বুড়িগঙ্গায় গরিবের সহায় ভাসমান বোর্ডিং
পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে চারটি ভাসমান আবাসিক হোটেল। নিম্ন আয়ের মানুষদের এই রাত্রিনিবাসে অনেকে বছরের পর বছর ধরে থাকছেন৷ ছবিঘরে বিস্তারিত..
ট্রলার থেকে ভাসমান বোর্ডিং
মিটফোর্ড হাসপাতাল (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ)-এর পাশের ঘাটে মূলত ট্রলারকে ভাসমান বোর্ডিংয়ে পরিণত করা হয়েছে। এগুলো হলো ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিং, শরিয়তপুর মুসলিম বোর্ডিং, বুড়িগঙ্গা এবং উমা উজালা। এরমধ্যে উমা উজালা শুরুতে শুধু হিন্দুদের বোর্ডিং ছিল। এখন হিন্দু-মুসলিম সবাই থাকতে পারেন। এছাড়া একযুগ আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘নাজমা’ও ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে ঘাটে।
বারবার জায়গা পরিবর্তন
আগে বিভিন্ন স্থানে ছিল ভাসমান হোটেল। শুরুতে সদরঘাট-সংলগ্ন মসজিদ ঘাট, এরপর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল এলাকার ওয়াইজঘাট এবং সবশেষ ছিল বাদামতলি খেয়াঘাটে। নতুন নতুন ঘাট তৈরির ফলে বারবার হোটেলের জায়গা পরিবর্তন হয়েছে। এ কারণে অতিথির সংখ্যা কমেছে।
ভাসমান হোটেলের অতিথি
ঢাকায় নিম্ন আয়ের বেশিরভাগ মানুষের পরিবার থাকে গ্রামে। তাদের কাছে অল্প টাকায় থাকার জন্য ভাসমান হোটেলের বিকল্প নেই। সদরঘাট, বাদামতলি এলাকা ও বুড়িগঙ্গার আশেপাশের ফেরিওয়ালা, হকার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী, ভ্যানচালক, দিনমজুর, ফুটপাতের বিক্রেতারাই মূলত ভাসমান বোর্ডিংয়ে থাকেন। এছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেকেইএখানে নির্বিঘ্নে রাতযাপন করেন।
কেবিনের সংখ্যা
শরিয়তপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ে সবচেয়ে বেশি, মোট ৫৬টি কেবিন রয়েছে। ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ে ৪৬টি, উমা উজালায় ৪২টি কেবিন এবং আকারে তুলনামূলক ছোট বুড়িগঙ্গা বোর্ডিংয়ে রয়েছে ৩০টি কেবিন।
১০০ টাকায় রাত পার
ভাসমান হোটেলে রাতযাপনের জন্য সিঙ্গল শয়নকক্ষের (কেবিন) ভাড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকা। ডাবল কেবিন নিলে ১৫০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। ডাবল কেবিনে দুইজন থাকা যায়। তবে একটু লম্বা মানুষ হলেই সিঙ্গেল কেবিনে ঘুমাতে গেলে দরজার বাইরে পা বেরিয়ে আসে।
কেবিনের নীচে খোলা সিট
বোর্ডিংয়ে কোনো কেবিন ফাঁকা না থাকলে, কিংবা আরেকটু সাশ্রয়ী মূল্যে থাকার জন্য ডেক-এ থাকারও ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলোকে খোলা সিট বা ঢালা বিছানা বলে। এতে মশারি খাটিয়ে তিন-চারজন একঙ্গে থেকে রাত পার করে দেন। এজন্য গুনতে হয় জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা।
কম টাকায় ‘যথেষ্ট’ আরাম
প্রতিটি কেবিনে আছে খাট, তোশক, বিছানা, বালিশ, কাঁথা, বিদ্যুৎ, বাতি, বৈদ্যুতিক পাখা এবং একটি করে চাবি। একদিন পরপর বিছানার চাদর ও বালিশের কভার বদলে দেয় বোর্ডিং কর্তৃপক্ষ। সাধারণত হোটেল ম্যানেজার নিজেই এগুলো ধুয়ে দেন।
১০ টাকায় গোসল
বর্ষার সময় বুড়িগঙ্গা নদীর পানি বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে কিছুটা পরিষ্কার থাকে। তাই তখন নদীতেই গোসল করেন বোর্ডিংয়ের অতিথিরা। কাপড় ধোয়ার কাজ এখানেই হয়। নদী দূষিত হবে বলে অনেকে তখন কাছের মসজিদে গিয়ে গোসল করেন। এজন্য গুনতে হয় জনপ্রতি ১০ টাকা।
বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা
হোটেলের বাসিন্দাদের বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করা হয়। এজন্য বাড়তি অর্থ দিতে হয় না। মূল প্রবেশপথের একপাশে পানযোগ্য পানির বড় ড্রাম রাখা হয়।
স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার
প্রতিটি ভাসমান হোটেলে থাকে চারটি শৌচাগার। এরমধ্যে নীচতলায় দুটি এবং দোতলায় দুটি। অতিথিরা ডয়চে ভেলেকে বলেন, শৌচাগারগুলো স্বাস্থ্যসম্মত।
৩৩ বছর কেটে গেল..
খুচরা ফল ব্যবসায়ী রাজু আহমেদ ৩৩ বছর ধরে শরিয়তপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ে বাস করছেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘একেবারে শুরুতে ভাড়া ছিল দিনে দুই টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকা। মাসে ১০-১৫ দিন হোটেলে থাকি। বাকি সময় পিরোজপুরে গ্রামে পরিবারের কাছে চলে যাই। ঘুমানোর জায়গা হিসেবে আমার কাছে ভাসমান হোটেলই ভালো। এখানকার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে।’
বাঁশ ও কাঠের সাঁকো
ভাসমান বোর্ডিংয়ে ওঠার জন্য নদীর তীর থেকে পাতানো আছে বাঁশ ও কাঠের সাঁকো। একেকটি সাঁকো সাধারণত ছয় মাসের মতো টেকে। এগুলো বানাতে খরচ হয় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা।
বিআইডব্লিউটিএ থেকে ইজারা
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)-র কাছ থেকে ইজারা নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ঘাটে অবস্থান করছে ভাসমান বোর্ডিংগুলো। ইজারা হিসেবে প্রতি বর্গফুট হিসেব করে টাকা দিতে হয়। প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে গড়ে ১০ হাজার টাকা। বোর্ডিং মালিকদের দাবি, এখন সব মিলিয়ে আয়-ব্যয় সমান, খুব একটা লাভ হয় না তাদের৷
নৌকার ভিতর রেস্তোরাঁ
বোর্ডিংগুলোর একপাশে ছোট নৌকায় রয়েছে ভাসমান রেস্তোরাঁ। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে এটি। এখানে ইলিশ মাছ ৫০ টাকা, কাচকি মাছ ৪০ টাকা, আলু ভর্তা ১০ টাকা, প্রতি প্লেট ভাত ১০ টাকা এবং ডাল ফ্রি। ডয়চে ভেলেকে রেস্তোরাঁর খাবার বিক্রেতা সিরাজ বলেন, ‘বাদামতলিতে ভাড়া বাসায় রান্না করে আমার পরিবার। প্রতিদিন ৩০০ টাকা নৌকা ভাড়া দিতে হয়। তিন হাজার টাকা বিক্রি হলে আমার লাভ থাকে ৪০০-৫০০ টাকা।’
খাবার ছিল, এখন নেই
একসময় ভাসমান বোর্ডিংয়ে খাবার বিক্রি হতো। নিম্ন আয়ের মানুষেরা রাতে হোটেলে খেতে এলে ঢালা বিছানায় রাতযাপন করতে পারতো। এজন্য কোনও ভাড়া নেওয়া হতো না। কিন্তু ১০ বছর ধরে আর খাবার বিক্রি হচ্ছে না। কারণ হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায় দিয়েছেন বোর্ডিং মালিকেরা।
বুড়িগঙ্গা তীরের বিক্রেতা
ভাসমান বোর্ডিংগুলোর সামনে পান, বিড়ি, সিগারেট বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন মোশাররফ হোসেন। বসার জন্য বাঁশ দিয়ে আলাদা জায়গা বানিয়ে নিয়েছেন তিনি। হোটেলের অতিথি ও পথচারীরা তার ক্রেতা। সারাদিন বিক্রি শেষে রাতে জিনিসপত্র নিয়ে বুড়িগঙ্গা বোর্ডিংয়ে থাকেন তিনি।
‘আমাদের মতো গরিবদের ভরসা’
৩০ বছর ধরে ভাসমান বোর্ডিংয়ে আছেন ফল বিক্রেতা বাবুল শিকদার। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দিনে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ও বাদামতলিতে ফল বিক্রি করি। রাতে বোর্ডিংয়ে ঘুমাই। আমাদের মতো গরিবদের রাতযাপনে এটাই একমাত্র ভরসা। এখন ১০০ টাকা দিয়ে ঢাকার কোনো হোটেলে থাকার কথা ভাবাই যায় না। এখানে থাকতে ভালোই লাগে।’’
ঐতিহ্য আছে, সুদিন নেই
ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের মালিক মো. মোস্তফা মিয়া জানান, তার মামা বোর্ডিং ব্যবসা করতেন। এখন তিনি হাল ধরেছেন। তার কথায়, ‘ভাসমান হোটেল পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্য। এখনও এটি টিকে থাকলেও আগের সুদিন আর নেই। কমে গেছে অতিথির সংখ্যা।’
নারীদের থাকার ব্যবস্থা নেই
শরিয়তপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার দুলাল মিয়া ডয়চে ভেলেকে জানান, ভাসমান হোটেলগুলোর দরজা রাত ১২টা থেকে ফজরের আজান পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। বাকি সময়ে বোর্ডিং খোলা থাকে। ভোটার আইডি কার্ড দেখে অতিথিদের থাকতে দেওয়া হয়। তবে এখানে নারীদের থাকার ব্যবস্থা নেই। বোর্ডিংগুলোতে শুধু পুরুষরাই থাকতে পারেন।
কাঠের নৌকা দিয়ে যাত্রা শুরু
স্বাধীনতার পর থেকে সদরঘাটে ভাসমান বোর্ডিং চালু হয়েছিল। শুরুর দিকে এগুলো ছিল কাঠের নৌকা। নব্বই দশকের পর লোহা দিয়ে সংস্কার করা হয়। কয়েক বছর অন্তর ট্রলারগুলো ডকইয়ার্ডে নিয়ে মেরামত করা হয়।