1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বৈষম্যের দেশে সব নিগ্রহই ‘ঠাট্টা’

Fatema Abedin, Intern, DW Bangla section.
ফাতেমা আবেদীন
১ এপ্রিল ২০২২

আমার এক খালা (মায়ের খালাতো বোন) তার নাম কালা মা৷ ফর্সা ধবধবে বোন আর মায়ের সংসারে তার ত্বকেই একটু মেলালিন বেশি ছিল বলে তার নাম হয়ে যায় কালা মা৷

https://p.dw.com/p/49KAd
Symbolbild | Bodyshaming
ছবি: Klatt/IMAGO

বিশ্বাস করুন আমার এই ৪০ বছর বয়সে তাকে কাউকে নাম ধরে ডাকতে দেখিনি৷ আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তাকে কালামা বলেই ডেকেছে৷ হয়তো কোনো একটা নাম ছিল যেটা আমরা কেউ জিজ্ঞাসা করিনি৷ হয়তো তার স্কুলে ডাকতো সেই নামে কিন্তু তার নিজের মা, ভাই-বোন, আমরা স্বজনরা এই নামেই জেনেছি তাকে৷ কেউ হয়তো মহিমান্বিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো সেতো বলে গায়ের লোক’-গানটা গেয়েছেন৷ কিন্তু সেও তাকে আলাদা কালো বলেই ডেকেছেন, তাই না৷

আরেক খালার নাম ছিল বুচি৷ নাকটা একটু থ্যাবড়ানো ছিল বলে সারা বাড়ি, পাড়া সবাই নির্বিশেষে বুচি বলেই ডাকতো তাকে৷ আমরাও বুচি খালামনি বলেই ডেকেছি৷ তার মাকে সবাই বলতো বুচির মা৷ খুব গভীরভাবে চিন্তা করলে ঘটনাটা ভীষণ নির্মম লাগে৷ তবে যে পরিবেশের কথা বলছি সেখানে খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় এটি৷ বরং কাউকে এইসব গায়ের রঙ, শারীরিক অবয়ব, অবস্থা পরিপার্শ্ব নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের প্রতিবাদে কিছু বলবেন- তখন তারা এটা ঠাট্টা বলে উড়িয়ে দেবে৷

এই ঠাট্টার দেশে, আপনার চলন-বলন, পোশাক-আশাক সব কিছু নিয়ে নিত্য শেইমিং হবে৷ একটু খেয়াল করে বিজ্ঞাপনগুলো দেখবেন৷ বড় বড় পণ্য কোম্পানির বিজ্ঞাপনগুলোতে অনায়াসে একজনকে বেকুব বানানো হয়, তবে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহারকারীরা সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও স্মার্ট এবং সেরা বলেই প্রতীয়মান হয়৷ এই সংস্কৃতি বহু পুরানো৷ ছোটবেলায় পড়া বাগধারা ও প্রবাদ প্রবচন পড়েছিলেন? সেখানে ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’- প্রবাদটা নিশ্চয় মনে আছে? কিংবা গোবরে পদ্মফুল, অথবা বানরের গলায় মুক্তোর হার, কিংবা তালপাতার সেপাই? এগুলোর ব্যাখ্যা ভাবুন তো একবার- যে মানুষটা পৃথিবীর আলো দেখতে পায় না, কেউ জন্মান্ধ, কেউ পৃথিবীতে আসার পর অন্ধ হয়েছে তার নাম পদ্মলোচন হতে পারবে না৷ পদ্মের মতো চোখ কী তার হতে পারে না?

আর ‘গোবরে পদ্মফুল’ কী হতে পারে না? উইকিপিডিয়ায় ‘গোবরে পদ্মফুল’ বাগধারাটির ব্যাখ্যা তুলে ধরছি- ‘পদ্ম ফুলের জন্ম পুকুরের/জলাধারের গভীরে৷ সেখানে গোবর থাকা অসম্ভব৷ তাই এই উপমা ব্যবহৃত হয়৷ যেমন: মুচির ছেলে ডাক্তার হলে গোবরে পদ্মফুল উপমা ব্যবহার করা যায়৷’– আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং তথ্যভাণ্ডার আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে মুচির ছেলে ডাক্তার হতে পারবে না৷ এটি অসম্ভব বিষয়৷ এটা কতবড় অবজ্ঞা বা শেইমিং কেউ ভেবেছেন কখনো?

বানরের গলায় মুক্তোর হারের ব্যাখ্যা অযোগ্য ব্যক্তির হাতে দামী উপহার হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হয় দম্পতির অসঙ্গতি তুলে ধরতে৷ আপনার পার্টনারের সঙ্গে রূপে-গুণে সব দিক থেকে মিলতে হবে, কারও বিন্দুমাত্র অসঙ্গতি সমাজ মেনে নেবে না৷ তাকেই শুনতে হবে এই বাক্য৷  

আসলে এই দেশের দেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য৷ সেই দেশে বডিশেমিং বা বর্ণ বৈষম্য নিয়ে লড়াই করাটা আমার নিতান্ত বোকামি বলেই মনে হয়৷

রবিউলের কথা মনে আছে? অসম্ভব শুকনা ছিলেন বলে লোকটাকে ইনক্রেডিবল হালকের সঙ্গে মিলিয়ে কত তামাশা করে আমরা লোক হাসিয়েছি৷ আমাদের টিআরপির সেরা প্রোগ্রামেই এই বডি শেমিং হয়েছে৷ উচ্চতায় কম বামুন এক চরিত্র ছিল হাস্যরসের আরেক উপাদান৷

আপনি মোটা, মেদভুরি আছে তাহলে কমিক চরিত্রে আপনিই পারফেক্ট৷ আপনাকে নিয়ে বড় টিভি শোতে কৌতুকের নাম দিয়ে হবে তামাশা- গান লেখা হবে ‘তুই কোন দোকানের চাল খাস ভোটকা সুন্দরী৷’

মাথায় চুল না থাকলে তো আর কথাই নেই৷ মিডিয়া লুফে নিবে টাক মাথায় চাটি মারার জন্য৷ আর আশেপাশের লোকজন তবলা, টাকলু, আয়না, চান্দি ছিলা এগুলো বলবে৷ নিতান্ত মাথা ন্যাড়া করতে আমরা কত কতবার শুনেছি ‘ন্যাড়া মাথা চার আনা, চাবি দিলে ঘুরে না’৷ আসলেই থেমে যেতাম এইসব তির্যক বাক্যবানে৷ আট বছর বয়সী আমার ন্যাড়া হলে অন্যায়টা কোথায় ছিল যে চাটি মারতে হবে৷ খুব কান্না পেত সেসময়৷

আইডিয়াল স্কুলের সেই ছেলেটার কথা মনে আছে? মোটু মোটু বলে ডাকতে ডাকতে বন্ধুরা তাকে মেরেই ফেললো৷

আমার স্বচক্ষে দেখা একটা ঘটনা বলি- এক শিক্ষার্থী স্কুলের প্রোগ্রামে নেচেছিল৷ সে মোটা হওয়ায় তার নাচ নিয়ে শিক্ষক থেকে শুরু করে সহপাঠিরা অনেক কটু মন্তব্য করে৷ স্কুলের প্রোগ্রামগুলো সাধারণত পূর্বনির্ধারিত এবং অনুমতি নিয়ে করা হতো৷ মোটা মেয়ে নাচলে যদি অসুবিধাই হয় শিক্ষকরা কেন অনুমতি দিলেন? স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ আহত হলো সেই মেয়ে৷ তার শিক্ষকদের ও সহপাঠিদের হাসি-ঠাট্টা সে নিতে পারেনি৷ সামার ভ্যাকেশনে সে শুকানোর চেষ্টা শুরু করলো৷ চেষ্টা স্বরূপ ফিলিপিনো কাজের লোক থেকে স্লিমিং পিল টাইপ অষুধ খুব গোপনে এনে খেলো৷ এই ধরনের ইনস্ট্যান্ট স্লিমিং অষুধগুলো রীতিমতো বিষ৷ এক মাসের মধ্যে লিভার সিরোসিস হয়ে মারা যায় মেয়েটি৷ হুট করে এত সিরিয়াস লিভার সিরোসিসের কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এই স্লিমিং পিলের তথ্য৷ কিন্তু ততদিনে তাকে ফেরানো যায়নি৷ এটাকে আমি একরকম আত্মহত্যাই বলব৷ আর প্ররোচনাদানকারী সেইসব মানুষেরা, যারা স্থুলতা নিয়ে স্থুল রসিকতা করেছে তার সঙ্গে৷

