1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বয়স বাড়ালেই কর্মসংস্থান বাড়বে না

প্রভাষ আমিন
১১ জুন ২০২১

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা কী? বিপরীতমুখী দুটি প্রশ্নেরই অভিন্ন উত্তর- জনসংখ্যা৷ বিপুল জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জপ্রায় বাংলাদেশ৷ সংখ্যাধিক্যের কারণেই বাংলাদেশে শ্রম খুব সস্তা৷

https://p.dw.com/p/3um9N
Bangladesch Dhaka Eid al-Fitr Fest Verkehr Fähre
ছবি: Harun-Or-Rashi/Zuma/picture alliance

বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি তৈরি পোশাক খাত বিকশিত হয়েছে সস্তা শ্রমকে পুঁজি করেই৷ বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার আরেক মানদণ্ড বৈদেশিক মূদ্রার উপচেপড়া রিজার্ভ৷ সেই রিজার্ভের ভান্ডার ফুলে-ফেঁপে উঠেছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সে৷ ছোট্ট দেশ, বেশি মানুষ৷ জনসংখ্যাকে বোঝা না বানিয়ে জনসম্পদে রূপান্তরের স্লোগান অনেকদিনের৷ সেই স্লোগানের পথ ধরে দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্বদ্যিালয় মিলিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে, বেড়েছে কারিগরি শিক্ষার নানা সুযোগও৷ সব মিলিয়ে দেশে এখন শিক্ষিত এবং দক্ষ বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত৷ করোনা মহামারির সময়ে বেকারত্বের হার আরো বেড়েছে৷ তরুণ প্রজন্ম পড়াশোনা শেষ করে, নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলে কাজের বাজারে ঢোকার অপেক্ষায় আছে, এটা যে কোনো দেশের জন্য, যে কোনো অর্থনীতির জন্য সুখবর হতে পারতো৷ কিন্তু আমাদের সেই দক্ষ তারুণ্যকে ধারণ করার সক্ষমতা নেই৷ ফলে চাপ বাড়ছে চাকরির বাজারে৷ কাজের জন্য তৈরি হয়ে বসে থাকা তরুণরা কাজ না পেলে, বঞ্চিত হলে ক্ষুব্ধ হয়৷ তাই তো কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন হয়, চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা বাড়ানোর আন্দোলন হয়৷ তাতে বেকার তরুণরা লাফিয়ে যোগ দেয়, বিক্ষোভ করে৷

বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মানসিকতা একটা বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বহুদিন ধরে৷ মেয়েদের একটু পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়ে দাও আর ছেলে সন্তান পড়াশোনা করে একটা ভালো চাকরি করবে এবং সংসারের হাল ধরবে৷ নারী শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে অনেক অগ্রগতি হয়েছে বটে৷ তবে চাকরির নিশ্চিন্তির ভাবনা থেকে এখনো বেরুতে পারিনি আমরা৷ এক সময় অভিভাবকদের প্রথম পছন্দ সন্তানকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানানো৷ তবে এই ভাবনায় বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে৷ বেতন, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সুযোগ-সুবিধা দারুণভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকারি চাকরি, বিশেষ করে বিসিএস এখন সবার পছন্দের শীর্ষে৷ বিসিএস এখন যেন সোনার হরিণ৷ এমনকি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররাও এখন বিসিএস দিয়ে প্রশাসক হতে চান৷ গত কয়েক বছরে বিসিএসে আবেদনের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে৷ আবেদনের সংখ্যা বাড়লেও পদ তো আর সে তুলনায় বাড়েনি৷ তাই চাকরির বাজারে এখন তীব্র প্রতিযোগিতা৷

চাকরির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে না বাড়লেও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে৷ ‘চাকরি করবো না, চাকরি দেবো' এই স্লোগানও ইদানীং জনপ্রিয়তা পাচ্ছে৷ কেউ কেউ সফলও হচ্ছেন৷ তবে চাকরি দেয়ার মতো উদ্যোক্তা হতে যে ঝুঁকি নিতে হয়, তা অনেকে নিতে চান না, চাকরিতেই নিশ্চিন্তি খোঁজেন সবাই৷ এখানেও আমাদের মানসিকতা একটা বৃত্তে আটকে আছে৷ বিমানবন্দর পার হলেই আমরা সবধরনের কাজ করতে প্রস্তুত৷ কিন্তু দেশে ফিরলেই আমরা মনে মনে জমিদার বনে যাই৷ মালয়েশিয়ার রাবার বাগানে বা সৌদি আরবের মরুভূমিতে কাজ করা শ্রমিকের অর্থে দেশে তার ভাইয়েরা অট্টালিকা বানায়৷ লন্ডনে যে হোটেলে বাসন মাজে, দেশে ফিরে সে নিজের বাসন মাজাটাকে অসম্মানের মনে করে৷ নিউইয়র্কের রাস্তায় যে ট্যাক্সি চালায়, ঢাকায় সে উবার চালানোকেও মর্যাদাহানির মনে করে৷ মাথার ভেতরে গেঁথে থাকা মর্যাদার ট্যাবুটা ভাঙতে পারলে আমাদের বেকারত্বের সমস্যা অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব৷ জমিজমা বিক্রি করে যত টাকা ব্যয় করে আমরা বিদেশ যাই, সেখানে গিয়ে যে অমানবিক পরিশ্রম করি; সেই টাকায় দেশে সেইরকম পরিশ্রম করলে বিদেশের চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করা সম্ভব৷ বড় বড় স্টার্টআপের কথা বাদ দিন, গ্রামে নিজের জায়গায় ছোটখাটো ফার্ম করলেও স্বচ্ছল জীবনযাপন করা সম্ভব৷ কদিন আগে একটি পত্রিকায় শিরোনাম দেখলাম, ‘বিদেশে উচ্চশিক্ষা, দেশে ফিরে দুগ্ধ খামারি'৷ বগুড়ার তরুণ তৌহিদ পারভেজ নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে দুধের খামার করেছেন৷ মাত্র ১০ বছরে এখন তিনি সফল উদ্যোক্তা৷ তিনি নিজে চাকরি করেন না, অনেককেই চাকরি দিয়েছেন৷ চাইলে এমন অনেক তৌহিদ পারভেজের গল্প পাওয়া যাবে৷ একজন শিক্ষিত তরুণ যদি কৃষি বা খামারের প্রচলিত ধারণার সাথে তার নিজের জ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তির সম্মিলন ঘটান, তবে তার সফল হওয়ার সুযোগ অনেক বেড়ে যায়৷ ইদানীং আউটসোর্সিং করেও অনেকে স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছেন৷ তথ্য প্রযুক্তি খাতেও এখন অনেক কাজের সুযোগ৷ শুধু নিজের মেধা আর শ্রমে সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে৷

তবে এসবই ছোটখাটো ব্যক্তি উদ্যোগের গল্প৷ বিপুল সংখ্যার বেকারের জন্য চাই বড় উদ্যোগ, কাজের বিশাল ক্ষেত্র৷ আর সেজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে, নীতি সহায়তা দিতে হবে৷ আমরা অনেকদিন ধরেই অর্থনীতির জিডিপিকেন্দ্রিক অগ্রগতিতে আত্মতুষ্টিতে ভূগছি৷ কিন্তু টেকসই উন্নয়নের জন্য জিডিপির সমান্তরালে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে৷ এবারও বাজেটের আগে কর্মসংস্থান নিয়ে অনেক কথা হয়েছে৷ কিন্তু বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটেনি৷ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এবারের বাজেট ব্যবাসাবান্ধব৷ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা যখন উৎপাদনে যাবেন, তখন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে৷ এভাবেও নিশ্চয়ই হবে, তবে বেকারদের জন্য আরো অনেক বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে৷

Bangladesch Probhash Amin
প্রভাষ আমিন, সাংবাদিকছবি: DW/S. Hossain

আগেই বলেছি, কাজের জন্য তৈরি হয়ে বসে থাকা তরুণরা কাজ না পেলে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা কখনো কোটা বাতিলের দাবিতে, কখনো চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করে৷ আমি এই আন্দোলনের আবেগের সাথে দ্বিমত পোষণ করি না৷ কিন্তু আমার কাছে এই আন্দোলন অনেকটা স্বার্থপরের মতো মনে হয়৷ আমরা কিন্তু কাজের ক্ষেত্র বাড়ানোর আন্দোলন করছি না৷ আন্দোলন করছি, চাকরিটা যেন আমি পাই, সে দাবি তে৷ কোটা থাকলেও যতজন চাকরি পাবেন, না থাকলেও ততজনই পাবেন৷ চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা বাড়ালে যতজন চাকরি পাবেন, না বাড়ালেও ততজনই পাবেন৷ যারা পাবেন, তাদের সবাইও বাংলাদেশের এবং নির্দিষ্ট মানদণ্ডে মেধাবীও৷ তবুও আমরা আন্দোলন করি ন্যায্য দাবি আদায়ে৷ এই ন্যায্যতার প্রশ্নে আমি ষোলআনা একমত৷

একসময় এই অঞ্চলে সরকারি চাকরিতে ঢোকার সর্বোচ্চ বয়স ছিল ২৫ বছর৷ স্বাধীনতার উষালগ্নেই তা বাড়িয়ে ২৭ বছর করা হয়৷ তবে সেশনজটসহ নানা বিবেচনায় ১৯৯১ সালে তা বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়৷ তবে সময় বদলেছে অনেক৷ বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন অনেক বেড়ে গেছে৷ প্রতিটি মানুষের জীবনের কাজের সময়ও বেড়েছে৷ তাই কাজ শুরুর সময়টাও বাড়ানো যেতে পারে৷ বিশেষত করোনা মহামারির কারণে গত দেড়বছরে কাজের ক্ষেত্র অনেক সঙ্কুচিত হয়েছে৷ তাই চাকরির জন্য লাইন আরো লম্বা হয়েছে৷ তাই চাকরির প্রবেশের বয়স সাময়িকভাবে হলেও ২ বছর বাড়ানো যেতে পারে৷ প্রত্যেকটা মানুষ যেন তার পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার মতো সময়টা পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে৷ একজন মানুষও যেন চাকরিতে ঢোকার লড়াইয়ে শামিল হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়৷ লড়াইয়ে সে জিতবে না হারবে, সেটা তার যোগ্যতা ও দক্ষতায় নির্ধারিত হবে৷ তবে লড়াই করার জন্য একটা সমান ময়দান আর যৌক্তিক সময় তার ন্যায্য দাবি৷

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, চাকরিতে ঢোকার বয়স বাড়ালেও চাকরির সুযোগ বাড়বে না৷ আগে হয়তো রহিম চাকরিটা পেতো, এখন করিমেরও পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে৷ তবে করিম পেলে রহিম পাবে না৷ আমাদের লড়াইটা হলো, যাতে রহিম, করিম সবাই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ পায়৷ সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে৷ জনসংখ্যাকে সত্যিকার অর্থেই সম্পদে পরিণত করতে হবে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য