ভাসমান ক্ষেতে টিকে থাকতে চাচ্ছেন বাংলাদেশের কৃষকরা
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের কৃষকরা টিকে থাকতে এক সনাতনী পন্থা বেছে নিয়েছেন: পানিতে ভাসমান ক্ষেত তৈরি করছেন তারা৷ দেশটির বন্যাপ্রবণ এলাকার কিছু ব্যতিক্রমী ছবি ডয়চে ভেলেকে পাঠিয়েছেন ইয়াকোপো পাসোত্তি৷
স্বর্গে অনিশ্চয়তা
গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র নদী বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলিত হওয়ার আগ অবধি এক উর্বর ব-দ্বীপ গড়েছে৷ নদী দু’টি হিমালয় থেকে যে পলি বয়ে আনছে তা ব-দ্বীপটিকে করে তুলেছে কৃষিকাজের জন্য আদর্শ অঞ্চল৷ তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের হার এবং প্রতাপ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশের কৃষকরা৷
কৃষিকাজের বদলে অন্যকিছুর সন্ধান
নোনা জলের প্রকোপে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে একসময়ের উর্বর জমি৷ কৃষকরা তাই কৃষিকাজের বদলে অন্যকিছু করার পরিকল্পনা করছেন৷ কেউ কেউ শহর এলাকায় পশ্চিমাদের জন্য পোশাক তৈরির কারখানাগুলো স্বল্পবেতনের চাকুরি নিচ্ছেন৷ অন্যরা নোনাজলে চিংড়িচাষ বেছে নিচ্ছেন, তাও অবশ্য ইউরোপের বাজারের জন্য৷ তবে চিংড়িচাষ ব-দ্বীপটির উপকূলীয় অঞ্চলের ধ্বংস আরো ত্বরান্বিত করছে৷
ঐতিহ্যগত প্রযুক্তি
কিছু পরিবার অবশ্য আরো ঐতিহ্যগত এবং পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর পন্থার দিকে এগুচ্ছে৷ আর সেটা হচ্ছে কচুরিপানার মতো জলজ উদ্ভিদ এবং খড় ব্যবহার করে তৈরি ভাসমান ক্ষেত৷ বাংলা ব-দ্বীপের কৃষকরা এভাবে শতশত বছর ধরে কৃষিকাজ করছেন৷ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই পন্থার ব্যবহার বাড়ছে৷
নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করেন
ভাসমান ক্ষেত তৈরি করতে নারী এবং পুরুষরা একসঙ্গে কাজ করেন৷ পিরোজপুরের এই কৃষক ক্ষেতে বোনার বীজ সাজাচ্ছেন৷
জৈব এবং পুর্নব্যবহারযোগ্য
ভাসমান ক্ষেতে নানারকম শাক, ঢেড়শ, লাউ, বেগুন, কুমড়া এবং পেঁয়াজ চাষ করা যায়৷ পানির উপরে ভাসার কারণে সেগুলো কীটপতঙ্গ থেকে দূরে থাকে৷ আর এ ধরনের ক্ষেতে আলাদা করে কোন রাসায়নিক সারও প্রয়োগ করতে হয় না৷ প্রতিটি ভাসমান ক্ষেত তিনমাসের মতো টিকে থাকে৷ এরপর সেটিকে ডাঙ্গায় তুলে শুকনো ক্ষেতে সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়৷
ভাসমান ক্ষেতের জন্য আদর্শ কচুরিপানা
শুধু বাংলাদেশ নয়, আমাজন জঙ্গলসহ বিশ্বের নানাপ্রান্তে কচুরিপানার দেখা মেলে৷ ভাসমান ক্ষেত তৈরির জন্য এই কচুরিপানাকেই আদর্শ মানছেন বাংলাদেশের কৃষকরা৷ কেননা, এটি নোনাজলের মধ্যেও টিকে থাকতে পারে৷ এবং অনেক কচুরিপানা একত্রে ভাসলে সেটি প্রাকৃতিকভাবেই একটি ভাসমান কাঠামোতে পরিণত হয়৷ এরপর তাতে কিছুটা পরিবর্তন ঘটিয়ে এবং বাড়তি কিছু যোগ করে ভাসমান ক্ষেত বানিয়ে নেয়া যায়৷
জীবন বাঁচিয়েছিল কচুরিপানা
হরিপদ এবং তাঁর পরিবার ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় বড় এক কচুরিপানার ভেলায় দু’মাস জীবনযাপন করেছিলেন৷ ‘‘মানুষ একপাশে ছিল, অন্যপাশে গৃহপালিত পশু৷ এমনকি আমরা সেই ভেলায় রান্না করেছি এবং ঘুমিয়েছি,’’ বলেন তিনি৷ বর্ষীয়ান এই কৃষক মনে করেন, ঋতুগুলো বদলে গেছে৷ আগের চেয়ে বৃষ্টি এখন বেশি হয়৷
পানি সরিয়ে থেকে জমি উদ্ধার
ব-দ্বীপের বাসিন্দা কোথাও কোথাও পানিতে হারিয়ে যাওয়া জমি আবার পুর্নউদ্ধারও করছেন৷ নাজির বাজারের এই গ্রামটি একসময় পানির নীচে তলিয়ে গিয়েছিল৷ পরবর্তীতে সেখানে মাটি ফেলে এবং খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে কৃষি উপযোগী জমি এবং বাসস্থানের স্থান তৈরি করা হয়েছে৷
বৃষ্টি কখন হবে?
নাজির বাজারের এক কৃষক আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার বৃষ্টি কখন হবে তা বোঝার চেষ্টা করছেন৷ পানিতে মাটি ফেলে তৈরি কৃষিজমিতে উৎপাদিত কলা নৌকায় করে বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি৷ সেখানকার খালগুলো যোগাযোগের নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করে৷ নৌকায় করে শিশুরা স্কুলে যায় এবং কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে নিয়ে যায়৷
মানিয়ে নিতে শেখা
নাজির বাজারের কৃষক গিয়াসউদ্দিন সর্দার গত কয়েকবছের তারা আবাস বদলে যেতে দেখেছেন৷ তবে, ভবিষ্যত সম্পর্কে এখনো আশাবাদী তিনি৷ কেননা, তাঁর এলাকার মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে শিখেছে৷ ‘‘আমাদের সামনে যাই আসুক — নদী, খাল, বৃষ্টি, বন্যা — আমরা পরিবর্তিত পরিবেশের মধ্যে টিকে থাকতে শিখেছি,’’ বলেন তিনি৷