1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বেনজীরে নজির গড়বে দুদক?

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৪ মে ২০২৪

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে থাকা স্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) করার আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ একই সঙ্গে তাদের ব্যাংক হিসাবও অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেওয়া হয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4gFvT
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও মেয়ের সকল স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ দিয়েছে আদালতছবি: bdnews24.com

বেনজীর আহমেদের মতো প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে আদালতের এ আদেশকে দুর্নীতিবিরোধী একটা বার্তা হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা৷

ঢাকা মহানগর আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আস্সামছ জগলুল হোসেন বৃহস্পতিবার বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-কন্যার বিরুদ্ধে এই আদেশ দেন৷

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আদালতের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ইতিবাচক৷ এই ঘটনায় জনগণের মধ্যে যে সংশয় ছিল, সেটা অনেকাংশেই দূর হবে৷ তবে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না৷ আমাদের মামলার তদন্ত ও বিচার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ অনেক সময় দেখা যায়, লোক দেখানোর জন্য অনেক কিছু করা হয়ে থাকে৷ এক্ষেত্রে দুদক আসলেই আন্তরিক কিনা সেটা দেখতে হবে৷ তবে আদালতের এই সিদ্ধান্তকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি৷”

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বেনজীর আহমেদের সম্পদ কেনার ৮৩টি দলিল জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ একই সঙ্গে তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাবও অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের এই আদেশ এসেছে৷” পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে খুরশীদ আলম খান বলেন, "দুদক তদন্তকালীন সময়ে এই ধরনের আবেদন করে, কারণ, তদন্ত চলাকালে তিনি যেন সম্পদ হাতবদল করতে না পারেন৷ এখন তদন্তকারী দল তদন্ত শেষে কমিশনের কাছে রিপোর্ট দাখিল করবে৷ এরপর কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে৷ অভিযোগের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেলে কমিশন তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দিতে পারেন৷”

বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার জহুরুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দুর্নীতির বিষয়ে আমরা কোনো ছাড় দেই না৷ আইন অনুযায়ী যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, এখানেও আমরা সেটাই নেবো৷ আমাদের অনুসন্ধানকারী দল নিবিড়ভাবে বেনজীর আহমেদের সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে৷ অনুসন্ধান শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ শুধু এটুকু বলতে পারি, আমরা কোন ছাড় দেবো না৷”

আদালতের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ইতিবাচক: ড. ইফতেখারুজ্জামান

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দুদকের প্রাথমিক যে উদ্যোগ সেটাকে আমি ইতিবাচকই বলবো৷ কারণ, অনেক প্রভাবশালীর দুর্নীতি অনুসন্ধানে গিয়ে কিন্তু দুদক সম্পত্তি জব্দের আবেদন করে না৷ এখানে বেনজীর আহমেদের মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সম্পদ জব্দের আবেদন করেছে দুদক৷ দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতেই আদালত এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন৷ তাই আমি মনে করি, বেনজীরের বিষয়ে এখন পর্যন্ত দুদকের আন্তরিকতাই আমরা দেখতে পাচ্ছি৷ তবে শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে৷” 

বেনজীরের সম্পদের অনুসন্ধানে একটি কমিটি করার কথা গত ২২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন৷ এরপর ২৩ এপ্রিল হাইকোর্ট এক আদেশে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের অগ্রগতির বিষয়টি হলফনামা আকারে দুই মাস পর জানাতে দুদককে নির্দেশ দেন৷

বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন৷ এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ ওই সময় র‌্যাবের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এই বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন, যার মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল৷

বেনজীর আহমেদের সম্পদ জব্দে আদালতের আদেশের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অপরাধ করে কেউ পার পাবেন না৷ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীন৷ বিচার বিভাগ স্বাধীন৷ বিচারে যদি কেউ অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হন, তারা তাকে কেন রক্ষা করতে যাবেন? ব্যক্তি যতই প্রভাবশালী হোন, অপরাধ করলে শাস্তি তাকে পেতে হবে৷ শুক্রবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের৷

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘‘বিষয়টি দেখতে হবে, ব্যক্তি যত প্রভাবশালী হোক, অপরাধ করতে পারে, অপকর্ম করতে পারে৷ কথা হচ্ছে, এ ব্যাপারে তাদের অপকর্ম-অপরাধের শাস্তির ব্যাপারে সরকার সৎসাহস দেখিয়েছে কিনা৷ অপরাধীদের শাস্তি দিতে শেখ হাসিনা সরকারের সৎসাহস আছে৷ অপরাধ করে কেউ পার পাবে না৷ অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয় কেউ, আমরা তাকে প্রোটেকশন দিতে যাবো কেন? তিনি সাবেক আইজিপি হোন আর সাবেক সেনাপ্রধান হোন৷ আমাদের দেশের প্রচলিত আইন তাদের বিচারের কাছে সমর্পণ করবে৷''

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তাতে সরকারের কোনো দায় নেই৷ তিনি অবসর নেওয়ার পর এই অভিযোগ উঠেছে৷ আর তার বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকারই৷ ফলে এখানে সরকারকে দায়ি করার সুযোগ নেই৷” 

তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেলে কমিশন চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দিতে পারেন: খুরশীদ আলম খান

বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে সম্প্রতি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক কালের কণ্ঠ৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনজীরের পরিবারের মালিকানায় রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ইকো রিসোর্ট৷ এই রিসোর্টের পাশে আরও ৮০০ বিঘা জমি কিনেছে তার পরিবার৷ এ ছাড়া পাঁচ তারকা হোটেলের ২ লাখ শেয়ারও রয়েছে তাদের৷ ঢাকার বসুন্ধরায় সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটও রয়েছে বেনজীরের পরিবারের৷ এসব সম্পত্তি অবৈধ টাকায় কেনা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়৷

প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত ২০ এপ্রিল নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন বেনজীর আহমেদ৷ ভিডিওতে তিনি দাবি করেন, তার পরিবারের যে সম্পদ রয়েছে, তা বৈধ এবং এর হিসাব ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ রয়েছে৷ অবৈধ যেসব সম্পত্তির কথা বলা হচ্ছে, তা যদি কেউ প্রমাণ করতে পারেন ওই ব্যক্তি বা গ্রুপকে তিনি সেই সম্পত্তি বিনা পয়সায় লিখে দেবেন বলেও ভিডিওতে দাবি করেন৷

এরপর বেনজীর আহমেদের সম্পদের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হয়৷ ওই রিটে কালের কন্ঠের প্রতিবেদনের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. সালাহ উদ্দিন রিগ্যান আবেদনকারী হিসেবে এই রিট করেন৷

আইনজীবী মো. সালাহ উদ্দিন রিগ্যান বলেন, "প্রকাশিত ওই সংবাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চেয়ে ৪ এপ্রিল দুদকের কাছে আবেদন করা হয়৷ এতে ফল না পেয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ১৮ এপ্রিল দুদক বরাবর আইনি নোটিশ পাঠানো হয়৷ এর কোনো জবাব না পেয়ে অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে রিটটি করা হয়েছে৷ আমি বলছি না, বেনজীর আহমেদ অবৈধভাবে বা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করেছেন বা করেননি৷ তবে প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অনুসন্ধান হওয়া উচিত৷ কারণ, প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী জনগণ মনে করেন, পুলিশের সাবেক আইজিপি অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন৷ দুদক অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিলে এই বিষয়ে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে৷ এরপর হবিগঞ্জ-৪ আসনের এমপি ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনও আদালতে আবেদন করেন৷ এর মধ্যে দুদক থেকে জানানো হয়, তারা বেনজীর আহমেদের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছেন৷