1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতের রাজনীতিতে শিষ্টাচার প্রায় শেষ

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
১০ ডিসেম্বর ২০২১

ভারতে রাজনীতিবিদরা হামেশাই শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন করেছেন এবং করছেন।

https://p.dw.com/p/445bz
ভারতে রাজনীতিবিদরা হামেশাই শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন করেছেন এবং করছেন।
ছবি: picture-alliance/dpa/STR

ঘটনাটা ১৯৯৯ সালের। সেই সময়ের দাপুটে বিজেপি নেতা এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী প্রমোদ মহাজন বলে বসলেন, সোনিয়া গান্ধী যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, তাহলে মনিকা লিউইনস্কিই বা পারবেন না কেন? মোনিকা লিওনেস্কি মানে অ্যামেরিকার  প্রেসিডেন্ট থাকার সময় বিল ক্লিন্টন যার সঙ্গে  যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছিলেন। প্রমোদ যখন এই কথা বলছেন, তার এক বছর আগে সোনিয়া ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। ওই বছরই তিনি আমেঠি ও বল্লারি থেকে লোকসভা নির্বাচনে জিতবেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর স্ত্রী এবং কংগ্রেস সভানেত্রীর বিরুদ্ধে এই ধরনের মন্তব্য করে বিতর্কের ঝড় তুলে দিয়েছিলেন প্রমোদ মহাজন। একজন শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় নেত্রীর সঙ্গে ক্লিন্টনের সঙ্গে কেলেঙ্কারিতে জড়ানো মনিকা লিউইনস্কির তুলনা করে শিষ্টাচারের সীমারেখা পার করেছিলেন প্রমোদ।

সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। প্রমোদ ছিলেন তার খুবই ঘনিষ্ট নেতা। কিন্তু বাজপেয়ী প্রকাশ্যে জানিয়ে দেন, ব্যক্তিগত আক্রমণ করা উচিত নয়। তারপর তিনি প্রমোদকে ক্ষমা চাইতে বলেন। নেতার নির্দেশ মেনে ক্ষমা চান প্রমোদ। অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিশেষত্ব ছিল, তিনি সচরাচর কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেন না। শুধু বাজপেয়ী কেন, সিপিআইয়ের ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সিপিএমের জ্যোতির্ময় বসু, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়রাও ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, ইস্যু নিয়ে আক্রমণে ফালাফালা করে দিতেন বিপক্ষকে। তারও আগে গেলে জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেলরা নিষ্ঠাভরে এই কাজ করে গেছেন। নেহরু তো একবার বেনামে কাগজে একটা প্রবন্ধই লিখে বসলেন। তাতে বললেন, নেহরুর হাতে এতটাই ক্ষমতা এবং বিরোধীরা এতটাই কমজোর যে, তার স্বৈরাচারী হওয়ার ষোলোআনা সম্ভাবনা আছে। নেহরুর পুতি রাহুল গান্ধী এই উদাহরণটা তুলে দিয়ে বলেছিলেন, নেহরু এই কাজটা করেছিলেন নিজের মধ্যে ওই প্রবণতা যাতে না আসে, তার জন্য।

তবে নেহরুর সময় তো কবেই চলে গেছে। তার মেয়ে ইন্দিরার সময়ই দেখা গেল এই শিষ্টাচার লঙ্ঘনের ভুরি ভুরি উদাহরণ।  ইন্দিরা কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট করেছিলেন আসামের ধারভারহীন নেতা দেবকান্ত বড়ুয়াকে। তিনি বলে বসলেন, ‘‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা’’। স্তাবকতা যে শিষ্টাচারের মাত্রা কীভাবে ছাড়িয়ে যায়, তার উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন দেবকান্ত। একজন ব্যক্তি, তিনি যতই ক্ষমতাশালী হোন না কেন, তিনি যে দেশের সমান হতে পারেন না, দেশ মানে যে কোনো ব্যক্তি নয়, তা দেবকান্ত জানতেন না এমন নয়, কিন্তু নেত্রীকে তুষ্ট করতে গিয়ে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আবার জরুরি অবস্থার পর ইন্দিরা গান্ধী বিরোধীদের কাছে হয়ে গেলেন 'ডাইনি'। কোনো সন্দেহ নেই, জরুরি অবস্থা জারি করে ইন্দিরা গান্ধী চরম গণতন্ত্রবিরোধী কাজ করেছিলেন। সেই অমার্জনীয় কাজের জন্য দেশের মানুষই তাকে শাস্তি দিয়েছিল নির্বাচনে গো-হারান হারিয়ে। কিন্তু তখন বিরোধীরা যে বাছা বাছা বিশেষণ ইন্দিরার প্রতি নিক্ষেপ করেছিলেন, তা অনেক সময়ই শিষ্টাচারসম্মত ছিল না।

তারপর যত সময় গেছে, ততই রাজনীতিতে ব্যক্তিগত আক্রমণ প্রবল হয়েছে, তা অনেক সময়ই শিষ্টাচারের সীমা পার করেছে। ২০১৭ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর বিতর্কের জবাব দিতে গিয়ে বলেছিলেন, মনমোহন সিং ৩৫ বছর ধরে ভারতের আর্থিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই সময়ে এত কেলেঙ্কারি হয়েছে। কিন্তু তার গায়ে কোনো দাগ লাগেনি। একমাত্র তিনিই জানেন, বাথরুমে রেনকোট পরে কীভাবে স্নান করতে হয়। এটা হলো ব্যজস্তুতি, যেখানে বক্রোক্তি ও শ্লেষের ভাব জড়িয়ে থাকে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বর্তমন প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তি কতটা শোভনীয় তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছিল।

