1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে চাকরির বাজারে জগাখিচুড়ি অবস্থা

মাসুদ কামাল
৩ জানুয়ারি ২০২০

আমার এক বন্ধু টানা অনেকদিন বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরেছেন৷ ঠিক ফিরেছেন নয়, বরং বলা যায় বেড়াতে এসেছেন৷ আমরা গুলশানের দিকে যাচ্ছিলাম৷

https://p.dw.com/p/3VfY2
ছবি: Abdur Razzaque

মহাখালি বাস টার্মিনালের পাশ দিয়ে গুলশানের লিংক রোডে ঢুকতেই আমাদের গাড়ির গতি কমে গেল৷ প্রায় পুরো রাস্তাজুড়ে মানুষের স্রোত, তারা হেঁটে যাচ্ছে৷ কোনো রাজনৈতিক দলের মিছিল নয়, কোন স্লোগান বা হইচই নেই৷ তবে তারা যে একেবারে চুপচাপ তাও নয়, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে, কথা বলতে বলতেই হাঁটছে৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পদচারীদের বেশির ভাগই নারী! তখন অন্ধকার নেমে এসেছে, কিন্তু হাঁটতে থাকা সেই নারীদের পদক্ষেপে নেই কিছুমাত্র জড়তা৷

বন্ধুটি বললো- এরা নিশ্চয়ই গার্মেন্টস কর্মী?

প্রশ্ন করলো বটে, তবে আমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলো না৷ বলতে থাকলো- এদের স্টেপিংগুলো দেখেছো? কী দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে! যেন ওরা কাউকেই তোয়াক্কা করে না, কে কী বললো- তাতে ওদের কিছু যায় আসে না৷ ওরা যে কারও মুখাপেক্ষী নয়, নিজের পায়েই দাঁড়াতে শিখেছে, কারও সাহায্য ছাড়াই চলতে পারে, এটা তাদের প্রতিটা স্টেপেই প্রকাশ পাচ্ছে৷ মেয়েদের এই যে আত্মবিশ্বাসী পদচারণা, দেশের এই পরিবর্তনটাই গুরুত্বপূর্ণ৷

এটি বেশ কয়েক বছর আগের কথা৷ এরপর বহুবার রাস্তায় আমি ওই মেয়েদের দেখেছি৷ কখনো কারখানায় যাচ্ছে, আবার কখনোবা ফিরছে৷ প্রতিবার বন্ধুর ওই কথাগুলো মিলিয়ে নিতে বেশ মনোযোগ দিয়েই ওদের দিকে তাকিয়েছি৷ তাদের পোশাক, মুখের ভাব এবং সর্বোপরি সেই বিখ্যাত দৃপ্ত পদক্ষেপ সবই খেয়াল করেছি৷ দেখে দেখে মুগ্ধ হয়েছি, আশাবাদী হয়েছি৷ মেয়েরা যদি এভাবে বের হয়ে আসতে পারে, চাকরিতে ঢুকতে পারে, তাহলে জাতি হিসাবে আমাদের পিছিয়ে থাকার আশঙ্কা কমে যায়৷

আবার সেই সঙ্গে কিছু প্রশ্নও জেগেছে মনে৷ আচ্ছা, এদের মধ্যে সিংহভাগই নারী কেন? পোশাক কারখানাগুলোতে এরা যে ধরনের কাজ করে, তা কি কেবলই নারীদের জন্য নির্ধারিত? ছেলেরা করতে পারে না? নাকি কারখানা মালিকেরাই এসব কাজ নারীদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে? সেটাই বা তারা কেন দেবে- এ কাজগুলো নারীরা ভালো পারে, তাই? নাকি নারী শ্রমিক সহজলভ্য বলে? 

নারী শ্রমিক যদি সহজলভ্যই হবে তাহলে নারী-পুরুষের এই অনুপাত সরকারি বা অন্য চাকরিতে দেখা যায় না কেন? সবশেষ যে হিসাব প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় সরকারি চাকরিতে নারী রয়েছে তিনভাগের এক ভাগেরও কম, মাত্র ২৭ শতাংশ৷ এর কারণ যে দারুন কিছু জটিল, তা নয়৷ সাধারণ যুক্তিতে অস্বাভাবিক মনে হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষিত নারীর জন্য আমাদের দেশে চাকরির সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম৷ তত্ত্বগতভাবেই যে কম, তা হয়তো নয়৷ কিন্তু চাকরি পাওয়ার পর নারীরা যে পরিবেশটি পান, সেটি অনেক সময়ই তার অনুকূলে থাকে না৷ যে নারী চাকরি করেন, তাকে কিন্তু একই সময়ে নিজের সংসারটিও দেখতে হয়৷ রান্নাবান্না, সন্তান লালন পালন করতে হয়৷ এসব জটিলতার কারণে অনেক নারী নিজে থেকেই আর চাকরিতে আগ্রহী হন না৷

