1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভাস্কর্য বিতর্কে মূর্তির ভবিষ্যৎ

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১১ ডিসেম্বর ২০২০

ভাস্কর্য নিয়ে চলমান বিতর্কে মূল প্রশ্ন- ভাস্কর্য আসলে মূর্তি কিনা৷ কেউ বলছেন ভাস্কর্য মূতি নয়, আবার কেউ কেউ বলছেন যা ভাস্কর্য তা-ই মূর্তি৷

https://p.dw.com/p/3mZZj
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য
ছবি: bdnews24

এই বিতর্কের শুরু ঢাকার ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে৷

কেউ কেউ সেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন৷ যারা এখন ভাস্কর্যকে মূর্তি বলছেন তারা হালে পানি পেলে এক ধাপ এগিয়ে দেব-দেবী বা ধর্ম প্রচারকদের মূর্তি ভাঙারও দাবি তুলতে পারেন৷ বাংলাদেশে ইসালামি ওয়াজে কিছু মাওলানা মূর্তি নিয়ে যেসব কথা বলেন সেসব শুনে এমন শঙ্কাই জাগে বলে তাদের দাবি৷

হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়েজি দাবি করেন, ‘‘ভাস্কর্য আর মূর্তি একই৷ তাই মানুষসহ যে-কোনো প্রাণীর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলতে হবে৷’’ ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমানেরও একই মত৷

তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষণ অ্যাকাডেমির পরিচালক মাওলানা মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান সিকদার বলেন, ‘‘যদি স্মরণ করা বা দেখানোর জন্য বানানো হয়, তাহলে তা ভাস্কর্য আর এবাদতের জন্য বানানো হলে তা মূর্তি৷’’ তবে তার মতে, এটা নিয়ে বিতর্ক আছে৷ মিশরের ইসলামি চিন্তাবিদরা মনে করেন, এবাদতের জন্য না হলে সেটা ভাস্কর্য ৷ কিন্তু বাংলাদেশসহ আরো অনেক দেশের আলেমদের বড় একটা অংশ মনে করেন, এটা থেকে পূজার বাসনা জাগতে পারে, তাই ভাস্কর্যকে তারা মুসলমানদের জন্য ‘অনুমোদন’ করেন না৷

অনেক মুসলিমপ্রধান দেশে ভাস্কর্য আছে, তাই বলে সেটা বৈধ হয়ে যায় না: ফরিদ উদ্দিন মাসউদ

এ প্রসঙ্গে শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, ‘‘কোনো প্রাণীর মূর্তি হলো শিরক৷ এটা কোনোভাবেই মুসলমানরা করতে পারবে না৷ ভাস্কর্য মূর্তির বাইরে কিছু নয়৷ অনেক মুসলিমপ্রধান দেশে ভাস্কর্য আছে, তাই বলে সেটা বৈধ হয়ে যায় না৷ মদ খাওয়া ইসলামে হারাম৷ তারপরও তো অনেক মুসলমান মদ খায়৷ তবে অবয়ব বাদ দিয়ে তর্জনি বা অন্য কোনো অংশের ভস্কর্য করা যায়৷ তাতে ইসলাম বাধা দেয় না৷’’ তাই বলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রসঙ্গে তার মতামত, যেটা হয়েছে সেটা থাক৷

