ভারতে মানবপাচারবিরোধী আইন: বন্ধ হবে যৌনপল্লি?
১৮ জুলাই ২০২১সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় এরিমধ্যে পাশ হয়েছে মানবপাচার রোধ, সুরক্ষা ও পুনর্বাসন বিল৷ এখন সেটি রাজ্যসভায় পাশের অপেক্ষা৷ রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করলেই তা আইন বলে গণ্য হবে৷ তবে আইনটি এমন কিছু ধারা আছে যা বাস্তবায়ন হলে যৌনকর্মীদের এই পেশায় থাকা কঠিন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা সমাজকর্মীদের৷ বন্ধ হয়ে যেতে পারে যৌনপল্লিগুলোও৷ এজন্য আইন পাশের আগে সব দিক খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন তারা৷
বিপদের আশঙ্কা যৌনকর্মীদের
সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর মানবপাচার নিয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে ভারতে মানবপাচারের প্রকটতার চিত্র উঠে এসেছে৷ অতিমারির কালে তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী, একদিকে যেমন শিশুশ্রমের জন্য পাচার হচ্ছে, তেমনি যৌন কারবারের জন্যেও পাচারের শিকার অনেকে৷
অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ ওঠে, জোরপূর্বক নারীদের যৌন পেশায় বাধ্য করা হয়৷ এ বিষয়ে মানবপাচার বিরোধী আইন ততটা কঠোর ছিল না৷ তাই শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে ট্র্যাফিকিং পার্সনস (প্রিভেনশন, প্রোটেকশন, রিহ্যাবিলেটশন) বিল ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে৷ এই আইনে সুরক্ষা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে৷ কিন্তু যৌনকর্মীদের জন্য তা উল্টো আশঙ্কার কারণ হিসেবে দেখছেন তাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো৷
দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির অ্যাডভোকেসি অফিসার মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা একেবারেই যৌনকর্মীদের স্বার্থবিরোধী৷ এই বিলের মাধ্যমে যৌনকর্মীদের পেশাটাকেই অস্বীকার করার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে৷ পাচার রোখার নাম করে যৌনপল্লিগুলি উচ্ছেদ করার আশঙ্কা করছি৷”
তাদের সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গে নথিভুক্ত যৌনকর্মীর সংখ্যা ৬৫ হাজার৷ অনথিভুক্তদের নিয়ে সংখ্যাটা দেড় লাখ৷ মহাশ্বেতা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ৯৫ শতাংশ মেয়েই কাজটা জেনেবুঝে করতে আসছে৷ পরিবার ভরণপোষণের জন্য তারা এ কাজে আসেন৷ সেলফ রেগুলেটরি বোর্ড তৈরি হয়েছে, যাতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে এই পেশায় আসতে না হয়৷ কিন্তু এই ক্ষেত্রে (নতুন আইনে) ধরে নেওয়া হবে যে এই এলাকায় নারী মানেই পাচার হয়ে এসেছে৷’’
পুনর্বাসনের কী হবে
এই আইন কার্যকর হলে কি পাচার কমে যাবে? নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ বলেন, ‘‘অতিমারিতে দারিদ্র্য আরও বেড়েছে৷ বিশেষ করে শিশু ও মেয়েদের মধ্যে স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে৷ ফলে প্রশাসনের চেষ্টায় আইন দিয়ে পাচার বন্ধ হবে বলে মনে হয় না৷ আইন কার্যকর করতে হলে একটা সংগঠিত প্রয়াসে পাচারের তদন্ত করতে হবে৷”
পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে নয়া বিলে ‘হোমকেই’ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ এমনকি সঙ্গে শিশুসন্তান থাকলে তারও ঠাঁই হবে ‘হোম’-এ৷ শাশ্বতী বলেন, ‘‘এখন রি-ট্র্যাফিকিং একটা বড় সমস্যা৷ যে মেয়েদের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, সামাজিক স্বীকৃতির অভাবে তারা যেনতেন প্রকারেণ আবার ওই পরিবেশে ফিরে যেতে চায়৷ পুনর্বাসন হলেও তারা আগের জীবনের মতো স্বাধীনতা, সম্মান পাচ্ছে না৷’’
এদিকে পুনর্বাসন কেন্দ্র বা হোম পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি, যৌন নিগ্রহের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হয়৷ একের পর এক ঘটনায় রাজ্যের লিলুয়া, গুড়াপ, বা বেহালায় দৃষ্টিহীনদের হোমে যৌন নিগ্রহের ঘটনা উঠে এসেছে৷ এরপরেও কি হোমে পুনর্বাসন কখনো পরিবারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে? প্রশ্ন তুলেছেন সমাজকর্মীরা৷ বরং তারা বিকল্প কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিতে বলছেন৷
যৌনকর্মীদের একাংশের মতে, কেন্দ্রীয় সরকার আসলে যৌন পেশাকেই অস্বীকার করতে চায়৷ অপরাধী তকমা দিতে চাইছে৷ তাই এই বিল পাস হলে পুলিশি জুলুমও বাড়বে৷ এই আইন পাশ করানোর আগে বিশদ আলোচনা চাইছেন যৌনকর্মীদের নিয়ে আন্দোলনকারীরা৷ ইতিমধ্যে ১৭ রাজ্যের সমাজকর্মী, সংগঠনের প্রতিনিধিরা নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকে আইন পাশের আগে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মতামত নেওয়ার আর্জি জানিয়েছে৷ মহাশ্বেতা বলেন, ‘‘একটা জনগোষ্ঠী যখন উঠে দাঁড়াতে চাইছে, সন্তান মানুষ করার দায়িত্ব নিচ্ছে, তাহলে পাচারের নাম করে তাদের অপরাধী বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে কেন?’’
২০২০ সালের জুলাইর ছবিঘর দেখুন...