কিন্তু আদৌ কি এসব বন্ধ হবে? এভাবে বডিশেমিং করা, চিকন, মোটা, খাটো, কালো নিয়ে কথা বলা কীভাবে বন্ধ হবে? মরাল পুলিশিং করার অভ্যাস থাকলে বন্ধের বিষয়ে বড় নৈতিক জ্ঞান বিতরণ করা আমার জন্য সহজ হতো৷ আমি নিজেই সঠিক নই৷ বছর দুয়েক আগে এক নায়িকাকে ‘খ্যাংড়াকাঠি’ বলেছি আমি নিজে, ফেসবুকে পাবলিকলি৷ তখন জোশে বলেছি৷ কিন্তু এটা ভয়াবহ অন্যায়৷ আমাকে এই অন্যায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমার অনেক ছোট এক মেয়ে৷ সেদিন শিখেছিলাম সামান্য৷

ফাতেমা আবেদীনছবি: privat

আমার সবচেয়ে আলাভোলা বন্ধুকে আমি ‘লেব্দু’ বলি৷ যেখানে আমারই শিক্ষায় গলদ সেখানে কী করে অন্যকে নৈতিক জ্ঞান দেব? তাই অস্কারের মঞ্চে যখন উইল স্মিথ তার স্ত্রীর রোগ নিয়ে তামাশাকারি ক্রিস রককে থাপ্পড় দেন সেই থাপ্পড় আমার গালেই এসে পড়ে৷

‘বউকে নিয়ে রসিকতা করায় উইল স্মিথের চড়কে যারা স্বাগত ও সাধুবাদ জানাচ্ছেন, তাদের গালে চড় এসে পড়লে মতামত একই থাকবে তো? বুলিং কিন্তু আমরা কেউই কম করি না’- এ আমার সরল স্বীকারোক্তি৷ কিন্তু যেকোনো ভায়োলেন্সের বিপক্ষেই থাকতে চাই আমি৷ কথার জবাব কথা দিয়ে দেওয়া যেত বলে মনে হয়৷ সেই বিষয়টা উইল স্মিথ যেমন বুঝতে পেরেছেন, ক্রিস রকও অনুধাবন করেছেন৷ তবে আমরা এখনো পারিনি৷

কী করে পারবো বলুন- আমাদের বাল্যশিক্ষার এক পাতায় লিখা হয়- কানাকে কানা ও খোড়াকে খোড়া বলিও না৷ অন্যপাতায় লেখা থাকে- কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন৷ আমাদের মজ্জাগত দ্বিচারণ আমাদের আগাতে দেয় না৷ তবু বিশ্বাস করি আসছে প্রজন্ম ভিন্নভাবে ভাববে৷ তারা সব বডি শেমিংয়ের উর্ধ্বে গিয়ে ভাববে৷ যদিও এই প্রজন্মকেই তীব্র শেমিংয়ের মধ্য দিয়ে বড় হতে হচ্ছে- শহরে বড় হওয়াদের অনায়াসে গ্রামের লোকেরা বলে ফেলেন ফার্মের মুরগি৷ নন টেকি প্রজন্ম তাচ্ছিল্য করে তাদের ডাকেন ফেসবুক বা টিকটক প্রজন্ম বলে৷ কত বৈষম্য পরতে পরতে৷ আর এই বৈষম্যের দেশে সব কিছু আমরা উড়িয়ে দিতে পারি ঠাট্টা কিংবা ডার্ক কমেডি বলে৷ এদেশেই তো কৃষ্ণ কালো বলে তাকে নিয়ে গান লেখা হয়- কালো কালো করিসনেতো ও গোয়ালের ঝি, আমায় বিধাতা কইরেছে কালো, আমি করবো কী?

সৃষ্টির প্রতিটি জিনিস সুন্দর এই চর্চা নিয়ে বেড়ে উঠবে কোনো না কোনো প্রজন্ম৷ যারা ‘ব্ল্যাক লাইভ মেটার্স’ অনুপ্রেরণায় লড়াই করবে বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে৷ কমেডি আর শেমিংয়ের পার্থক্যটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে মানুষকে৷ যারা ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ কিংবা ‘তালপাতার সেপাই’ বাগধারা পড়ে বড় হবে না৷ সামান্য একটু সহমর্মী মন থাকলে হয়তো আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো এই দ্বিচারণ থেকে৷ ঠাট্টা বলে তীব্র বৈষম্যকে উড়িয়ে দেওয়া বন্ধ করি...

Fatema Abedin, Intern, DW Bangla section.
ফাতেমা আবেদীন বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ও সাংবাদিক
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য