1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘বিদেশি বর্জ্য নিয়ে শিল্প চালানোর যুক্তি নেই'

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৭ এপ্রিল ২০১৭

‘‘বিদেশ থেকে যে জাহাজগুলো আসে, সেগুলোর হয় বিদেশ থেকে পরিষ্কার হয়ে আসতে হবে অথবা কন্টেইনার মারফত বর্জ্যগুলো বিদেশে ফেরত পাঠাবে বাংলাদেশ৷'' কথাগুলো বলেন রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান৷

https://p.dw.com/p/2bGv7
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানছবি: Syeda Rizwana Hasan 

ডয়চে ভেলে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আপনি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ৷ আপনার কাছে প্রশ্ন – এই যে জাহাজ ভাঙাকে ‘শিল্প' বলা হয়, এটা নিয়ে আপনারা কী ধরনের কাজ করে থাকেন?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: জাহাজ ভাঙাকে নতুন করে শিল্প ঘোষণার কোনো প্রয়োজন ছিল না৷ শ্রম আইনে শিল্পের যে সংজ্ঞা, তার মধ্যে জাহাজ ভাঙা প্রথম থেকেই পড়ত৷ আদালত যখন জাহাজ ভাঙাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আদেশ দেওয়া শুরু করে, সে সময় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে কেবিনেট মিটিং হয়, তাতেই জাহাজ ভাঙাকে একটা ‘শিল্প' হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ তবে আমি যেটা বুঝি, এর পেছনে যে একটা রাজনৈতিক শক্তি আছে, সেটা আদালতসহ সমাজের অন্যদের বুঝিয়ে দিতে হবে৷ কারণ, আসলে এটা শিল্পের ধারে ধাছেও যায় না৷ যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকলে এটাকে শিল্প বলতে পারতাম, জাহাজ ভাঙার ক্ষেত্রে তার কোনোটাই নেই৷

এই শিল্প থেকে সরকারের রাজস্ব আসে কেমন?

সঠিকভাবে এই হিসাবটা আমি বলতে পারব না৷ তবে সরকারের বিভিন্ন খাত থেকে যে রাজস্ব আসে, তার প্রথম ২০টার মধ্যে জাহাজ ভাঙা শিল্প নেই৷

Interview of Syeda Rizwana Hasan - MP3-Stereo

দেশে ইস্পাতের চাহিদার কতভাগ আসে এ শিল্প থেকে?

২০০৯ সালে জাহাজ ভাঙা শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে একটা হিসাব দেওয়া হয়েছিল৷ সেখানে বলা হয় যে, ২৫ ভাগ এই শিল্প থেকে আসে৷ যেহেতু সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে গত তিন বছরে এর কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে, আমি ধরে নিচ্ছি যে, এটা বর্তমানে সর্বোচ্চ ৩৫ ভাগে হতে পারে৷ তবে এর বেশি কোনোভাবেই নয়৷ এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, এই ইস্পাত অত্যন্ত নিম্নমানের৷ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গবেষণায় দেখা গেছে, এটা দিয়ে চার তলার বেশি বাড়ি করা ঠিকই না

বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা শিল্পে পরিবেশ ছাড়পত্র কি ঠিকমতো নেওয়া হয়?

একেবারেই ঠিকমতো নেওয়া হয় না৷ পরিবেশ অধিদপ্তর তড়িঘরি করে এটাকে রক্ষা করতে এবং আদালতের আদেশকে পাশ কাটাতে কিছু কিছু ছাড়পত্র দিয়েছিল৷ সেই ছাড়পত্র পড়লেই আপনি দেখবেন যে, সেগুলো ছিল শর্তসাপেক্ষ ছাড়পত্র৷ এক থেকে ৫২ পর্যন্ত শর্ত দেওয়া হয়েছিল৷ ১০ মাস পর পরিবেশ অধিদপ্তর যখন ওখানে ‘ফিল্ড সার্ভে' করে, তখন দেখে ৩-৪টি শর্ত ছাড়া সবগুলো শর্তই তারা ভাঙছে৷

জাহাজ ভাঙার আগে সাধারণত তেজস্ক্রিয় পদার্থের অস্তিত্ব নিয়ে একটা পরীক্ষা হয়৷ আমাদের এখানে কি এটা করা হয়?

একেবারেই করা হয় না৷ আর করা হলেও তা ভুল রিপোর্ট দিয়ে করা হয়৷

এই শিল্পের কারণে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে....তা কোন পদার্থ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে?

ক্ষতি অনেক পদার্থই করছে৷ এর মধ্যে ওয়েস্ট ওয়েল, লেড, টিসিবি ও অ্যাসবেস্টাস সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে৷ অ্যাসবেস্টাস এমন একটি জিনিস, যা বাতাসে যদি এক কণাও থাকে এবং সেটা যদি আপনি নিঃশ্বাসের সঙ্গে নেন, তবে ভবিষ্যতে আপনার ক্যানসার হতে পারে৷ এটার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই৷ জাহাজ ভাঙা শিল্প যে এলাকায় চলে, সেই উপকূলীয় এলাকায় বন সম্পূর্ণ উজার করে দেয়া হয়েছে৷ এই বনই কিন্তু একসময় প্রাকৃতিক ‘রক' হিসেবে কাজ করত সাইক্লোনের বিরুদ্ধে৷ ঐ এলাকার পানিতে কোনো মৎস সম্পদ নেই৷ মাটি এতটাই দূষিত হয়ে গেছে যে, সেখানে নতুন করে কিছু রোপণ করবেন, সেই সুযোগও নেই৷

শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে তুলতে গেলে মূলত কী কী প্রয়োজন হয়?

শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড যদি পরিবেশসম্মতভাবে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে এটা কোনোভাবেই সমুদ্রের পাড়ে হতে পারবে না৷ অথচ সেটাই আমাদের দেশে হচ্ছে৷ এটাকে আসলে হতে হবে ‘ড্রাই-ডকে'৷ তাছাড়া এ কাজটা এমন একটা জায়গায় করতে হবে, যেখানে জাহাজটা ভাঙা যাবে আবদ্ধ পরিবেশে৷ আমাদের দেশে উন্মুক্ত ‘বিচে' যে কর্মকাণ্ড চালানো হয়, সেটাকেই জাহাজ ভাঙা শিল্প বলা হচ্ছে৷ এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ ড্রাই-ডকে কন্টেইনার সুবিধা, শ্রমিক নিরাপত্তার সবরকম ব্যবস্থাসহ একটা আবদ্ধ পরিবেশে যখন জাহাজ ভাঙার কাজ হবে, একমাত্র সেটাকেই আমরা জাহাজ ভাঙা শিল্প বলতে পারব৷ এটা সমুদ্রের পাশে হতে পারে, কিন্তু পাড়ে নয়৷ যেখানে এটা ‘অপারেট' করবে সেখানে ঢালাই থাকতে হবে এবং সমস্ত দূষণকে ‘কন্টেইন' করার সুযোগ থাকতে হবে৷

এই শিল্পে কর্মীদের মৃত্যুর হার কেমন?

বাংলাদেশে প্রত্যেক মৃত্যু ‘রিপোর্টেড' হয় না৷ আমাদের হিসেব অনুযায়ী, প্রতি মাসে অন্তত তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে এ শিল্পে৷

কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা রক্ষায় বিশেষ কোনো আইন আছে কি?

আইন আছে৷ দু'টি মন্ত্রণালয় দু'টি আইন করে বসে আছে৷ পরিবেশ মন্ত্রণালয় একটি ও শিল্প মন্ত্রণালয় একটি৷  এখানে একটা জিনিস বলে রাখা ভালো যে, শ্রম মন্ত্রণালয়ের ওখানে কোনো ধরনের অস্তিত্ব নেই৷ কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তারা যায় না৷ কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে তারা মালিকদের পক্ষ নিয়ে একটা সাজানো গল্পের মতো রিপোর্ট দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ তাদের তদারকি একেবারেই নেই৷ শ্রমিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য যে ‘ডিভাইসগুলো' দেওয়ার কথা, সেগুলো শুধুমাত্র কেউ পরিদর্শনে গেলে দেওয়া হয়৷ দেখলেই বোঝা যাবে, কারণ, ওগুলো ঝকঝক করে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তার সরঞ্জাম নেই, নেই অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থাও৷ শ্রমিকদের দিয়ে সমস্ত কাজ ‘ম্যানুয়ালি' করানো হয়৷ মানে তাঁরা খালি হাতে পুরো জাহাজটা ভাঙে৷

অনেক দেশে, বিশেষ করে ভারতের গুজরাটে আমরা ইয়ার্ডের পাশে হাসপাতাল দেখেছি৷ বাংলাদেশে কি এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা আছে?

আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড একটি হাসপাতাল করেছে৷ এখানে দু'টি বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার৷ আদালত বলেছিল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অধীনে থাকবে এই হাসপাতাল৷ কিন্তু শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের মালিকরা এটা তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রেখেছে৷ আরেকটা বিষয় হলো, যখন তারা লাশগুলো তাদের নিজস্ব হাসপাতালে নিয়ে যাবে, তখন আমরা তা কিন্তু গুণতেও পারব না৷ কারণ, তখন তারা তাদের মতো করে দুর্ঘটনার কারণ সাজাবে৷ যেমন-তেমন করে চিকিৎসা দিয়ে বিদায় করে দেবে৷ গুজরাট অবশ্য গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক নীচে অবস্থান করছে৷

বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই আমরা সমালোচনা হতে দেখি, এতে কোনো কাজ হয় কি?

কিছু কিছু কাজ হয়৷ যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটা আইন করেছে৷ সেখানে তারা বলেছে, তাদের পতাকাবাহী জাহাজ উন্মুক্ত বিচে ভাঙা যাবে না৷ তাদের জাহাজগুলোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে৷ এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে ইয়ার্ডগুলোকে পরিবেশসম্মত বলে ঘোষণা করবে, কেবলমাত্র সেখানেই তাদের পতাকাবাহী জাহাজ যাবে৷ এটা বড় একটা বিজয়৷ আরেকটা বিজয় হলো, এর ফলে আপনি যা খারাপ, তাকে খারাপ বলতে পারছেন৷

অনিয়ম দূর করায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্ষমতা কতটুকু?

পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনেক ক্ষমতা৷ শ্রম মন্ত্রণালয়েরও অনেক ক্ষমতা৷ কিন্তু মুশকিল হলো, এটা শিল্প মন্ত্রণালয় ছলে-বলে-কলে-কৌশলে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে৷ পরিবেশ অধিদপ্তর যদি তাদের নিজের ‘ম্যান্ডেটের' প্রতি ন্যূনতম বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করত, তাহলে এই শিল্পে শ্রমিক মৃত্যুর হার অবশ্যই আমরা কমিয়ে আনতে পারতাম৷ এমনকি পরিবেশ দূষণের হারও হয়ত আমরা কিছুটা কমাতে পারতাম৷  

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষায় কী করা প্রয়োজন?

এই উন্মুক্ত বিচকে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন৷ বিচের মধ্যে জাহাজ ভাঙার কর্মকাণ্ড করা যাবে না৷ করতে হলে এটা ‘ড্রাই-ডকে' করতে হবে৷ যে সমস্ত জাহাজ বিদেশ থেকে আসে, সেগুলো হয় বিদেশ থেকেই পরিষ্কার হয়ে আসবে অথবা বাংলাদেশে এ সব বর্জ্য কন্টেইনারে রাখা হবে এবং পরবর্তিতে সেই কন্টেইনারগুলো আবারো বিদেশে ফেরত পাঠানো হবে৷ অন্য দেশের বর্জ্য নিয়ে শিল্প চালানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না৷ আন্তর্জাতিক আইনও তাই ‘ডিমান্ড' করে৷ 

এর বিরুদ্ধে তো আপনি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন৷ আদালত থেকে শুরু করে রাস্তার আন্দোলন পর্যন্ত৷ সেই আন্দোলনের সর্বশেষ অবস্থা কী?

সর্বশেষ দু'টি মন্ত্রণালয় দু'টি বিপরীতধর্মী বিধিমালা করে রেখেছে৷ শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই, তাই এতে প্রমাণিত হয়৷ আর সর্বশেষ শিল্প মন্ত্রণালয় একটা আইন করে কেবিনেটে দিয়েছে৷ আইনটি কোনোভাবেই আদালতের নির্দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়৷ এই আইনটি এমন একটি আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে হচ্ছে, যে আইনটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রয়োজনীয় সমর্থনের অভাবে কার্যকরই হয়নি৷ এখন এমন একটা অন্যায়কে আইনগত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে রাজনৈতিক পর্যায় থেকে৷ আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, শ্রমিকদের ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার জন্য৷ আদালতের আদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন বা বিধিমালা যাতে না হয়, সেজন্য বিষয়টা আমরা আদালতের নজরে আনারও চেষ্টা করছি৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য