বিরল আদিম অরণ্যে মূল্যবান গবেষণা
১৫ জুলাই ২০২০রোমানিয়ার সিবিউ শহর থেকে গাড়িতে ঘণ্টাতিনেক দূরে বোইয়া মিকা উপত্যকা৷ সেখানে এখনো পর্যন্ত সাধারণ মানুষের পা পড়ে নি৷ একদল বিজ্ঞানী ইউরোপের সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর ও বড় জঙ্গলে ভরা এই উপত্যকায় যাতায়াত করেন৷ সেখানে গবেষকদের জন্য এমন এক গুপ্তধন লুকিয়ে রয়েছে, যা দামী পাথরের মতো বিরল ও দূরের গ্রহের মতো রহস্যময়৷ দলের সদস্য মার্টিন মিকোলাশ বলেন, ‘‘বোইয়া মিকা সত্যি অনবদ্য, কারণ এটা ইউরোপের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের শেষ উপত্যাকাগুলির অন্যতম যেখানে মানুষের তৈরি কোনো পথ নেই, যা সত্যিই বেশ দুর্গম৷’’
প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত এই উপত্যকায় আসছেন৷ কারণ দুর্গম এই জায়গাটি গবেষণার জন্য খুবই উপযুক্ত৷ ইউরোপে প্রায় ১,০০০ হেক্টর জুড়ে উপত্যকা থেকে পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত এমন অক্ষত প্রকৃতি সত্যি বিরল৷
বর্তমানে ইউরোপের প্রায় ৯৫ শতাংশ জঙ্গল বাণিজ্যিক কারণে কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা হয়েছে৷ সে কারণে প্রাকৃতিক অরণ্যের চরিত্র বুঝতে হলে বোইয়া মিকা উপত্যকার মতো জায়গায় আসতে হবে৷ শুধু এমন জায়গায় এলেই জঙ্গলের ইকোসিস্টেমের আদি ও অকৃত্রিম রূপ দেখা যায়৷ মার্টিন মিকোলাশ মনে করেন, ‘‘এমন জায়গার অস্তিত্ব সত্যি খুব জরুরি৷ বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা কীভাবে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে, শুধু এমন উপত্যকায় আমরা তা পর্যবেক্ষণ করতে পারি৷’’
প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে পাহাড় চড়ার পর অবশেষে ক্যাম্পে পৌঁছানো গেল৷ এক সপ্তাহ ধরে প্রাকৃতিক জঙ্গলের রহস্য ভেদ করতে বিজ্ঞানীদের দল সেখান থেকে আশেপাশের পাহাড় ঘুরে দেখবেন৷ পরের দিন সকালে অসংখ্য পরিমাপ যন্ত্র নিয়ে গবেষকরা জঙ্গলের আরও গভীরে প্রবেশ করলেন৷ ঘন জঙ্গল ভেদ করে এগিয়ে চলা সত্যি বেশ কঠিন৷ তাছাড়া জঙ্গলের মধ্যে তাঁরা মোটেই একা নন৷ মার্টিন মিকোলাশ জানালেন, ‘‘এখানে পাতার উপর ভালুকের পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে৷ দেখতে পাচ্ছেন, একই রেখায় ছাপ এগিয়ে গেছে৷ এত বড় পা অন্য কোনো প্রাণীর হতে পারে না৷ ভালুকটা সম্ভবত পাতার নীচে পোকার খোঁজ করছিল৷’’
বোইয়া মিকা উপত্যকায় আনুমানিক ১৫টি ভালুক বসবাস করে৷ গবেষকদল অবশ্য তাতে দমে না গিয়ে কাজ চালিয়ে গেছেন৷ অর্থাৎ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গোটা জঙ্গল পরিমাপ করেছেন৷ তাঁরা এভাবে গাছপালার সংখ্যা, বয়স, উচ্চতা ও জাত লিখে রাখেন৷ তাঁরা মরা গাছের গুঁড়ির ঘনত্ব ও বণ্টন ভালোভাবে হিসাব করেন৷ তাছাড়া অনেক গাছের ইতিহাস জানতে সেগুলির তাঁরা নমুনাও সংগ্রহ করেছেন৷
প্রায় ১০ বছর আগে জটিল এই গবেষণা প্রকল্প শুরু হয়েছিল৷ ইউরোপের হাতে গোনা অবশিষ্ট আদিম অরণ্যগুলিতে বিজ্ঞানীরা বাস্কেটবল মাঠের মাপের কিছু গোল জায়গা বেছে নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন৷ এভাবে প্রায় এক হাজার প্লট চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এই গোষ্ঠী প্রায় ৪০,০০০ গাছের নমুনা সংগ্রহ করেছে৷ ফলে আদিম অরণ্য সম্পর্কে ইউরোপের সবচেয়ে বড় তথ্যভাণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে৷ মার্টিন মিকোলাশ বলেন, ‘‘প্রতি বছর আমরা প্রায় তিন মাস জঙ্গলেই কাটাই৷ দলে অনেক মানুষ থাকে৷ এই মুহূর্তে ফাগারাশ পাহাড়ে আমাদের দলে ২৫ জন রয়েছে৷ সব মিলিয়ে তিনটি দল বিভিন্ন উপত্যকায় ছড়িয়ে রয়েছে৷’’
একটি প্রশ্ন মার্টিন মিকোলাশ-কে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে৷ আদিম অরণ্য কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাচ্ছে? ভবিষ্যতে এমন জঙ্গলের অস্তিত্ব কি বিপন্ন হতে পারে? তাঁর মতে, ‘‘জটিল বিষয় হলো, তাপমাত্রার চরম ফারাক বেড়েই চলেছে৷ ফলে প্রকৃতি অস্থির হয়ে উঠছে৷ গাছ উপড়ে দেওয়া ঝড়, খরা, দাবানল, পোকামাকড়ের উপদ্রব বাড়ছে৷’’
এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেড়ে চলার ফলে কি আদিম অরণ্য হুমকির মুখে পড়ছে? সেই প্রশ্নের জবাব পেতে গবেষকরা সবার আগে অতীতে ঢুঁ মারতে চান৷ বোইয়া মিকা অরণ্য গত কয়েক শতাব্দীতে কত ঘনঘন পোকার উপদ্রব বা খরার কবলে পড়েছে? এবং এই অরণ্য কত দ্রুত আবার সবকিছু সামলে নিয়েছে? এই সব প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব পাওয়া গেছে৷ গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে যে অতীতেও এই অরণ্যে একাধিক বিপর্যয় ঘটেছে৷ তবে তা সত্ত্বেও কোনো স্থায়ী ক্ষতি হয় নি৷
মাক্স লেবসানফ্ট/এসবি