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশনের (জিএসএফ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিছিল৷

তিনি বলেন, ‘‘আমতলী বাইদে জমি আছে মাত্র ১৩ জনের৷ কিন্তু লেক বানাবার বিরুদ্ধে গুটিকয়েক দালাল ছাড়া মধুপুরের সব কটি গ্রামের গারোরা লড়াইয়ে আছে৷ কোচদের কোনো জমি নেই ওই বাইদে, তবু তারাও আছেন আন্দোলনে৷ কারণ মধুপুর গড়ের বনজীবী মানুষ জানে, একটু একটু করে তাদের বন থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে৷”

১৯২৭ সালে ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অ্যাক্ট ঘোষণার সময় এক লাখ ২২ হাজার ৮৭৬ একর ভূমিতে ছিল মধুপুর গড়ের শালবন৷ এর মধ্যে মধুপুর উপজেলায় ৪৫ হাজার ৫৬৫ একর, সখীপুরে ৪৭ হাজার ২২০ একর, ঘাটাইলে ২১ হাজার ৮৫৫ একর, মির্জাপুরে সাত হাজার ৫৭৬ একর এবং কালিহাতীতে ৬৬৯ একর৷ পরে ৫৮ হাজার ২০৬ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষিত৷

বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার একরে প্রাকৃতিক বন রয়েছে৷ বেদখলে আছে প্রায় ৩৮ হাজার একর৷ সামাজিক বনায়ন করা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার একরে৷ এছাড়া রাবার বাগান করা হয়েছে ১০ হাজার একরে৷ বাকি পাঁচ হাজার একরে শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস, বিমান বাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ এবং বন গবেষণা ইন্সটিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে৷

লিয়াং রিছিলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল মধুপুরের পীরগাছা গ্রামে কৌশল্যা নকরেকের বাড়িতে৷তিনি ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিন নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, যে ১৩ জন গারো আমতলী বাইদের জমির মালিকানার দাবিদার, ছয় সন্তানের জননী ৬৫ বছর বয়সি কৌশল্যা তাদের একজন৷

মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজ ব্যবস্থায় জমির মালিক হন নারীরা৷ অবশ্য কৌশল্যার মা নড়ই নকরেক তার দুই ছেলে দিতিন ও মিঠুনকেও কিছু জমি দিয়ে গেছেন৷ এই তিন ভাইবোনই এখন আমতলী বাইদের বেশিরভাগ জমির মালিকানার দাবিদার৷ 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কৌশল্যা বলেন, "বনবিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষিত হওয়ার বহু আগে থাকতেই আবিমার জমিগুলো আমাদের ছিল৷”

গারো পুরাণ মতে, চিগেলবাড়িওয়ারীখুট্টি নামের এক জঙ্গল দ্বীপে গারোদের জন্ম৷ তারপর আবিমা, আফাল আর আরঙ্গা- এই তিন অঞ্চলে গড়ে ওঠে তাদের বসতি৷

কৌশল্যা জানান, ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জমির খাজনা দিয়েছেন তারা৷ পরে এরশাদ আমলে ১৯৮৪ সালে খাজনা নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়৷

বিভিন্ন সময়ে দেওয়া খাজনার কাগজপত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, "জমি আমাদের৷ দোখলার রেঞ্জার বাড়িতে এসে ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিলেন৷ টাঙ্গাইলের ডিসিও সবাইকে মিলিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দেবেন বলেছিলেন৷ আমরা কোনো ক্ষতিপূরণ চাই না৷ জমি চাই৷”

আমতলী বাইদের ওই তিন ফসলি জমিতে ১৩ গারো পরিবারের অধিকার বোঝাতে অজয় এ. মৃ বললেন কয়েকশ বছরের পুরনো ইতিহাসের কথা৷ স্থানীয় গারোদের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তিনি৷

অজয় বলেন, ‘‘গারোরা এই বনভূমিতে বাস করে বন বিভাগ সৃষ্টির অনেক আগে থেকে৷ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তো বটেই, তার আগেও শালবনে চাষাবাদের জন্য খাজনা দিতে হত আমাদের পূর্বপুরুষদের৷ ব্রিটিশ আমলে যখন বনটি নাটোর রাজার অধীনে আসে, তখন খাজনা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়৷ 

‘‘রাজা যোগীন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে ঊনিশ শতকে আমাদের গ্রামপ্রধানদের চুক্তি হয়৷ বনের অধিবাসীরা রায়ত হিসেবে রাজাকে খাজনা দিতে শুরু করে৷ তারা তখন জমিদারদের কাছ থেকে জমির বছর মেয়াদি পাট্টা (লিজ) এবং দীর্ঘমেয়াদি পত্তনি (লিজ) নিত৷ কিন্তু এখানকার জমি বনভূমি হিসেবে গেজেটভুক্ত এবং এলাকাটি মধুপুর জাতীয় উদ্যানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে খাজনা নেওয়া বন্ধ৷”

আমতলী বাইদে লেক বানানো ঠেকাতে আন্দোলনে থাকা গারো সংগঠনগুলোর অভিযোগ, ওই জমি থেকে গারোদের উচ্ছেদের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা জাতিসংঘের আদিবাসী ঘোষণাপত্র এবং আইএলও কনভেশনের লঙ্ঘন৷

কিন্তু বন বিভাগ ওই প্রকল্প থেকে পিছু হটতে রাজি নয়৷ বনবিভাগের দোখলা রেঞ্জ কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বলছেন, জমির জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও সুযোগ নেই৷

‘‘আমি তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে যেন বাধা না দেয়, সেই কথা বুঝিয়ে আসবার চেষ্টা করেছি৷”

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক আতাউল গণিও এর সমাধানের আর কোনো পথ দেখছেন না৷

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "বনবিভাগের দাবি, জমিটা তাদের৷ গারোদের কয়েকজনও জমির মালিকানা দাবি করছেন৷ আমি একটা সহজ সমঝোতার জন্য লাখ পাঁচেক টাকা দিতে চেয়েছিলাম৷ এখন এ নিয়ে আর আলাপের অবকাশ নেই৷”

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)-র আইনজীবী রফিক আহমেদ সিরাজী অবশ্য মনে করেন, মধুপুর শালবনের সীমানা নির্ধারণ এবং শালবনে বনবাসকারীদের প্রথাগত অধিকার নিষ্পত্তি না করে বনবিভাগ আমতলী বাইদে লেক খনন করতে পারে না৷

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক শালবন সংরক্ষণ এবং বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য ২০১০ সালে বেলা, এএলআরডিসহ কয়েকটি সংস্থার দায়ের করা রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২৮ অগাস্ট উচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ে এটা স্পষ্ট করা আছে৷ রায়ের নয় দফা নির্দেশে ১৯৫৬ এবং ১৯৮৪ সালের গেজেট নোটিফিকেশন অনুসারে শালবনের সীমানা নির্ধারণ অন্তর্ভুক্ত ছিল৷

‘‘ফলে বন এবং বনবাসীদের জমির সীমানা নির্ধারণের আগ পর্যন্ত লেক খননের মত কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থি বলে গণ্য হবে৷” বলেন আইনজীবী রফিক আহমেদ সিরাজী৷

এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য