1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বানের পানিতে অসহায় জার্মানি

১৬ জুলাই ২০২১

ঘুম থেকে উঠে মোবাইল হাতে নিতেই ফেসবুকে একটি নোটিফিকেশন এলো৷ ফেসবুক জানতে চেয়েছে আমি আশেপাশের কাউকে আশ্রয়, খাবার, কাপড় দিয়ে সাহায্য করতে পারি কিনা৷

https://p.dw.com/p/3wZQS
Deutschland l Unwetter in Nordrhein-Westfalen l Schäden in Bad Münstereifel
ছবি: B&S/dpa/picture alliance

বন শহরে অবশ্য এখনও পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো, কিন্তু আশেপাশের অনেক গ্রাম-শহরে অবস্থা খুবই ভয়াবহ৷ অনেক জায়গায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে৷

বন শহরে ডয়চে ভেলের ঠিক পেছনেই বয়ে গেছে রাইন নদী৷ কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হলে গ্রীষ্মকালের সুন্দর আবহাওয়া উপভোগ করতে প্রায়ই সহকর্মীরা নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতেই বাড়ির পথে এগোই৷ টানা কদিন বৃষ্টির পর বৃহস্পতিবার বেশ রোদ ওঠায় সে পথে আগোতেই চোখে পড়লো রাস্তার মুখে নতুন এক সাইনবোর্ড৷ তাতে লেখা- Hochwasser, আক্ষরিকভাবে বললে অর্থ দাঁড়ায়- উঁচু পানি৷

নদীর পাড় দিয়ে যে রাস্তা গেছে সেটি অর্ধেক ডুবে গিয়েছে, বাকিটুকুও আরেকটু বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে৷

বনের মতো অন্য শহরগুলো অবশ্য এতটা সময় পায়নি৷  জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি রাজ্য, বিশেষ করে নর্থ-রাইন ওয়েস্টফালিয়া এবং রাইনল্যান্ড পালাটিনেট ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ একদিকে পাহাড়ে ভূমিধসের কারণে বাড়িঘর ভেঙে গেছে৷ অন্যদিকে এত দ্রুত পানির ঢল নেমে এসেছে যে বিভিন্ন গ্রাম-শহরের স্বাভাবিক নিষ্কাষণ ব্যবস্থা সেটা সামলাতে পারেনি৷ ফলে রাস্তাঘাট ভেসে গিয়েছে তুমুল স্রোতে৷

জার্মানি বাংলাদেশের মতো ষড়ঋতুর দেশ নয়৷ এখানে ঋতু চারটি- গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত এবং বসন্ত৷ শীতকালে এমন পরিস্থিতি প্রায়ই হয়৷ একদিকে দিনভর মুখ গোমড়া করে আকাশ পিনপিন করে জল ঝরাতে থাকে, অন্যদিকে পাহাড়ি এলাকার বরফগলা পানি ধীরে ধীরে রাইনের উচ্চতা বাড়িয়ে তোলে৷ রাইনের পাড়ে যে সমস্ত এলাকা অপেক্ষাকৃত নীচু, তা ডুবে যায়৷

অনেকদিন ধরে আমার আক্ষেপ ছিল যে বাংলাদেশের মতো ঝরঝর মুখর বাদল দিন জার্মানিতে দেখা যায় না৷ কিন্তু এবার গ্রীষ্মকালে যে বৃষ্টি হলো, তা বাংলাদেশের মতোই৷ তবে সমস্যাটা এক জায়গাতে৷ বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে এই বৃষ্টির চাপ নিতে সক্ষম, অবকাঠামো এবং মানুষের প্রস্তুতিও একটি বড় ব্যাপার৷ একের পর এক ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার ফলে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও পারদর্শী হয়ে উঠেছে৷

কিন্তু জার্মানি এবং আশেপাশের কয়েকটি দেশে অবস্থা ঠিক উল্টো৷ এবার যে বন্যা হয়েছে, তাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কেবল জার্মানিতেই শতাধিক মানুষ মারা গেছেন৷ নিখোঁজ রয়েছেন হাজারের বেশি মানুষ৷ উন্নত একটি দেশে এমন অবস্থা কেন হলো যে উদ্ধারকাজে দমকলের পাশাপাশি সেনাবাহিনীও নামাতে হলো?

