1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের ব্যাংকখাত কতটা ঝুঁকির মধ্যে?

২ ডিসেম্বর ২০২২

বাংলাদেশের ব্যাংকখাত বিভিন্ন সময়ই আলোচনায় থেকেছে নানা ধরণের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে৷ এসব অনিয়ম-দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো যেমন লোকসান দিয়ে যাচ্ছে, তেমন বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংককে দুর্বল করেছে৷

https://p.dw.com/p/4KO9q
জনতা ব্যাংক
অনিয়মের ছদ্মাবরণে লুটপাটের মাধ্যমে ঠিক কত টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেড়িয়ে গেছে তার প্রকৃত হিসেব পাওয়া কঠিন৷ছবি: Mortuza Rashed/DW

তারপরও ২০০৬ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক ছাড়া আর কোনো ব্যাংকে লালবাতি জ্বলেনি৷ আসলে ওরিয়েন্টাল ব্যাংককেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রশাসক বসিয়ে ও পরবর্তীতে বেশির ভাগ শেয়ার বিক্রি করে নতুন মালিকানায় আইসিবি ইসলামী ব্যাংক নামে জিইয়ে রেখেছে৷ বলা যায়, কোনো ব্যাংকে লালবাতি জ্বলতে দেয়া হয় না, বরং বিভিন্নভাবে ঠেকা দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়৷ যেমন, ২০১৩ সালে চালু হওয়া ফারমার্স ব্যাংক অল্প সময়ের মধ্যে নানা ডুবতে বসেছিল সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে৷ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার তখন হস্তক্ষেপ করে৷ তাই ২০১৮ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও রুপালী ব্যাংক মিলে ৭১৫ কোটি টাকায় ফারমার্স ব্যাংকের ৬০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়৷ ব্যাংকের নাম বদলে হয় পদ্মা ব্যাংক৷

সম্প্রতি দেশের ব্যাংকখাত ঘিরে আবার জোর আলোচনা শুরু হয়েছে৷ বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিনটি ব্যাংক থেকে ঠিকঠাক কাগজপত্র-দলিলাদি ছাড়া ও যাচাই-বাছাই ব্যাতিরেকে বেনামী ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে অন্তত নয় হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার খবর আসায় সবাই যেন নড়েচড়ে বসেছে৷ এই খবরের জের ধরে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে আসছে নানা উদ্বেগজনক তথ্য আর বিভিন্ন ব্যাংকের নাজুক অবস্থার চিত্র৷

বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো নয় হাজার কোটি টাকার অনিয়মের সোয়া সাত হাজার কোটি টাকা ঘটেছে ইসলামী ব্যাংকে৷ এই ব্যাংকটির বাংলাদেশের বেসরকারিখাতের সবচেয়ে বড় ও সুসংহত ব্যাংক হিসেবে সুনাম রয়েছে৷ ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক আর্থিক লেনদেন তথা ব্যাংকিং-য়ে বাংলাদেশে পথিকৃত হিসেবে ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করা ব্যাংকটি অতীতে কখনোই বড় ধরণের কোনো অনিয়মের মধ্যে পড়েনি৷ তবে একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তথা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যাংকটির সংশ্লিষ্টতা বারবারই আলোচনায় এসেছে৷ এর জের ধরে কখনো কখনো জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগও উঠেছে৷ বলা যায়, এই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ‘জামায়াতমুক্ত’ করতে ব্যাংকটির মালিকানা, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটানো হয়৷ তাতে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি বড় শিল্প গোষ্ঠীর প্রায় একক মালিকানায় চলে যায় ইসলামী ব্যাংক৷ এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ ও সমালোচিতও হয়৷

মূলত এরপর থেকে ধীরে ধীরে ব্যাংকটির অবস্থার অবনতি হওয়া শুরু করে বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে খবর আসতে থাকে৷ ব্যাংকটির বিদেশি মালিকরা তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেন৷ শেয়ার ছেড়ে দেন দেশীয় প্রতিষ্ঠাতারাও৷ ব্যাংকটিও তার বহু পুরোনো বড় বড় গ্রাহক হারায়৷

আপাত দৃষ্টিতে এটিকে কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করলেও বাস্তবতা তা বলে না৷ বরং, এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়ে যে গত এক যুগে দেশের ব্যাংকখাতে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা যে নতুন ও বিপজ্জনক এক মাত্রায় উপনীত হয়েছে৷ কেননা, এই সময়কালে ব্যাংকখাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণের নামে যেভাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে, তাকে কড়া ভাষায় লুটপাট বললে খুব ভুল হয় না৷

সরকারি খাতের সবচেয়ে ভাল ব্যাংক হিসেবে খ্যাতি ছিল বেসিক ব্যাংকের৷ ছোট পরিসরে লাভজনক ভাবে চলছিল ব্যাংকটি৷ ২০০৯ সালে সরকারদলীয় ঘনিষ্ঠ শেখ আবদুল হাই বাচ্চু এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হন৷ তারপর থেকে শুরু হয় অনিয়ম৷ প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ধরে পড়ে ব্যাংকটিতে৷ দুর্নীতি দমন কমিশন মোট ৬১টি মামলা করলেও সাবেক চেয়ারম্যানকে আসামী করা হয়নি যদি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তাঁকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছে বেসিক ব্যাংক ডুবানোর জন্য৷ সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও জাতীয় সংসদে বলেছিলেন যে ঋণ জালিয়াতিতে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল৷