নেতিবাচক এই বাস্তবতা বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও রয়েছে৷ পুরো তিন দশক ধরে আমি সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত৷ মিডিয়ার মত অগ্রসর একটা পেশাতেও দেখেছি সেই পশ্চাৎপদ চিন্তার প্রতিফলন৷ একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি৷ একবার এরকম এক নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম৷ প্রক্রিয়াটির শুরুতেই দেখলাম মালিক পক্ষ থেকে নির্দেশনা এলো, কোন নারীকে যেন না নেয়া হয়৷ বিস্মিত হলাম, কারণ জানতে চাইলাম৷ অজুহাত শুনে আমি হতভম্ব৷ তারা বললেন, নারী রিপোর্টার নিলেই দেখা যাবে, কিছুদিন পরই সে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে, তখন তাকে ছয় মাস মেটার্নিটি লিভ দিতে হবে৷ ছয় মাস বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেয়াটাই তো আবার শেষ নয়৷ ওই ছয় মাস অফিস চলবে কি করে? আবার নতুন একজনকে নিতে হবে৷

এ ধরনের যুক্তি শুনতে যত অদ্ভুতই ঠেকুক না কেন, বাস্তবতা হলো সেবার আমরা কোনো নারী রিপোর্টারকে নিয়োগ দিতে পারিনি৷

একই ধরনের মানসিকতা দেখা যায় প্রতিবন্ধীদের চাকরির ক্ষেত্রেও৷ নিয়োগকর্তারা অনেক ক্ষেত্রেই কাজ বা যোগ্যতা নয়, প্রার্থীর শারীরিক অবয়বকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন৷ প্রতিবন্ধীদের চাকরি দেয়ার বাধ্যবাধকতা বিষয়ে সরকারের কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে, তবে তা বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তেমন একটা পালিত হতে দেখা যায় না৷ আর প্রতিবছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একটি প্রতিবন্ধী চাকরি মেলা হয়৷ কিন্তু সেখান থেকে দুতিনশ'র বেশি চাকরি হয় বলে শুনিনি৷ তারও চেয়ে বড় কথা, মিডিয়ায় প্রচারণা পেতে যারা ঢাকঢোল পিটিয়ে দু'একজন প্রতিবন্ধীকে চাকরি দেন, মাস কয়েকের মধ্যে কাজ না পারার অজুহাতে তাদেরকে আবার ছাঁটাইও করে দেয়া হয়৷ 

পৃথিবীর অনেক দেশেই সংখ্যালঘুরা চাকরির ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়৷ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এনিয়ে অনেক অভিযোগ উচ্চারিত হতে দেখি৷ বিশেষ করে সিএএ, এনআরসি নিয়ে এখন সেখানে যা চলছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে মুসলিমদের চাকরির সুযোগ আরও বেশি সংকুচিত হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ বাংলাদেশে এ বিষয়টি একেবারেই নেই৷ উলটা অনেকের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংখ্যালঘুরা চাকরির ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে৷ এ ধরনের মন্তব্যকে আমিও দীর্ঘদিন ‘সুইপিং কমেন্ট' বলেই মনে করতাম৷ কিন্তু গেল বছরের মাঝামাঝি খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি মন্তব্যে সে ভুল ভেঙে গেল৷ তখন ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে প্রিয়া সাহার অভিযোগকে কেন্দ্র করে বেশ হইচই হচ্ছিল৷ প্রিয়া সাহার অভিযোগ যে সত্য নয়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা যে মোটেই বঞ্চিত হচ্ছে না সে বিষয়ে বলতে যেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোমেন সাহেব এটা পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছিলেন৷ জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ২৫ শতাংশ পদে সংখ্যালঘুরা রয়েছে৷ এ হিসাবটি আসলেই অবাক হওয়ার মত৷

সে কারণেই, বঞ্চনা কিংবা পক্ষপাতিত্বের কথা যদি ওঠে, তাহলে বলতে হবে যে, বাংলাদেশে চাকরির ক্ষেত্রে সেটা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়৷ এটা বেশি দেখা যায় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে৷ নানা সুযোগ সুবিধার কারণে বাংলাদেশে সরকারি চাকরি এখন অতি লোভনীয় ‘সোনার হরিণে' পরিণত হয়েছে৷ এই যে সরকারি চাকরি নামের লটারি, এটি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গই হচ্ছে রাজনৈতিক আনুগত্য৷ যে দল ক্ষমতায় থাকবে, তারা বিরোধী রাজনৈতিক বিশ্বাসের কাউকেই চাকরি দেবে না৷ এখানে প্রার্থীর যোগ্যতা নিয়ে কোন আলোচনাই হবে না৷ যেকোন সরকারি চাকরিতে ‘পুলিশ ভেরিফিকেশনের' নামে আসলে সেটাই দেখা হয়৷ 

Masood Kamal
মাসুদ কামাল, সাংবাদিকছবি: Hashibur Reza Kallol

দেশে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সরকার৷ এখন কোনো চাকরি প্রার্থীর গায়ে যদি ছাত্রদল বা শিবিরের গন্ধ থাকে, সে যত যোগ্যই হোক, তার সরকারি চাকরি হবে না৷ এখন এটা বাড়তে বাড়তে দুই প্রজন্ম পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে৷ সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এখন বাবা-মা পেরিয়ে দাদা-নানার রাজনৈতিক পরিচয়ও দেখা হয়৷ মামার সম্পত্তির ওয়ারিশ না পেলেও, তার রাজনীতির দায় ভাগ্নেকে ঠিকই চুকাতে হয়৷ যদি জানা যায়, কারও মামা জামায়াত বা বিএনপি করে অথবা করতো, তার যে সরকারি চাকরি হবে না- এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়৷ আবার এর ঠিক উল্টা ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে৷ ২০০১ সালে এই জোট সরকার যখন ক্ষমতায় এলো, অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে তারা রাতারাতি বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে দেয়৷ এমনকি, বাড়ি গোপালগঞ্জে- এই অপরাধেই অনেকে ন্যায্য চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷ সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে এখন বিপরীত দৃশ্য৷ বাড়ি গোপালগঞ্জ হলে এই সরকারের আমলে চাকরির সুযোগ বেড়ে যায়৷ এ এক অদ্ভুত মানসিকতা, অদ্ভুত পরিস্থিতি৷ যেন এক মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা৷ তবে এটাও ঠিক, রাজনীতি অনেক সময় নিরব হয়ে যায় অর্থের কাছে৷ ঘুষের পরিমাণটা পর্যাপ্ত হলে রাজনৈতিক পরিচয়কে গোপন রাখা যায়!

কর্তা ব্যক্তিদের এই মানসিকতার প্রভাব পড়েছে অভিভাবকদের মধ্যেও৷ প্রাণপণ চেষ্টা করেন যেন তার সন্তান কোনো রাজনীতির সঙ্গে না জড়ায়৷ সন্তানের চাকরি প্রাপ্তি নিয়ে অভিভাবকদের চিন্তা এতটাই প্রবল থাকে, অনেকে এমনও আছেন যে, অনেক বছর আগে থেকেই কিছু কিছু করে টাকা জমায়৷ যাতে সন্তানের চাকরির সময় ঘুষের অর্থ দিতে বেশি বেগ পেতে না হয়৷

তবে এই যে সন্তানের চাকরি নিয়ে টেনশন, এটা নিরসনের কোন কার্যকর চিন্তা দেখা যায় না সন্তানের শিক্ষার সময়৷ চাকরির কথা চিন্তা করে সে অনুযায়ী কেউ ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা করায় না৷ সকলেরই লক্ষ্য থাকে উচ্চশিক্ষার প্রতি, যেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি একটা নিতেই হবে৷ আর এটা নিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷ এতে ফলাফল হচ্ছে ভয়াবহ৷ বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা বেকার থাকছে, হুটহাট চাকরি পেয়ে যাচ্ছে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা৷ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ১৫ হাজার টাকার চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে, আর ওই একই প্রতিষ্ঠানে অষ্টম শ্রেণি পাশ ড্রাইভারের ১৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি হয়ে যাচ্ছে অনায়াসে৷ এটা কিন্তু বানানো কোনো গল্প নয়, আমি নিজেই এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, এই চর্মচক্ষে তা অবলোকন করেছি৷ সবশেষ যে বেসরকারি টেলিভিশনে আমি ছিলাম, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সার্টিফিকেটধারী একজন নিউজরুম এডিটর বেতন পেতেন ১৮ হাজার টাকা, আর একজন পিয়নের বেতন ছিল ২২ হাজার টাকা! বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেই অনেক দেনদরবার করেছি, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি৷ শিক্ষাগত যোগ্যতা নয়, কে কার মাধ্যমে ঢুকেছে- সেটাই তখন হয়ে দাঁড়ায় গুরুত্বপূর্ণ৷

এই যে বাস্তবতার বিচিত্র চেহারা, একে জগাখিচুড়ি ছাড়া আর কি-ই বা বলা যায়? বাংলাদেশের চাকরির বাজারে নিয়মহীনতাই যেন আজ অনিবার্য নিয়মে পরিণত হয়েছে৷ কিন্তু যে প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়, তা হচ্ছে- চাকরির বাজারে যদি একটা নিয়মতান্ত্রিক সাম্যভাব প্রতিষ্ঠা করা না যায়, তাহলে মানুষের মধ্যে সন্তুষ্টি কি করে আসবে? আর অসন্তুষ্ট জনগোষ্ঠি জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে কিভাবে? 

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান