1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বার বার ছাড় পেয়ে জেএমবি ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলা চালায়

১৫ আগস্ট ২০২২

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ৬৩ জেলায় একযোগে সাড়ে চার শতাধিক বোমা ফাটিয়ে দেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

https://p.dw.com/p/4FWrn
অপ্রত্যাশিতভাবে নয়, বরং এমন হামলা অনেকটা প্রত্যাশিত ছিল
অপ্রত্যাশিতভাবে নয়, বরং এমন হামলা অনেকটা প্রত্যাশিত ছিলছবি: DW/H. U.R.Swapan

প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল্টে ইসলামি আইন বাস্তবায়নের আহবানসম্বলিত প্রচারপত্র ছড়ানো হয় বিস্ফোরণস্থলে। মানুষের তৈরি আইন বাতিল করে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা না করলে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার হুমকিও প্রদান করে সংগঠনটি। হামলায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কম হলেও এর ব্যাপকতা ছিল অনেক বেশি। এমন হামলা বিশ্বে চমক সৃষ্টি করে। অনেকে প্রশ্ন করেন কিভাবে জেএমবি এমন হামলা করতে পারে। অনেকে এটাকে অপ্রত্যাশিত বলেও মনে করেন।

অপ্রত্যাশিতভাবে নয়, বরং এমন হামলা অনেকটা প্রত্যাশিত ছিল। কেননা, ২০০১ সাল থেকে একের পর এক হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটালেও জেএমবির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অনেক বার সুযোগ পেয়েও সরকার এদের ছাড় দিয়েছে। গোপনে এবং প্রকাশ্যে জেএমবির নেতাকর্মীদের মদত দেয়া হয়েছে। ফলে জঙ্গি সংগঠনটি ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে বড় হামলার পরিকল্পনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটে ১৭ আগস্টের বোমা হামলা।

এই বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের বেশ পেছনে ফিরে যেতে হবে।

সৌদি আরবে শিক্ষিত ও জিহাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ আব্দুর রহমান (পরে শায়খ আব্দুর রহমান নামে পরিচিত) বাংলাদেশে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে একটি সংগঠন তৈরি করে যার নাম দেয়া হয় জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ। এজন্য তিনি মাদ্রাসাভিত্তিক ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করে দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরিও কাজ শুরু করেন। সে সময় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি, বাংলাদেশ বা হুজিবি নামের আরেকটি জঙ্গি সংগঠন দেশের কয়েকটি স্থানে বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করে। এসব ঘটনা শাখাকে উদ্বুদ্ধ করে। হুজিবির সাথে পাল্লা দিতে জেএমবিও হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

জেএমবি প্রথম হামলা চালায় ২০০১ সালে শায়খের নিজ জেলা জামালপুরে ধর্মান্তরিত দুইজন খি্রস্টান ধর্মাবলম্বীকে জবাই করে হত্যার মধ্য দিয়ে। তবে সংগঠনটির তৎপরতা সম্পর্কে জানা যায় এর আগের বছরের শুরুতে। পার্বতীপুরের এক গ্রামে বোমাসহ ১০/১২ জেএমবি সদস্যকে ধরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে গ্রামবাসীরা। সংগঠনের এহসা্র সদস্য সাহাবুলের নেতৃত্বে তারা বিস্ফোরক তৈরির উপর প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্যে ঐ গ্রামে যায়। এক বছর পর মামলাটি খারিজ হয়ে গেলে সকলেই জেল থেকে ছাড়া পায়।

২০০১ এর মাঝামাঝি আরেকটি ঘটনা ঘটে রাঙ্গামটিতে। এক হোটেল রুমে বোমা বিস্ফোরণ হলে জেএমবির মজলিসে সুরা সদেস্য নাসরুল্লাহ নিহত হয় এবং এহসার সদেস্য শামিম আহত হয়। শামিম গ্রেফতার হলেও পরে জামিনে বেরিয়ে যায়।

শুরুতে ছোটখাট হামলা চালালেও ক্রমান্বয়ে তাদের হামলার ব্যাপকতা বাড়তে থাকে। এর অন্যতম কারণ ছিল সে সময়ের অনুকুল রাজনৈতিক পরিবেশ।

জেএমবি আরেকটি হামলা চালায় বাগেরহাট জেলায় ২০০২ সালের ১৬ আগস্ট। ঐদিন সংগঠনের কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গি সংখ্যালঘু নেতা তারাপদ পোদ্দারকে হত্যার চেষ্টা করে। ব্যর্থ ঐ হামলার পর বাংলাভাইসহ পাঁচ জঙ্গি নেতাকে এলাকাবাসি আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। তবে সকলেই জামিনে বেরিয়ে আসে এবং পরের মাসেই হামলা চালায় পার্শ্ববর্তী সাতক্ষীরা জেলায়। ২৮ সেপ্টেম্বর জেলার ঐতিহ্যবাহী গুড়পুকুরের মেলার সার্কাস প্যান্ডেলে ও শহরের রক্সি সিনেমা হলে বোমা হামলায় অর্ধশতাধিক আহত হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে মারা যায় ৩ জন।

জঙ্গি দলটি বড় একটি হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় ২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর। সেদিন ময়মনসিংহ শহরের চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা ফাটলে ১৯ জন নিরীহ মানুষ মারা যায় এবং শতাধিক আহত হয়। জঙ্গিদের আটক না করে তখনকার বিএনপি-জামাত জোট সরকার আওয়ামী লীগের নেতাদের আটক করে হয়রানি করে।

জঙ্গি সংগঠনটির হামলার মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ময়মনসিংহের সিনেমা হলে হামলার প্রায় দেড় মাস পর জেএমবি হানা দেয় জয়পুরহাটের কালাই থানার বেগুনগ্রামে এক পীরের আস্তানায়। ২০০৩ এর ১৯ জানুয়ারি মধ্য রাতে ধারাল অস্ত্র দিয়ে তারা পাঁচ খাদেমকে জবাই করে হত্যা করে আস্তানা থেকে নগদ ২০ লক্ষ টাকা লুট করে নিয়ে যায় একদল জঙ্গি। সংগঠন ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা এবং অস্ত্র গোলাবারুদ কেনার জন্যে জেএমবির বড় অংকের অর্থের প্রয়োজন ছিল। জঙ্গিদের না ধরতে পারলেও পুলিশ সাধারন গ্রামবাসীদের ধরে আসামি করে।

অবশ্য জেএমবি সব চেয়ে সাহসী হামলা চালায় ২০০৩ সালের ১৪ অগাস্ট জয়পুরহাটের খেতলাল উপজেলার উত্তর মহেশপুর গ্রামে। পুলিশের একটি দল ওই গ্রামের এক বাড়িতে অভিযানে গেলে জেএমবির নেতাকর্মীরা হামলা করে পুলিশের তিনটি অস্ত্র, একটি ওয়্যারলেস সেট ও বেশ কিছু গুলি ছিনিয়ে পালিয়ে যায়। জেএমবি জেলা কমান্ডারদের নিয়ে আঞ্চলিক সভার আয়োজন করেছিল। মজার ব্যাপার হল বাংলাভাইসহ জেএমবির অনেক নেতাকর্মী আটক হলেও পুলিশের গাফেলতি আর বিএনপি-জামাতের জোট সরকারের কিছু নেতার বদৌলতে কয়েক মাসের ব্যবধানে তারা জামিনে বেরিয়ে আবার তৎপরতা শুরু করে।

জামিনে মুক্তি ও শাস্তি না হওয়া জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। পুলিশ, প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা তাদের সাহসী করে তোলে। এছাড়াও নেতাদের মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস জন্মে যে তারা কিছু রাজনৈতিক নেতাদের পাশে পাবে। শায়খ রহমান, বাংলাভাই ও শীর্ষ নেতারা সিদ্ধান্ত নেয় গোপন তৎপরতার কৌশল থেকে বের হয়ে প্রকাশ্যে অভিযান চালাবে। এজন্যে তারা রাজশাহীর বাগমারা, নওগাঁ জেলার রানীনগর ও নাটরের নলডাঙ্গাকে ঘিরে বিশাল এলাকা বেছে নেয়। ঐ জেলার বিএনপি ও জামাতের নেতারা আশ্বাস দেয় যে পুলিশ-প্রশাসন তাদের সহায়তা করবে। সর্বহারা নিধনের নামে ২০০৪ সালের এপ্রিলে প্রকাশ্যে অভিযান শুরু করে জেএমবির বড় একটি দল। সংগঠনের অন্যতম শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইয়ের নেতৃতে মানুষদের ধরে এনে, গাছের সাথে উল্টাভাবে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে ২২ জনের মৃত্যু ঘটে, অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করে।

জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের এহেন অবৈধ, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে সে সময়ের বিএনপি-জামাত সরকার শুধু নীরব সমর্থন দিয়েছে তাই নয়, বরং তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে তাদের রক্ষা করেছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জেএমবি ক্যাডাররা দিনরাত অভিযান চালালেও তখনকার প্রশাসন বাধা দেয়নি।

প্রকাশ্য অভিযানে সাফল্য জেএমবি নেতাদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়। তারা এবার সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

উল্লেখিত ঘটনাগুলো ছাড়াও ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টে মধ্যে জেএমবি ছোটবড় আরও কয়েকটা হামলা পরিচালনা করে। কিন্তু এসব হামলা ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সঠিক তদন্ত করা হয়নি। সরকার বা পুলিশ-প্রশাসন এসব ঘটনাকে গুরুত্বসহকারে নেয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সহযোগিতা পরবর্তীতে হামলার সুযোগ করে দেয়। ফলে জেএমবি এক ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠনে পরিনত হয়। আর এর ফলেই জেএমবি দেশব্যাপী বোমা হামলার মত ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হয়।

আওয়ামী লীগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) জেএমবির প্রতিষ্ঠা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তার লাভ করলেও মূলত পরবর্তী বিএনপি-জামাত জোট সরকারের পাঁচ বছরে সংগঠনটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত হামলা চালিয়ে যায়। ১৭ আগস্টের বোমা হামলার পর সরকারের টনক নড়ে, দেশ-বিদেশের চাপে জেএমবিকে নিষিদ্ধ করে ধরপাকড় শুরু করলেও হামলা থামানো যায়নি। আদালত ও পুলিশ-বিচারকদের লক্ষ্য করে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে অনেককে হত্যা করা হয়। মদত না দিয়ে শুরুতেই সরকার যদি জেএমবির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলে এই অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারতো না আর ১৭ আগস্টের মত হামলা করার সুযোগ পেত না।