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে মোটামুটি একটি অভিন্ন ছকে গত এক যুগে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিরাট অংকের টাকা তুলে নেয়া হয়েছে৷ ছকটি এরকম: বেনামী, সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ও কাগুজে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ অনুমোদন করা; সরকারঘনিষ্ঠ ও সরকারদলীয় লোকজনকে পরিচালনা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা; ঋণ অনুমোদন ও প্রদানে অনিয়মকে বৈধতা দিতে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ওপর বিভিন্ন ধরণের প্রলোভন ও হুমকি তৈরি করা; এবং অনিয়ম বিষয়ে নজরদারি থেকে বিরত থাকতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা৷

এর প্রতিটিই বেশ সাফল্যের সাথে করা হয়েছে৷ এর ফলে গত এক যুগে রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংক থেকে হল-মার্ক সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে৷ বেসিক ব্যাংকের কথা আগেই বলা হয়েছে৷ এছাড়া কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক থেকেও হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে৷ 

অনিয়মের ছদ্মাবরণে লুটপাটের মাধ্যমে ঠিক কতো টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেড়িয়ে গেছে তার প্রকৃত হিসেব পাওয়া কঠিন৷ বিভিন্ন সূত্রে ধারণা করা হচ্ছে যে এর পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে৷ এও অভিযোগ আছে, এসব টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে৷ আর বাকীটা দেশেই কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে রয়ে গেছে৷ মাঝখান থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে৷

এমতাবস্থায় ইসলামী ব্যাংকে ঋণের অনিয়ম ঘটিয়ে কয়েক হাজার কোটি তুলে নেয়ার ঘটনায় জনমনে ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের বিষয়ে বেশ আতংক তৈরি হয়েছে৷ সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাংক মালিক ও ব্যাংকারদের সংগঠনের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে যে ব্যাংকে টাকার কোনো সংকট নেই এবং আমানতকারীদের ভীত হওয়ার কিছু নেই৷ তারা সবাই মিলে আমানতকারীদের আশ্বস্ত করতে চাইছেন যে ব্যাংকে তাদের গচ্ছিত টাকা নিরাপদে আছে এবং তা তুলতে বা ফেরত পেতে কোনো সমস্যা হবে না৷

মুশকিল হলো, এ ধরণের আতংক ছড়িয়ে পড়লে তা ব্যাংক ও আর্থিকখাতের জন্যতো বটেই, দেশের জন্যও ক্ষতিকর৷ এর আগে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এন্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডে টাকা রেখে আমানতকারীরা বিপদে পড়েছেন৷ তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না এখনো৷ বরং বিআইএফসি ও পিপলস লিজিং থেকে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে নানা অনিয়ম-জালিয়াতির মাধ্যমে৷

আসজাদুল কিবরিয়া, সাংবাদিক
আসজাদুল কিবরিয়া, সাংবাদিকছবি: Privat

এমতাবস্থায় ব্যাংকগুলোর ওপর আমানতকারীরা যদি আস্থা হারাতে শুরু করে, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী৷ মানুষ তাদের কষ্টার্জিত টাকা তাহলে নিরাপদে কোথায় রাখবে? – এই প্রশ্নও এখন উচ্চারিত হচ্ছে৷ নিজের ঘরে বা সিন্দুকে নগদ টাকা রাখা বাস্তবসম্মত কোনো বিষয় না যদিও কিছু মানুষ তা রাখেন৷ তবে তাদের টাকার পরিমাণ অনেক বেশি এবং টাকার বেশিরভাগ উৎসেই অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ৷

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে লোপাট করে যারা সরিয়ে নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ এমন দৃষ্টান্তও তৈরি করা যায়নি যে এরকম অনিয়ম বা লুটপাট করলে কোনো ছাড় মিলবে না৷ কতিপয় ব্যাংক কর্মকর্তা শাস্তি ভোগ করলেও অনিয়মের মূল সুবিধাভোগী রাঘববোয়াল ব্যক্তি-গোষ্ঠী প্রায় সবাই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে৷  এতে করে ব্যাংক তথা আর্থিকখাত বড় ধরণের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে যা সময়ে সময়ে বিভিন্নভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে৷

এ বছরের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০২১ (ফাইনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট) প্রকাশ করে৷ এই প্রতিবেদনে সার্বিকভাবে দেশের ব্যাংকখাত তেমন কোনো ঝুঁকির মধ্যে নেই বলে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে৷  বলা হয়েছে যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ধরণের আঘাত মোটামুটি সামলে নেয়ার সক্ষমতা রাখে৷ তবে এও স্বীকার করা হয়েছে যে কয়েকটি ব্যাংকে বড় বড় ঋণ গ্রহীতা ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগজনক৷ এর মানে হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিকই জানে যে ব্যাংকখাত আসলে কতোটা ঝুঁকির মধ্যে আছে, কেন আছে৷ কিন্তু  এই ঝুঁকি তৈরি হওয়া ও বছরের পর বছর তা বাড়তে দেয়ার দায় কি বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারে? একইভাবে তা এড়াতে পারে না অর্থমন্ত্রণালয়ও৷