কেউ বলছেন গত ১৫ বছর, কেউ বলছেন ৩০ বছরের মধ্যে এমন বৃষ্টি জার্মানিতে হয়নি৷ এখানকার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বাড়িঘর, সবই প্রস্তুত করা হয় শীতকালে বরফ ও ঠান্ডা ঠেকানোর জন্য৷ শহরের বাইরে কংক্রিটের বহুতল বাড়িঘরও খুব কম দেখা যায়৷ কাঠের তৈরি ঘরে টালি দিয়ে চাল এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে চালের ওপর বরফ না জমে৷

আমি বনের ওবারকাসেল নামে একটি গ্রামে থাকতাম, যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ বাড়িই কয়েকশ বছরের পুরাতন এবং সেগুলোতে স্থানীয় প্রশাসনের Denkmal অর্থাৎ ‘ঐতিহ্য' চিহ্নিত সাইনবোর্ড লাগানো৷ একটি বাড়ি তো ছিল ১৬৩৫ সালের৷ গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়িই হয় এমন পুরাতন, নয়তো নতুন হলেও কাঠের তৈরি৷ ফলে তীব্র স্রোতসহ জল যখন নদী-খাল ছাপিয়ে গ্রাম-শহরের রাস্তায় ছুটে গেলো, অনেক বাড়িই সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে একেবারে উপড়ে যায়৷

HA Asien | Anupam Deb Kanunjna
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

জার্মান এক টিভিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে এক বৃদ্ধার বক্তব্য শুনছিলাম৷ তিনি বলছিলেন, ধীরে ধীরে তার বাড়ির নীচতলা যখন ভেসে যায়, স্বামীকে নিয়ে দোতলায় আশ্রয় নেন৷ এরপর স্রোত কিছুটা থামলে তার প্রতিবেশী বাড়ি থেকে নেমে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা বলেন৷ প্রতিবেশী নেমে গেলেও তার নামতে একটু দেরি হচ্ছিলো৷ ঠিক কয়েক মিনিট পর কয়েক ফুট উঁচু পাহাড়ি মাটিমিশ্রিত ঘোলা জল আবার রাস্তা ভাসিয়ে নিয়ে যায়৷ রাস্তায় পার্ক করে রাখা গাড়িসহ তার প্রতিবেশীও ভেসে যান৷ এখনও তার খোঁজ মেলেনি৷ বৃদ্ধা বলছিলেন, 'মাত্র দুই মিনিটের জন্য বেঁচে গেলাম৷'

অনেক গ্রামে কয়েকটি বাড়িঘর ছাড়া সব ভেঙে গেছে, রাস্তা-ব্রিজ উপড়ে গেছে৷ সব মিলিয়ে কেমন ক্ষতি হয়েছে তা জানতে আরো সময় লাগবে৷ তবে অবকাঠামো এবং সাধারণ মানুষের সব ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এই করোনা মহামারীর মধ্য়ে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে৷

গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি এবং জুন মাসেও বরফ পড়ার মতো অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে এ বছর৷ জার্মানির প্রায় কোনো বাসা বা অফিসেই সিলিং ফ্যান বলে কিছু নেই৷ এমনকি শীতকালে ঠান্ডা আটকানোর জন্য দেয়ালে বাতাস চলাচলের জন্য ভেন্টিলেটরও নেই৷ কিন্তু গত কয়েক বছর গ্রীষ্মকালে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠছে৷ ফলে ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানে এখন টেবিল ও স্ট্যান্ড ফ্যান কেনার জন্য ক্রেতারা আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখেন৷

বিজ্ঞানীরা বলছেন, আবহাওয়ার এমন উগ্র হয়ে ওঠার পেছনে দায়ী হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন৷ জার্মানি একটি ভারি শিল্পনির্ভর দেশ৷ অন্য অনেক দেশের তুলনায় এখানে উষ্ণতাও অপেক্ষাকৃত দ্রুত বাড়ার সুযোগ রয়েছে৷ নগরায়নের ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মাটির জল শুষে নেয়ার ক্ষমতাও কমছে৷ ফলে এমন ঘটনা ভবিষ্যতে ঘটতেই থাকবে, এমন আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে৷