1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতীয় গণতন্ত্র, নরেন্দ্র মোদী এবং রাহুল গান্ধী

শুভাশিস মৈত্র, সাংবাদিক
শুভাশিস মৈত্র
৩১ মার্চ ২০২৩

রাহুল গান্ধীকে যদি শেষ পর্যন্ত জেলেই যেতে হয়, যদি সত্যিই এমন হয় যে, দু'বছরের জেল এবং তার পর আরও ছ'বছরের জন্য তাকে ভোটে দাঁড়ানো থেকে দূরে সরে থাকতে হবে, তাতে ভারতের গণতন্ত্রের জয়জয়কার শোনা যাবে না দেশে বা বিদেশে

https://p.dw.com/p/4PWux
নির্বাচনী বক্তৃতায় মোদী পদবী নিয়ে ‘আপত্তিকর' মন্তব্য করায় রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন এক বিজেপি নেতা
নির্বাচনী বক্তৃতায় মোদী পদবী নিয়ে ‘আপত্তিকর' মন্তব্য করায় রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন এক বিজেপি নেতা

যা ঘটে চলেছে তাতে বিষয়টির ‘ক্যাপশন' ক্রমেই নরেন্দ্র মোদী বনাম রাহুল গান্ধী, থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, হয়ে উঠছে স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতি বনাম ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্র৷

এই ঘটনা এমন একটা সময় ঘটছে যখন ইজরায়েল তোলপাড় হচ্ছে, গণতন্ত্রের কয়েকটি মূল শর্তকে বাঁচাতে৷ নির্বাচিত সরকারের বিচার ব্যবস্থাকে পোষ মানানোর উদ্যোগের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়ে  আপাতত সে দেশের মানুষ নেতানিয়াহু সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে৷ গত এক বছরে আমরা দেখেছি কী ভাবে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তাকেই বেছে নিয়েছেন  নাগরিকরা কখনও শ্রীলঙ্কায়, কখনও ইরানে, কখনও ফ্রান্সে, কখনও এমনকি চিনেও৷ আমাদের দেশেও আমরা এমন দেখেছি, শহিনবাগে বা বছরভর অবস্থান করে কৃষকদের নিজেদের দাবি আদায় করতে৷ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাস্তার আন্দোলন জন্ম নেয় তখন, যখন আলাপ-আলোচনার পথ দুর্গম হয়ে ওঠে৷ সংসদে কোণঠাসা হয়ে পড়েন বিরোধীরা৷ যখন নির্বাচিত সরকার বিরোধীদের কথা সংখ্যার জোরে উড়িয়ে দেয়৷ তখন রাস্তাই হয়ে ওঠে গণসংসদ৷ ভারতকে এই পথ অবশ্য প্রথম দেখিয়েছেন ‘সত্যাগ্রহ' আন্দোলনের জন্মদাতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী৷ রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে  পাঁচ মাসের যে ভারত জোড়ো যাত্রা, সেটাও ছিল এমনই এক কর্মসূচি৷

রাহুল গান্ধীকে এই নির্বাসনে পাঠানোর  ‘শাস্তি' কোনও ব্যতিক্রম নয়৷ বিরোধী নেতাকে নানা কারণে জেলে ভরে দেওয়া বা জেলে পাঠানোর চেষ্টা করা নতুন কিছু নয়৷ গত দুই দশকে যে সব দেশের বিরোধী নেতাদের বিভিন্ন সময়ে জেলবন্দি করা হয়েছে বা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে (তাদের কেউ কেউ হয়তো পরে ছাড়াও পেয়েছেন, কেউ এখনও পাননি) তার মধ্যে রয়েছেন, শ্বেতলানা টিখানভস্কায়া, পলাতক বেলারুশের বিরোধীনেত্রী ৷ তাঁকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷ নিকারাগুয়ার ছয় বিরোধী নেতা, ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁদের জেলে পাঠানো হয়৷ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ‘জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ‘ করেছেন৷ লিওপোলডো লোপেজ, ভেনিজুয়েলার বিরোধীনেতা, তাঁকে ১৪ বছরের জন্য জেলে পাঠিয়েছে সেই দেশের সরকার৷ তিনি হিংসায় উসকানি দিয়েছেন, এই ‘অপরাধে'৷ ইথিওপিয়ার আরেক বিরোধীনেতা আন্দারাগাচু জিগে, ‘সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা' এই অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে বেশ কয়েক বছর জেলে ছিলেন৷ তবে শেষ পর্যন্ত নানা মহলের চাপে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে৷

একই ভাবে দু'বছরের জন্য জেলে যেতে হয়েছিল কুয়েতের বিরোধী নেতা মুসল্লম আল বারাককে৷ কারণ সরকারের সমালোচনা৷ মালয়েসিয়ার বিরোধীনেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে জেলে যেতে হয়েছিল৷ কারণ বলা হয়েছিল তিনি ‘অস্বাভাবিক যৌনতায়' বিশ্বাস করেন৷ এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে বিশ্ব জুড়ে৷ এই তালিকায় রাহুল গান্ধীর নামও জুড়বে কিনা তা বোঝা যাবে আর কিছু দিনের মধ্যেই৷

এই সব ঘটনার বেশিরভাগই আসলে গণতন্ত্রের পিছু হটার গল্প৷ গণতন্ত্র কি সারা পৃথিবীতেই সমস্যায় আছে? দেবেশ কাপুর এবং মিলন বৈষ্ণভ তাঁদের বই ‘কস্ট অফ ডেমোক্র্যাসি' তে লিখছেন ২০০০ সাল থেকে ২০১৫, এই সময়ের মধ্যে ২৭টি দেশ হয় গণতন্ত্র থেকে সরে এসেছে বা সেই সব দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে৷ তার পরবর্তি সময়ের তথ্য অবশ্য হাতে নেই, তবে আন্তর্জাতিক সংস্থা ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ‘ইলেক্টোরাল অটোক্র্যাসি'র অধীনে থাকা দেশের তালিকাটাই সব থেকে বড়৷ 

এতক্ষণ যা বলা হল, সেটা হল রাহুল গান্ধী বিষয়ে বৃহত্তর রাজনীতির কথা৷ কিন্তু রাহুল গান্ধীকে অপরাধী ঘোষণা করা এবং তাঁর সদস্য পদ খোয়ানো, এই দুই ঘটনার একটি বড় তাৎক্ষণিক তাৎপর্যও রয়েছে৷ সেটা ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে৷ 

নির্বাচনী বক্তৃতায় মোদী পদবী নিয়ে ‘আপত্তিকর' মন্তব্য করায় রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা (ক্রিমিনাল ডেফেমেশন কেস) করেছিলেন এক বিজেপি নেতা৷ এটা প্রায় চার বছর আগের ঘটনা৷ ওই বিজেপি নেতার অভিযোগ, মোদী পদবী ওবিসিদের হয়৷ রাহুল ওবিসিদের অপমান করেছেন৷ যদিও তথ্য হিসেবে এটা ঠিক নয়৷ মোদী পদবী ব্রহ্মণদেরও হয়৷ রাহুল গান্ধী ওই বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন কর্নাটকে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে৷ ঘটনা কর্নাটকে হলেও মামলা করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য গুজরাটে৷ তার পর থেকে সেই মামলা বলা যায় আরও লক্ষ লক্ষ মামলার মতোই ঘুমিয়ে ছিল৷

কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জয়রাম রমেশ (দলের কমিউনিকেশন হেড) বলেছেন, গত ৭ ফেব্রুয়ারি সংসদে রাহুল গান্ধী আদানি প্রসঙ্গ তোলেন৷ ঠিক তার ন'দিন বাদে ১৬ ফেব্রুয়ারি ওই বিজেপি নেতা, যার উপাধি মোদী এবং যিনি ওবিসি নন, একজন ব্রাহ্মণ, তিনি হাইকোর্টে গিয়ে ওই মামলার উপরে থাকা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করেন৷ মজার কথা হল যে ওই স্থগিতাদেশ, সেটা তিনিই অতীতে চেয়েছিলেন, এবার তিনিই সেটা প্রত্যাহারের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হলেন৷ এবং তা পেলেনও৷ ২৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছিল সেই রাহুল মামলার শুনানি৷ শুনানি দ্রুত শেষ হল এবং ২৩ মার্চ রাহুলকে দোষী সাব্যস্ত করল আদালত৷ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সংসদের সচিবালয় জানিয়ে দিল রাহুল আর সাংসদ নন৷

তিন বারের মুখ্যমন্ত্রী, দু'বারের প্রধানমন্ত্রী অতীব দক্ষ নেতা নরেন্দ্র মোদীর থেকে এখনও রাহুলের অবস্থান জনপ্রিয়তার নিরিখে খুবই তলানিতে৷ ঠিকই, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু হয় না৷ আবার এটাও ঠিক, যদি সত্যি রাহুলকে দু'বছরের জন্য জেল খাটতে হয় এবং ছ'বছরের জন্য ভোটে তিনি দাঁড়াতে না পারেন, তাহলে কোথাকার জল কোথায় গড়াবে, এখনই বলা কঠিন৷ কংগ্রেস নেতাদের আশা, উচ্চ আদালতে এই রায় টিকবে না৷ তেমন যদি হয়ও, এই আঘাত কি রাহুলকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দিল? তার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷ মনে রাখতে হবে রাহুল একজন শহিদের পুত্র৷ এই পরিচয় সবসময়ই রাহুলের ক্ষেত্রে একটা বাড়তি গুরুত্ব যোগ করে৷

রাহুলের এবং কংগ্রেসেরও যেটা বড় আসুবিধার দিক সেটা হল ভোটে একের পর এক হার৷ এবছর এখনও পর্যন্ত তিনটি রাজ্যে ভোট হয়েছে, তিনটিতেই কংগ্রেসের ফল গোহারা৷ সামনেই কর্নাটকের ভোট৷ এখানে কংগ্রেসের জয়ের সম্ভাবনা আছে৷ কিন্তু মোদী-শাহের দোর্দণ্ড প্রচারের মুখে কংগ্রেস কতদূর সফল হবে তা নিয়ে সংশয়ও আছে৷ কংগ্রেস যদি কর্নাটক জেতে, তাদের মনোবল বাড়বে৷ আর যদি উল্টোটা হয়, সর্ব ভারতীয় ক্ষত্রেই কংগ্রেসের গুরুত্ব আরো কমে যাবে৷ একটা ব্যাপার ঘটছে৷

শুভাশিস মৈত্র, সাংবাদিক
শুভাশিস মৈত্র, সাংবাদিকছবি: Subhasish Maitra

রাহুল যে ভাবে কোণঠাসা হয়েছেন, তা দেখে রাজ্যে রাজ্যে বিরোধীদলের নেতা-নেত্রীরা কিছুটা বিস্মিত৷ এবং আজ রাহুল, কাল কে? এই প্রশ্নও হয়তো উঠেছে৷ দেখা যাচ্ছে অন্তত এই মুহূর্তে, রাহুলের পিছনে প্রায় সব দলই এসে দাঁড়িয়েছে, এখনও পর্যন্ত সেই ছবিটা স্পষ্ট৷ ভবিষ্যতে যে সেটা ঝাপসা হবে না, তা অবশ্য এখনই বলা কঠিন৷

এটা ঠিক যে রাহুল গান্ধী জনপ্রিয়তায় বহু পিছিয়ে নরেন্দ্র মোদীর থেকে৷ আবার এটাও ঠিক, রাহুল গান্ধীই দেশের একমাত্র বিরোধী নেতা যিনি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং কার্যকলাপের বিপরীতে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে চলেছেন৷ তার মতে, ‘ঘৃণার বাজারে প্রেম বিলোতে এসে' হয়তো কোথাও বেশি বলে ফেলেছেন, হয়তো কোথাও বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন, হয়তো কোথাও অনভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু বিরোধী পরিসরে দেশে যত নেতা-নেত্রী আছেন, তাদের প্রত্যেকের মধ্যে, তাঁর শিরদাঁরাই সব থেকে সোজা, তাঁর মাথাটাই সব থেকে উঁচু, অন্তত এই মুহূর্তে৷ নেহরু-গান্ধী পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মের এই নেতাকে কিছু দিন আগেও যতটা এলে-বেলে মনে হচ্ছিল, ভারত জোড়ো যাত্রার পর কিন্তু অনেকটাই পরিণত রাহুলকে আমরা দেখতে পাচ্ছি৷ ভারতীয় গণতন্ত্রের সুস্বসাস্থ্যের জন্য অন্যতম শর্ত হল একজন উঁচু মাপের বিরোধী নেতা৷ আর এই ব্যাপারে রাহুলই এখনও পর্যন্ত বাকিদের থেকে এগিয়ে৷ সেই অর্থে কংগ্রেসের পরবর্তী পদক্ষেপগুলির দিকে শুধু কংগ্রেস সমর্থকেরা তাকিয়ে নেই৷ দেশের বহু মানুষও তাকিয়ে আছেন৷

আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতে বসবে জি-২০-র বৈঠক৷ ওই সময়ে সারা পৃথিবীর একটা বড় অংশের নেতা-নেত্রীরা আসবেন ভারতে৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতকে ‘মাদার অফ ডেমোক্র্যাসি' বিশ্ব গণতন্ত্রের জননী হিসেবে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরতে চাইছেন৷ এরকম একটা সময়ে যদি বিদেশি রাষ্ট্রনায়করা দেখেন ভারতের বিরোধী নেতা কারাগারে বন্দি, তাতে কি ভারতের সম্মান বাড়বে?বিদেশিদের কাছে সঠিক বার্তা যাবে? সফল হবে কি ‘মাদার অফ ডেমোক্র্যাসি' প্রকল্প? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু বিজেপিকেই দিতে হবে৷