রাহুল গান্ধী যখন কংগ্রেস সভাপতি তখন তাকে বিজেপি 'পাপ্পু' বলে ডাকতে শুরু করে। এটাও শিষ্টাচার বহির্ভূত একটি সম্বোধন। প্রধান বিপক্ষ দলের নেতার প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখানো উচিত। রাহুল রাজনীতিতে আসার পর একাধিক অপরিণত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বা ব্যবহার করেছেন। সেই বিষয়ে সমালোচনা করা এক আর তাকে সরাসরি পাপ্পু বলে সম্বোধন করা আরেক কথা।

আসলে রাজনীতিকদেরও সংযমের  শিক্ষা থাকা উচিত। কিন্তু তারা তা দেখান কোথায়? সংসদের এক তৃতীয়াংশ আসন যখন নারীদের জন্য সংরক্ষণের জন্য বিল এনেছে ইউপিএ সরকার, তখন শরদ যাদবের মতো প্রবীণ নেতা বলেছিলেন, এর ফলে 'বালকাটি' নারীরা সুবিধা পাবেন। মানে যে সব নারীরা চুল ছোট করে কাটেন, অর্থাৎ উচ্চবিত্ত ফ্যাশনদুরস্ত নারীরা সুবিধা পাবেন। পরে এ জন্যও ক্ষমা চাইতে হয়েছিল শরদ যাদবকে। প্রণব মুখোপাধ্যায়-পুত্র অভিজিত তো একবার এক শ্রেণির নারীকে 'ডেন্টেন্ট পেন্টেড' বলে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গেও এ রকম উদাহরণের অভাব নেই। বিধান রায়ের আমলে মন্ত্রী নলিনী সরকার মারা গেছেন। বিধানসভায় স্পিকার শোকপ্রকাশের জন্য সকলকে দাঁড়াতে বললেন। বিধানসভায় তখন সম্ভবত ২৬ জন বাম বিধায়ক ছিলেন। তাদের নেতা জ্যোতি বসু। তিনি জানিয়ে দিলেন, তারা দাঁড়াবেন না। কারণ, রাজনৈতিক মতবিরোধ আছে, আদর্শগত তফাৎ আছে। পরে সম্ভবত বুঝেছিলেন, এই আচরণ ভুল হয়েছে। তাই আর তার পুনরাবৃত্তি করেননি তারা।  বিধান রায়ের আমলে কংগ্রেসের দাপুটে নেতা ছিলেন অতুল্য ঘোষ। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জেলে বন্দি অতুল্য ঘোষ পুলিশের অত্যাচারে এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান। তাকে বিরোধীরা ডাকতেন কানা অতুল্য বলে। এটা কোন ধরনের শিষ্টাচার?

বাম নেতাদের মধ্যে বিনয় কোঙার সব সীমা পার করে দিয়েছিলেন। তিনি মেধা পাটকরের বিরুদ্ধে দলের নারী সমিতির সদস্যদের বলেছিলেন পশ্চাতদেশ প্রদর্শন করতে। আরেক বাম নেতা অনিল বসুও কম যান না। তিনি বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চুলের মুঠি ধরে সিঙ্গুর থেকে সরিয়ে দেয়া উচিত ছিল।

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক গুরু সদ্যপ্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাকে ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ বলেছিলেন। এই শিষ্টাচারহীন উক্তি সেসময় ভাইরাল হয়েছিল। কিছুদিন আগে ভোটের প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রধানমন্ত্রী মোদীকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে আসার কথা বলেছেন। অমিত শাহকে বলেছেন হোঁদলকুতকুত। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্পর্কে এই ধরনের উক্তিও অনায়াসে শিষ্টাচারের সীমা পেরিয়ে যায়।

যত দিন যাচ্ছে, ততই শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘনের ঘটনা নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখন নিউজ টেলিভিশনে সব চেয়ে প্রিয় প্রশ্ন হলো, ওই নেতা এই কথা বলেছেন, আপনি কী বলবেন? সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় রাজনীতিকদের বক্তব্য। তাতে আর লাগাম থাকে না। বিপক্ষকে যতটা কঠোরভাবে, যতটা রঙ্গব্যাঙ্গের চাবুক মেরে ধুইয়ে দেয়া যায়, ততই নাকি আমজনতা খুশি, দলের নেতৃত্ব খুশি। এত সহজে যদি সকলকে খুশি করা যায়, তাহলে সেই পথ কেনই বা নেবেন না রাজনীতিকরা! শিষ্টাচারকে এর জন্য বলি দিতে হলে দেয়া যাবে। আর সেই কবে থেকেই তো শেখানো হয়, যুদ্ধে জেতার জন্য কোনো নীতি থাকে না। রাজনীতিও তো যুদ্ধ। তাহলে সেখানেও নীতির বালাই কেন থাকবে? এই মনোভাবই রাজনীতিকে সমানে নীচে নামিয়ে দিচ্ছে। সেখান থেকে চলে যাচ্ছে শিষ্টাচার, নৈতিক মূল্যবোধ এবং মানুষের আস্থাও। রাজনীতিতে শিষ্টাচারের অবস্থা এখন বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণীর মতো। এখনই সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করলে তাকে আর বাঁচানো যাবে না। 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান