‘ব্রাজুকা’-র ইতিবৃত্ত
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪বল, মানে শুধু তো একটা ফুটবল৷ কিন্তু আসলে এটা ২০১৪-র ফুটবল বিশ্বকাপের বল, রীতিমতো সরকারি ছাপ মারা৷ আগের সব বিশ্বকাপের বলের চেয়ে বেশি রঙচঙে, এছাড়া তার নামেই ব্রাজিলের প্রাণোচ্ছ্বল জীবনযাত্রার ছোঁয়াচ পাওয়া যাচ্ছে৷
‘ব্রাজুকা', এই ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের নাম৷ বলটি তৈরির পিছনে যার সবচেয়ে বড় অবদান, তিনি হলেন প্রোডাক্ট ম্যানেজার ইয়খেন রাফ৷ রাফ বলেন: ‘‘আসলে এই বলটির প্রেরণা এসেছে তিনটি সূত্র থেকে৷ প্রথমেই চোখে পড়ে এই ব্যান্ডগুলো, যা কিনা ব্রাজিলের একটা চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য৷ অপরদিকে ব্রাজিলে এই ধরনের শালু কিংবা পতাকাও চোখে পড়বে৷ তারপর ব্রাজিলের পতাকার এই সব রং এবং সেই সঙ্গে গ্রহ-তারকা, ব্রাজিলিয়ানদের জীবনে যার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে৷''
ছ'টি চামড়ার টুকরো
জার্মানির নুরেমবার্গ শহরের কাছে হ্যারৎসগেনরাউখে আডিডাস কোম্পানির ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ইয়খেন রাফ ও তাঁর টিম আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বকাপের বলটি ‘ডেভেলপ' করেছেন৷ তবে প্রোডাকশনের কাজ শুরু হতে পেরেছে৷ বলের চেহারাই শুধু নতুন নয়, সেই সঙ্গে তার গঠনও বদলে গেছে: ছ'টি একই আকৃতির চামড়ার টুকরো জোড়া দিয়ে বলটা তৈরি৷ রাফ-এর ভাষ্যে:
‘‘বলের ‘সিম', অর্থাৎ সেলাই-ফোঁড়াই-এর ওপর নির্ভর করবে, বলটা সুন্দরভাবে ফ্লাই করবে কিনা৷ চামড়ার টুকরোগুলো যত ভালোভাবে পরস্পরের সাথে জোড়া দেওয়া যাবে, বলের উড়াল ততই ভালো হবে৷ কাজেই এই বল ডিজাইন করার সময় এই লম্বা সেলাই আর সুঠামভাবে জোড়া দেওয়ার ওপর নজর রাখতে হয়েছে৷ এর ফলে বল যেভাবেই ঘুর-পাক খাক না কেন, তার ফ্লাইট হবে স্থায়ী ও সুন্দর৷''
আডিডাসের ল্যাবোরেটরিতে বলের প্রোটোটাইপ ভালোভাবে পরীক্ষা না করে তা বিশ্বকাপে পাঠানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷ একটি বিশেষ যন্ত্র পরীক্ষা করে দেখে, বলটা সত্যিই পুরোপুরি সিমেট্রিক্যাল, অর্থাৎ প্রতিসম – সহজ কথায় সমান-সমান কিনা৷ রোবোট দিয়ে কিক করিয়ে বলের ফ্লাইট মেপে দেখা হয়৷ তারপরেও থাকছে পেশাদারি খেলোয়াড়দের দিয়ে টেস্ট করানো৷
দু'হাজার বছরের ইতিহাস
‘ব্রাজুকা' অবধি পৌঁছাতে অবশ্য বহু সময় লেগেছে৷ আজ থেকে দু'হাজার বছর আগেই চীনের মানুষরা পাখির পালক আর জীবজন্তুর লোমে ভরা বল দিয়ে খেলতো৷ গত শতাব্দীর ষাটের দশক অবধি বিশ্বকাপের বলগুলো চামড়ার স্ট্রিপ দিয়ে তৈরি হতো৷ আডিডাস সংস্থা প্রথমবার বিশ্বকাপের বল সরবরাহ করে ১৯৭০ সালে৷ সে যাবৎ প্রতিবার বলের একটা নতুন নাম দেওয়া হয়েছে৷ রাফ বলেন: ‘‘আজকাল লোকে যেটা প্রায় ভুলতে বসেছে, সেটা হলো এই যে, প্রথমবার যখন এই কালো পাঁচকোণা দেওয়া সাদা বলটা তৈরি করা হয়, তখন সেটা ছিল বলটা যাতে আরো ভালোভাবে দেখা যায়, তা নিশ্চিত করার পদ্ধতি৷ তখন সেটা ছিল নতুন, আজ সকলেই যেটা চেনে৷ কিন্তু বিশ্বকাপের বলের জন্য ঐ প্রথম এই ডিজাইনটা ব্যবহার করা হয়৷ আজ সেটা বল তৈরির একটা ক্ল্যাসিক ডিজাইনে পরিণত হয়েছে৷''
টুর্নামেন্ট থেকে টুর্নামেন্টে বলের আরো বিকাশ ঘটেছে: চামড়ার বদলে সিন্থেটিক লেদার; সাদা-কালোর বদলে নানা রংয়ের বল৷ হ্যারৎসগেনরাউখের ডিজাইন টিম বিশ্বকাপ ফাইনালের জন্য একটি বিশেষ বল উদ্ভাবন করে৷ বিশ্বকাপ বলটির ডিজাইনার ফ্রানৎসিস্কা বলেন: ‘‘ফাইনালে আবেগ-অনুভূতি সত্যিই চরমে পৌঁছায় – যে কারণে রংয়ের রিবনগুলো যেন প্যানেল ছেড়ে ফেটে বেরয় – এই সব ছোট ছোট খুঁটিনাটি – যার ফলে গোটা আবেগটা যেন আরো বেশি অভিব্যক্তি পায়, যেন একটা নাচ, যেন সাম্বা নাচ, যেন নাচের বাজনা, অনেক আবেগ-অনুভূতি যেন এভাবে একসঙ্গে বেরিয়ে আসে৷''
ব্রাজিলের আইকন
ইয়খেন রাফ-এর মূল প্রেরণা ছিলেন ব্রাজিলের প্রখ্যাত স্থপতি অস্কার নিমায়ার৷ এছাড়া ব্রাজিলের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকেও প্রেরণা পেয়েছেন ব্রাজুকা-র স্রষ্টা৷
‘‘এ ধরনের একটা টুর্নামেন্টে বলটা হলো যেন একটা আইকন বা প্রতীক৷ এবং সেই আইকন-কে উদ্যোক্তা কিংবা আমন্ত্রণকর্তা দেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত করাটা ঠিক বলেই আমি মনে করি৷ সেই দেশকে সম্মান জানিয়ে বলা, এই হলো সেই বল, যার মাধ্যমে দেশটা বাস্তবিক প্রতিফলিত হচ্ছে৷''
আইকন-ই হোক আর হাই-টেক খেলার জিনিসই হোক আর শুধুমাত্র ফুটবলই হোক – গত বিশ্বকাপে সারা পৃথিবীর মানুষ দেখেছে: ব্রাজুকা!