এই বিতর্কে সংখ্যালঘুদের ওপর কি চাপ বাড়তে পারে? মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, ‘‘ইসলামে অন্য ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে৷ তাই হিন্দু বা অন্য ধর্মের মূর্তি ভাঙার প্রশ্নই ওঠে না৷’’ আর মাওলানা মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান সিকদার বলেন, ‘‘যারা ওয়াজে সব ধরনের মূর্তি ভেঙে ফেলার কথা বলেন, তারা আসলে না বুঝে বলেন৷ অন্য ধর্মের মূর্তি থাকবে৷’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান বলেন, ‘‘যাদের ধর্মে আছে তারা যার যার উপাসনালয়ের ভিতরে মূর্তি রাখতে পারবেন৷’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ের মূর্তি আগে ভাঙা হয়েছে, চলমান বিতর্কের পরও ভাঙা হতে পারে৷ তবে তিনি মনে করেন সাধারণ মানুষ এর সম্পূর্ণ বিপক্ষে, ‘‘এই বিতর্কের মধ্যে হিন্দুদের মূর্তির ওপরও হামলা হবে কিনা সেই আশঙ্কার প্রশ্ন ওঠার আগে থেকেই তো  হিন্দুদের ওপর হামলা হচ্ছে৷ মূর্তি ভাঙা তো নতুন কিছু নয়৷ ফলে তাদের মূর্তির ওপর হামলা হতে পারে৷ কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অসাম্প্রদায়িক৷ তারা সেটা মানবে না৷’’

ভাস্কর্য নান্দনিকতার বিষয়, এর সাথে পূজা বা এবাদতের কোনো সম্পর্ক নেই: অধ্যাপক হামিদুজ্জামান খান

‘‘আমরা দম্ভ করে কাউকে কাউকে বলতে দেখি, এটা মুসলমানদের দেশ৷ এটা যারা বলেন, তারা সংবিধানবিরোধী কথা বলেন৷ এখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ কিন্তু দেশটা সবার৷’’ বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য৷
তার মতে, ‘‘ভাস্কর্য হলো ইতিহাস, ঐতিহ্য৷ আমরা বইয়ে ইতিহাস পড়ি আর ভাস্কর্যে তা দেখি৷ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস৷ এটা আমাদের বুঝতে হবে৷ আর মূর্তি হলো কোনো ধর্মাবলম্বীদের উপাসনার জন্য৷ যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে মূর্তি বলে তা অপসারণের দাবি তোলে তাদের আসল উদ্দেশ্য ভিন্ন৷ তারা বঙ্গবন্ধুবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী৷’’

তবে মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের মতে, ‘‘ভাস্কর্য ও মূর্তি আলাদা করার যে চেষ্টা করা হচ্ছে, সে কারণে মূর্তি চাপে পড়তে পারে৷ চাপে পড়া অসম্ভব কিছু নয়৷ তবে তাদের উদ্দেশ্য মাওলানাদেরও চাপে রাখা৷’’

ভাস্কর্যের কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক এবং ঐতিহসিক দিক আছে৷ ভাস্কর্য শিল্পকলার অন্যতম প্রধান শাখা৷ এটা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে বহুকাল ধরে৷ বাংলাদেশেও আছে এর দীর্ঘ ঐতিহ্য৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক হামিদুজ্জামান খান বলেন, ‘‘ভাস্কর্য হলো নান্দনিকতার বিষয়৷ এর সাথে পূজা, প্রার্থনা বা এবাদতের কোনো সম্পর্ক নেই৷ এটা যেকেনো বিষয় নিয়ে হতে পারে৷ মানুষ বা প্রাণীর ফিগার নিয়েও ভাস্কর্য হয়৷ ফাইন আর্টস-এর দুইটি মাধ্যম, একটা ছবি এবং আরেকটি ভাস্কর্য৷ একটি সাধারণ চেয়ার ভাস্কর্য নয়৷ কিন্তু সেটাকে যখন ভিন্ন ফর্মে উপন্থাপন করে নতুন একটি মেসেজ দেয়া হবে, তখন সেটা ভাস্কর্য৷’’ তার কথায়, ‘‘মূর্তি যাকে বলা হয় তার মধ্যেও যদি নান্দনিকতার প্রকাশ থাকে, তাহলে তা-ও ভাস্কর্য৷’’
‘‘নান্দনিকতা যখন মানুষ শিখলো তখন সভ্য হলো৷ ভাস্কর্য সভ্যতারই অংশ,’’ বললেন এই ভাস্কর৷