বিরোধীদের অপহরণ, রাজনীতির নয়া ট্রেন্ড?
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২রবিবার পশ্চিমবঙ্গে ১০৮টি পুরসভার নির্বাচন৷ প্রচার পর্ব শেষ হয়েছে শুক্রবার৷ স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের মনোনয়ন পেশে বাধা থেকে ভয় দেখানো, এমন নানা অভিযোগ প্রতিবার সামনে আসে৷ তবে এবার নতুন অভিযোগ আসছে অপহরণের৷ বিজেপি-বাম-কংগ্রেসের অভিযোগ, নির্বাচনে হারের আশঙ্কা করে অনেক ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থীদের তৃণমূল তুলে নিয়ে গিয়েছে৷ তৃণমূল বলছে, ভরাডুবির ভয়ে অজুহাত খাড়া করছে বিরোধীরা৷
বজবজ পুরসভার বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী অঙ্কুর চক্রবর্তীকে ৯ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ সেদিনই ছিল মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ দিন ছিল৷ বাম প্রার্থী বলেন, ‘‘আমি দলের কাজ সেরেই রাতে বাড়ি ফিরছিলাম৷ সেইসময় আমায় রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায় ওরা৷ যাতে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিই, সেজন্য চাপ দেয়৷ এর ফলে আমি মনোনয়ন জমা দিতে পারিনি৷''
অঙ্কুরের অভিযোগের তির ছিল তৃণমূলের দিকেই৷ দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজের ১৩টি ওয়ার্ডে কোনো প্রার্থী দিতে পারেনি বিরোধীরা৷ ফলে নির্বাচনের আগেই এই পুরবোর্ড তৃণমূলের দখলে চলে এসেছে৷
পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি পুরসভায় ২০ নং ওয়ার্ডে কংগ্রেস প্রার্থী উজ্জ্বলা সাউকে মনোনয়ন দিতে যাওয়ার সময় অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ৷ ঘণ্টাখানেক বাদে উজ্জ্বলা ফিরে এলেও আর প্রার্থী হতে চাননি৷ এক্ষেত্রেও অভিযোগ ছিল তৃণমূলের দিকে৷ ভোটের আগে শুধু নয়, ভোটের দিনও অপহরণের অভিযোগ উঠেছে৷ ১২ ফেব্রুয়ারি পুরভোটের দিন আসানসোলে ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী মধুসূদন দে-কে অপহরণ করার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে৷ সব অভিযোগই খারিজ করেছে তৃণমূল৷
বিস্তর হইচই হয়েছে কলকাতা লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনার ঘটনায়৷ ভাটপাড়া পুরসভার ৩৫ নং ওয়ার্ডে বিজেপি প্রার্থী রঞ্জিত মল্লিককে ১৬ ফেব্রুয়ারি অপহরণের অভিযোগ ওঠে শাসক দলের বিরুদ্ধে৷ পোস্টার লাগানোর সময় দুষ্কৃতিকারীরা তাকে তুলে নিয়ে যায়৷ এই প্রার্থীকে এর আগেও বাড়ি থেকে তুলে অন্যত্র আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে৷ রঞ্জিত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখানে বিজেপির প্রার্থী থাকলে তৃণমূলের পক্ষে সেটা ভয়ের ব্যাপার৷ ১৬ তারিখ আমাকে অপহরণ করে আমার থেকে মুচলেকা নেয়া হয়েছে যে, তৃণমূলের হয়ে আমাকে প্রচার করতে হবে৷ এ রাজ্যে বিরোধীরা এমন অগণতান্ত্রিক পীড়নের শিকার৷''
এরপর রঞ্জিতকে ফের তুলে নিয়ে যাওয়া হয় চারদিন আগে৷ গণপ্রহারের পাশাপাশি খুনের হুমকি দেওয়া হয় বলে প্রার্থীর অভিযোগ৷ পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘‘যাদের নামে আমি অভিযোগ করেছিলাম তাদের কাউকেই পুলিশ ধরেনি৷ অপরাধীরা খোলাখুলি ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ আমার কোনো নিরাপত্তা নেই৷ তৃণমূল রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করতে চাইছে৷''
বিজেপির এই প্রার্থীর অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দল শুধু বিরোধী প্রার্থী নয়, প্রার্থীর পরিবারের সদস্যদের উপরও চড়াও হচ্ছে৷ ব্যারাকপুরের বিজেপি নেত্রী ফাল্গুনী পাত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাজনৈতিক কারণেই আমাদের প্রার্থীকে অপহরণ করা হয়েছিল৷ হুমকি দিলেও রঞ্জিত মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি৷ তাই বারবার ওকে অপহরণের ছক করা হচ্ছে৷''
তৃণমূল এই অভিযোগকে বিরোধীদের পরিতাপ হিসেবেই দেখছে৷ কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ, বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি আইনজীবী৷ রাজনৈতিক অপহরণ মামলাগুলিতে দেখেছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো সারবত্তা থাকে না৷ বিরোধীরা পুরসভা ভোটে সুবিধা করতে পারছে না৷ তাই অপহরণ, পোস্টার ছেঁড়া, মারধর ইত্যাদি অভিযোগ তুলে হেরে যাওয়ার একটা ডিফেন্স গড়ে তুলছে৷''
ভোটের হিসেব দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘‘কলকাতা পুরসভা ভোটে বিজেপি ৯ শতাংশ ও বামেরা ১২ শতাংশ ভোট পেয়েছে৷ মানুষের সমর্থন পুরোটাই তৃণমূলের দিকে৷ তা হলে অপহরণ করতে যাবে কেন? হারার ভয়ে এ সব বিরোধীদের তৈরি গল্প৷''
নয়া প্রবণতা সুস্থ রাজনীতির বিরুদ্ধে, এমনটাই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীলাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজনীতি আর আদর্শের জায়গায় নেই, রোজগার সর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তাই পুরসভার ভোটে নির্বাচিত হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ এর সঙ্গে রাজনীতির অপরাধীকরণ হয়েছে৷ এটা আগে ছিল না৷ পেশিশক্তি ও অর্থের জোরে অপরাধীরা যখন রাজনীতিতে আসছে, তারা প্রার্থীকে হারানোর জন্য অপহরণের মতো পদক্ষেপ নেবে, এটাই স্বাভাবিক৷''
১২.০২.২০২২ তারিখের ছবিঘরটি দেখুন: