বয়স বাড়ালেই কর্মসংস্থান বাড়বে না
১১ জুন ২০২১বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি তৈরি পোশাক খাত বিকশিত হয়েছে সস্তা শ্রমকে পুঁজি করেই৷ বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার আরেক মানদণ্ড বৈদেশিক মূদ্রার উপচেপড়া রিজার্ভ৷ সেই রিজার্ভের ভান্ডার ফুলে-ফেঁপে উঠেছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সে৷ ছোট্ট দেশ, বেশি মানুষ৷ জনসংখ্যাকে বোঝা না বানিয়ে জনসম্পদে রূপান্তরের স্লোগান অনেকদিনের৷ সেই স্লোগানের পথ ধরে দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্বদ্যিালয় মিলিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে, বেড়েছে কারিগরি শিক্ষার নানা সুযোগও৷ সব মিলিয়ে দেশে এখন শিক্ষিত এবং দক্ষ বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত৷ করোনা মহামারির সময়ে বেকারত্বের হার আরো বেড়েছে৷ তরুণ প্রজন্ম পড়াশোনা শেষ করে, নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলে কাজের বাজারে ঢোকার অপেক্ষায় আছে, এটা যে কোনো দেশের জন্য, যে কোনো অর্থনীতির জন্য সুখবর হতে পারতো৷ কিন্তু আমাদের সেই দক্ষ তারুণ্যকে ধারণ করার সক্ষমতা নেই৷ ফলে চাপ বাড়ছে চাকরির বাজারে৷ কাজের জন্য তৈরি হয়ে বসে থাকা তরুণরা কাজ না পেলে, বঞ্চিত হলে ক্ষুব্ধ হয়৷ তাই তো কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন হয়, চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা বাড়ানোর আন্দোলন হয়৷ তাতে বেকার তরুণরা লাফিয়ে যোগ দেয়, বিক্ষোভ করে৷
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মানসিকতা একটা বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বহুদিন ধরে৷ মেয়েদের একটু পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়ে দাও আর ছেলে সন্তান পড়াশোনা করে একটা ভালো চাকরি করবে এবং সংসারের হাল ধরবে৷ নারী শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে অনেক অগ্রগতি হয়েছে বটে৷ তবে চাকরির নিশ্চিন্তির ভাবনা থেকে এখনো বেরুতে পারিনি আমরা৷ এক সময় অভিভাবকদের প্রথম পছন্দ সন্তানকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানানো৷ তবে এই ভাবনায় বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে৷ বেতন, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সুযোগ-সুবিধা দারুণভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকারি চাকরি, বিশেষ করে বিসিএস এখন সবার পছন্দের শীর্ষে৷ বিসিএস এখন যেন সোনার হরিণ৷ এমনকি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররাও এখন বিসিএস দিয়ে প্রশাসক হতে চান৷ গত কয়েক বছরে বিসিএসে আবেদনের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে৷ আবেদনের সংখ্যা বাড়লেও পদ তো আর সে তুলনায় বাড়েনি৷ তাই চাকরির বাজারে এখন তীব্র প্রতিযোগিতা৷
চাকরির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে না বাড়লেও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে৷ ‘চাকরি করবো না, চাকরি দেবো' এই স্লোগানও ইদানীং জনপ্রিয়তা পাচ্ছে৷ কেউ কেউ সফলও হচ্ছেন৷ তবে চাকরি দেয়ার মতো উদ্যোক্তা হতে যে ঝুঁকি নিতে হয়, তা অনেকে নিতে চান না, চাকরিতেই নিশ্চিন্তি খোঁজেন সবাই৷ এখানেও আমাদের মানসিকতা একটা বৃত্তে আটকে আছে৷ বিমানবন্দর পার হলেই আমরা সবধরনের কাজ করতে প্রস্তুত৷ কিন্তু দেশে ফিরলেই আমরা মনে মনে জমিদার বনে যাই৷ মালয়েশিয়ার রাবার বাগানে বা সৌদি আরবের মরুভূমিতে কাজ করা শ্রমিকের অর্থে দেশে তার ভাইয়েরা অট্টালিকা বানায়৷ লন্ডনে যে হোটেলে বাসন মাজে, দেশে ফিরে সে নিজের বাসন মাজাটাকে অসম্মানের মনে করে৷ নিউইয়র্কের রাস্তায় যে ট্যাক্সি চালায়, ঢাকায় সে উবার চালানোকেও মর্যাদাহানির মনে করে৷ মাথার ভেতরে গেঁথে থাকা মর্যাদার ট্যাবুটা ভাঙতে পারলে আমাদের বেকারত্বের সমস্যা অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব৷ জমিজমা বিক্রি করে যত টাকা ব্যয় করে আমরা বিদেশ যাই, সেখানে গিয়ে যে অমানবিক পরিশ্রম করি; সেই টাকায় দেশে সেইরকম পরিশ্রম করলে বিদেশের চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করা সম্ভব৷ বড় বড় স্টার্টআপের কথা বাদ দিন, গ্রামে নিজের জায়গায় ছোটখাটো ফার্ম করলেও স্বচ্ছল জীবনযাপন করা সম্ভব৷ কদিন আগে একটি পত্রিকায় শিরোনাম