1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কেউ নেই

এম আবুল কালাম আজাদ
এম আবুল কালাম আজাদ
২ ডিসেম্বর ২০২২

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা আমরা জানি৷ অভিনব কায়দায় কোথাও সুড়ঙ্গ তৈরি করে, আবার কোথাও কর্মকর্তাদের জিম্মি করে বা অস্ত্র নিয়ে হামলা করে ব্যাংক লুট করা হয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4KP3T
বাংলাদেশ ব্যাংক
দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ বের হওয়ার পর হঠাৎ তৎপর হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ছবি: Reuters/A. Rahman

যেমন, ২০০৫ সালে ব্রাজিলে ২৫ জনের একটি ডাকাত দল মাটির নীচে ২৫০ মিটার সুড়ঙ্গ কেটে একটি ব্যাংকে প্রবেশ করে৷ তারা ৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লুট করে৷ গিনেসবুকে স্থান পাওয়া ওই ডাকাতির ঘটনায় পুলিশ ৮ জনকে আটক করে ২০ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করেছিল৷

এর আগে ১৯৮৭ সালে লন্ডনে এক দুর্ধর্ষ ডাকাতি হয়৷ ভল্ট ভাড়া নেয়ার নাম করে ডাকাতরা অস্ত্র নিয়ে কিংস্টন সিকিউরিটি ডিপোজিট কেন্দ্রে ঢুকে ৯৭ মিলিয়ন ডলার লুট করে নিয়ে যায়৷ পরবর্তীতে ডাকাত দলের প্রধানকে আটক করা হয়৷

এমন ডাকাতির ঘটনায় থাকে মৃত্যু বা ধরা পড়ার ঝুঁকি৷ তবে ব্যাংকের লোক বা ক্ষমতার বলয়ের কেউ জড়িত থাকলে ঝুঁকি কম থাকে, ফলে সফলভাবে ডাকাতি করে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়৷

এ রকম দুর্ধর্ষ না হলেও ২০০৮ সালে বেশ অভিনব কায়দায় বড় ধরনের ডাকাতি হয় ব্র্যাক ব্যাংকে৷ শুক্রাবাদে হোটেল নিদমহল ভবনের দোতলায় ছিল ব্যাংকের শাখা৷ ভুয়া নাম, ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যাংকের ঠিক উপরের চারটি রুম ভাড়া নেয় ডাকাত দল৷ একটি রুমে প্রতিরাতে একটু একটু করে ছাদ কেটে গর্ত করে৷ প্রায় মাস খানেক পর ঐ গর্ত দিয়ে ব্যাংকে ঢুকে ৬০টি ভল্টে থাকা সোনার গহনাসহ মূল্যবান জিনিস নিয়ে সটকে পড়ে৷

সে সময় আলোড়ন সৃষ্টি করা ডাকাতির ঘটনায় পুলিশ পাঁচ জনকে আটক করে৷ বেশ কিছু স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করারও সম্ভব হয়েছিল৷

কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাংক লুট করতে এমন সব অভিনব কায়দা বা সশস্ত্র হামলার প্রয়োজন হয় না৷ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হলে আর ক্ষমতাসীনদের সাথে হট কানেকশন থাকলে সুদের নামে ব্যাংক থেকে বিলিয়ন ডলার তুলে নেয়া কোনো ব্যাপার না৷

ইসলামী ব্যাংক থেকে যেভাবে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হচ্ছে, সেটাকে এক ধরনের ডাকাতিই বলা যায়৷ কেননা, এর বড় এক অংশ ইতিমধ্যেই বিদেশে পাচার হয়েছে৷ আর বাকিটা হয়ে যাবে খেলাপি, অর্থাৎ ফেরত না দিলেও চলবে৷ আবার টাকা উদ্ধারের জন্য লুটেরাদের কাউকে আটক করার সম্ভাবনাও কম৷

কিছু ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে অনেক বছর ধরেই টাকা নিয়ে ফেরত দেয় না৷ তারা জোট বেঁধেছে ক্ষমতাসীন কিছু মানুষের সাথে৷

ড. কামাল হোসেন এমনটাই বলেছেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে৷ তার মতে, আর্থিক খাতে দুর্নীতিগ্রস্তদের বিচারহীনতায় অর্থপাচার, লুটপাট মহামারি আকার ধারণ করছে৷ তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের অনেকে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আগে টাকা পাচার করছে৷  

মজার ব্যাপার হলো, এই চক্র প্রয়োজনে ব্যাংক দখলে নিতেও দ্বিধা করে না৷ যেমন, ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণনেয় এস আলম গ্রুপ৷ পরিচালনা পর্ষদে বসানো হয় নিজেদের লোক৷ পরিকল্পনা কষেই তা করা হয়েছিল, যেন ঋণের নামে হাজার কোটি অনায়াসে বের করে আনা যায়৷ ঘটেছেও তাই৷

ইসলামী ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পরেও বছর, অর্থাৎ, ২০১৮ সালে ঋণ বেড়েছিল ৯ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা৷ তিন বছরে মধ্যে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৪৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা৷ এ থেকেই বোঝা যায় পরিকল্পনা মাফিক সব কিছু করা হয়েছে৷

এস আলম ছাড়াও আরেকটি ব্যবসায়ী গ্রুপকে (নাবিল গ্রুপ) অনিয়ম করে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে৷ নতুন করে গজিয়ে ওঠা আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে বড় অংকের ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়৷ অতি অল্প সময়ের মধ্যে এসব ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়৷ এ থেকে বোঝা যায়, এর পেছনে রয়েছে একটি গোষ্ঠী, যারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সটকে পড়তে চায়৷

অন্যদিকে, এই চক্রের সাথে যেহেতু সরকারের একটি মহলের আঁতাত হয়, ফলে তাদের কেউ কিছু বলার সাহস করে না৷ যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে অনেকভাবে এসব ঋণ প্রদান ঠেকাতে পারে৷ কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে তাদের হাত-পা বাঁধা৷

শুধু তাই না, ইসলামী ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা সরাতে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে পর্যবেক্ষক ২০২০ সালের মার্চে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ এরপর দ্রুত ঋণ বৃদ্ধি করে ইসলামী ব্যাংক, যার বড় অংশ দেয়া হয় অনিয়ম করে, নামে-বেনামে৷

ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ব্যাংক একক ব্যক্তি গ্রুপকে মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ সমপরিমাণ ঋণ দিতে পারে৷ গত জুন পর্যন্ত হিসাবে ইসলামী ব্যাংকের মূলধনের বিপরীতে একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা দিতে পারতো৷ কিন্তু এস আলম গ্রুপের কয়েক প্রতিষ্ঠানের ৩০,০০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে৷ জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনে তা দেয়া হয়েছে৷

নিউ এজ পত্রিকার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইন ও নিয়ম-কানুন মানলে এস আলম ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে পারে মাত্র ২১৫ কোটি টাকা৷ কিন্তু ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সীমার বাইরে চলে গেছে গ্রুপটি৷

এম আবুল কালাম আজাদ, ডয়চে ভেলে
এম আবুল কালাম আজাদ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

২০১৬ সালে সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি হয়েছে আর বেসিক ব্যাংকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা লুটপাটের চেষ্টা চালিয়েছেন৷ কিন্তু কারো কিছু হয়নি৷

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির মূল হোতা কে তা সকলেরই জানা৷ তিনি ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু৷ কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই খুঁজে পায়নি৷ আবার হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর সোনালী ব্যাংক বড় বিপদে পড়ে, অথচ দুদক রহস্যের কোনো কিনারাই করতে পারেনি৷ হল-মার্ক ঘটনায় বর্তমান সাংসদ এক ব্যাংক পরিচালকের নাম থাকলেও দুদকের মামলায় তার নামই নেই৷

দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ বের হওয়ার পর হঠাৎ তৎপর হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ ঋণের নামে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে প্রচুর অর্থ বের করে নেওয়ার অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে৷ অথচ তারা জেনেও আগে পদক্ষেপ নেয়নি৷

ইসলামী ব্যাংকসহ অন্য যেসব ব্যাংক থেকে ঋণের নামে যেভাবে টাকা বেহাত হয়ে গেছে, তার সঠিক তদন্ত করে ফলাফল জনগণের সামনে প্রকাশ করা উচিত৷ উচিত যারা এর সাথে যুক্ত তাদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেয়া৷ তবে এমন আশা করলে নিরাশ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি৷ অতীতের উদাহরণ তাই বলে৷

যে দেশের অর্থমন্ত্রী আর্থিক বা ব্যাংক খাতে কোনো সমস্যা দেখে না, সেখানে ‘সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা কোনো টাকা না’ মন্তব্য করে, যেখানে দেশে সর্বোচ্চ আদালত ঋণ খেলাপি, ব্যাংক লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করে, সেখানে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন৷