দেখলাম, ‘বিদেশে উচ্চশিক্ষা, দেশে ফিরে দুগ্ধ খামারি'৷ বগুড়ার তরুণ তৌহিদ পারভেজ নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে দুধের খামার করেছেন৷ মাত্র ১০ বছরে এখন তিনি সফল উদ্যোক্তা৷ তিনি নিজে চাকরি করেন না, অনেককেই চাকরি দিয়েছেন৷ চাইলে এমন অনেক তৌহিদ পারভেজের গল্প পাওয়া যাবে৷ একজন শিক্ষিত তরুণ যদি কৃষি বা খামারের প্রচলিত ধারণার সাথে তার নিজের জ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তির সম্মিলন ঘটান, তবে তার সফল হওয়ার সুযোগ অনেক বেড়ে যায়৷ ইদানীং আউটসোর্সিং করেও অনেকে স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছেন৷ তথ্য প্রযুক্তি খাতেও এখন অনেক কাজের সুযোগ৷ শুধু নিজের মেধা আর শ্রমে সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে৷
তবে এসবই ছোটখাটো ব্যক্তি উদ্যোগের গল্প৷ বিপুল সংখ্যার বেকারের জন্য চাই বড় উদ্যোগ, কাজের বিশাল ক্ষেত্র৷ আর সেজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে, নীতি সহায়তা দিতে হবে৷ আমরা অনেকদিন ধরেই অর্থনীতির জিডিপিকেন্দ্রিক অগ্রগতিতে আত্মতুষ্টিতে ভূগছি৷ কিন্তু টেকসই উন্নয়নের জন্য জিডিপির সমান্তরালে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে৷ এবারও বাজেটের আগে কর্মসংস্থান নিয়ে অনেক কথা হয়েছে৷ কিন্তু বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটেনি৷ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এবারের বাজেট ব্যবাসাবান্ধব৷ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা যখন উৎপাদনে যাবেন, তখন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে৷ এভাবেও নিশ্চয়ই হবে, তবে বেকারদের জন্য আরো অনেক বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে৷
আগেই বলেছি, কাজের জন্য তৈরি হয়ে বসে থাকা তরুণরা কাজ না পেলে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা কখনো কোটা বাতিলের দাবিতে, কখনো চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করে৷ আমি এই আন্দোলনের আবেগের সাথে দ্বিমত পোষণ করি না৷ কিন্তু আমার কাছে এই আন্দোলন অনেকটা স্বার্থপরের মতো মনে হয়৷ আমরা কিন্তু কাজের ক্ষেত্র বাড়ানোর আন্দোলন করছি না৷ আন্দোলন করছি, চাকরিটা যেন আমি পাই, সে দাবি তে৷ কোটা থাকলেও যতজন চাকরি পাবেন, না থাকলেও ততজনই পাবেন৷ চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা বাড়ালে যতজন চাকরি পাবেন, না বাড়ালেও ততজনই পাবেন৷ যারা পাবেন, তাদের সবাইও বাংলাদেশের এবং নির্দিষ্ট মানদণ্ডে মেধাবীও৷ তবুও আমরা আন্দোলন করি ন্যায্য দাবি আদায়ে৷ এই ন্যায্যতার প্রশ্নে আমি ষোলআনা একমত৷
একসময় এই অঞ্চলে সরকারি চাকরিতে ঢোকার সর্বোচ্চ বয়স ছিল ২৫ বছর৷ স্বাধীনতার উষালগ্নেই তা বাড়িয়ে ২৭ বছর করা হয়৷ তবে সেশনজটসহ নানা বিবেচনায় ১৯৯১ সালে তা বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়৷ তবে সময় বদলেছে অনেক৷ বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন অনেক বেড়ে গেছে৷ প্রতিটি মানুষের জীবনের কাজের সময়ও বেড়েছে৷ তাই কাজ শুরুর সময়টাও বাড়ানো যেতে পারে৷ বিশেষত করোনা মহামারির কারণে গত দেড়বছরে কাজের ক্ষেত্র অনেক সঙ্কুচিত হয়েছে৷ তাই চাকরির জন্য লাইন আরো লম্বা হয়েছে৷ তাই চাকরির প্রবেশের বয়স সাময়িকভাবে হলেও ২ বছর বাড়ানো যেতে পারে৷ প্রত্যেকটা মানুষ যেন তার পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার মতো সময়টা পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে৷ একজন মানুষও যেন চাকরিতে ঢোকার লড়াইয়ে শামিল হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়৷ লড়াইয়ে সে জিতবে না হারবে, সেটা তার যোগ্যতা ও দক্ষতায় নির্ধারিত হবে৷ তবে লড়াই করার জন্য একটা সমান ময়দান আর যৌক্তিক সময় তার ন্যায্য দাবি৷
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, চাকরিতে ঢোকার বয়স বাড়ালেও চাকরির সুযোগ বাড়বে না৷ আগে হয়তো রহিম চাকরিটা পেতো, এখন করিমেরও পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে৷ তবে করিম পেলে রহিম পাবে না৷ আমাদের লড়াইটা হলো, যাতে রহিম, করিম সবাই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ পায়৷ সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে৷ জনসংখ্যাকে সত্যিকার অর্থেই সম্পদে পরিণত করতে হবে৷