বাংলাদেশকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে
১ আগস্ট ২০১৯শ্রীলঙ্কায় ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইট ওয়াশ হয়েছে বাংলাদেশ৷ সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে বিরূপ সমালোচনা৷ অথচ সেরা দল নিয়ে যায়নি বাংলাদেশ৷ দলের সেরা খেলোয়াড়দের অনেকেই নেই সেরা ফর্মে৷ ফলে আবেগ সরিয়ে ভাবলে পরাজয় কারো কাছে অপ্রত্যাশিত হওয়ার কথা নয়৷
অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি তো বিশ্বকাপেই ফুটে উঠেছিল৷ সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ধরে ধরে প্রত্যেকটি জায়গায় কাজ না করলে এভাবেই কিছু অপ্রাপ্তির বেদনা নিয়ে শেষ হবে বিশ্বকাপ বা অন্য কোনো আসর, আরো নতুন নতুন সিরিজ শেষে শুরু হবে ব্যর্থতার খতিয়ান সামনে রেখে আলোচনা-সমালোচনা৷ চলবে দায় এড়ানো, সমস্যাকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা৷ এভাবে সমস্যাগুলো বড় সঙ্কট হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে আর তাতে হয়ত উজ্জ্বল সম্ভাবনার পথ থেকে সরতে সরতে ব্যর্থতার অতলে তলিয়ে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট৷
অতীতে তাই হয়েছে৷ বেশি না, শুধু দুটি ক্রিকেট শক্তির কথা মনে করলেই বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যাবে৷ শুরুতে বলা যাক ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথা৷ ক্রিকেটে ক্যারিবীয়দের সাফল্যের ধারেকাছে যেতেও অনেক সময় লাগবে বাংলাদেশের — এ কথা কে না মানবেন! কী টেস্ট কী ওয়ানডে সব জায়গাতেই ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল অজেয়৷ লরেন্স রো টেস্ট ক্রিকেটে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেও বেশি দিন সুযোগ পান না দলে৷ অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিংদের দাপটে কত কত ফাস্ট বোলার একটা সুযোগের অপেক্ষায় পার করে দেন বছরের পর বছর৷ সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম দুটো বিশ্বকাপ জয়ের পর ১৯৮৩-র ফাইনালে অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে গেল ভারতের কাছে৷ তারপর বদলা নিতে দেরি করেনি ক্লাইভ লয়েডবাহিনি৷ তা নিয়ে অনেক লেখালেখিও হয়েছে৷ কিন্তু যা নিয়ে বেশি লেখালেখি হয়নি তা হলো '৮৩ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ধীরে ধীরে ভারতের উঠে আসা৷ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ওই বদলার পর ধীরে ধীরে বদলেছে৷ সেই বদলটা হয়েছে উল্টো পথে৷ লয়েড, রিচার্ডস, হেইন্স, গ্রিনিজ, গার্নার, হোল্ডিং, মার্শালরা একে একে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন, লারা, হুপার, রিচার্ডসন, ওয়ালশ, অ্যামব্রোসরা কিছুদিন জ্বালিয়ে রেখেছেন টিমটিম করে জ্বলতে থাকা ঐতিহ্যের বাতি৷ কিন্তু লয়েড বুঝতে পেরেছিলেন এভাবে বেশিদিন আর জ্বলবে না, ধীরে ধীরে নিভে যাবেই৷ তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড (ডাব্লিউআইসিবি)-র প্রধানকে একটা পরামর্শ দিয়েছিলেন— বলেছিলেন, ‘‘আগের মতো ভালো মানের ফাস্টবোলার আসছে না, ব্যাটিংয়েও দেখা যাচ্ছে না তেমন কোনো প্রতিভার ঝিলিক৷ দেরি না করে অস্ট্রেলিয়ার মতো একটা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি খুলুন৷'' এক সাক্ষাৎকারে খুব দুঃখ করে ‘বিগ ক্যাট' লয়েড জানিয়েছিলেন বোর্ড প্রধান তাঁর কথা সেদিন আমলেই নেননি, বরং খুব দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘‘ওয়েস্টইন্ডিজকে সবাই অনুসরণ করে, ওয়েস্টইন্ডিজ কাউকে অনুসরণ করে না৷'' ‘অনুসরণ' না করলে কী পরিণাম হয় তা তো এখন দেখাই যাচ্ছে৷
এবার আসা যাক জিম্বাবোয়ের প্রসঙ্গে৷ এক সময় জিম্বাবোয়ে এখনকার বাংলাদেশের চেয়ে কোনো অংশেই কম শক্তিশালী, কম সম্ভাবনাময় ছিল না৷ ক্রিকেট বিশ্বকাপে অভিষেক বাংলাদেশের চেয়ে ১৬ বছর আগে, ১৯৮৩ সালে৷ প্রথম সুযোগেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল তারা৷ কপিল দেব দানবীয় এক ইনিংস (১৭৫ অপরাজিত) না খেললে ভারতকেও হারাতো৷ ওই সাফল্যের সঙ্গে পরে ওয়ানডেতে জিম্বাবোয়ের আরো কত সাফল্য যোগ হয়েছিল তা রেকর্ড বই খুলেই দেখে নেয়া যেতে পারে৷
জিম্বাবোয়ে প্রথম টেস্ট খেলার সুযোগ পায় ১৯৯২ সালে, ভারতের বিপক্ষে৷ তিন বছর পর দেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে পেয়ে যায় প্রথম টেস্ট জয়ের দেখা৷ সেই পাকিস্তান, যে দলে ছিল আমীর সোহেল, সাঈদ আনোয়ার, ইনজামাম-উল হকের মতো ব্যাসম্যান আর ওয়াসিম আকরাম, আকিব জাভেদের মতো বোলার৷ তার ঠিক তিন বছর পর পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদও পেয়ে যায় তারা৷ নিজের দেশে নয়, পাকিস্তানে গিয়ে ২ ম্যাচের সিরিজ ১-০-তে জিতেছিল তারা৷ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, অ্যালেস্টার ক্যাম্পবেল, হিথ স্ট্রিক, পল স্ট্র্যাং, এডো ব্র্যান্ডেজ, নিল জনসনদের হাত ধরে আরো কত সাফল্য এসেছিল তার বিবরণ আজ না হয় থাক৷ এখন বরং শুধু জিম্বাবোয়ে ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকাই৷ যথাযথ পরিকাঠামো আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কোন পর্যায়ে নেমেছে তারা! ক্রিকেটে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে আইসিসি বহিস্কার করেছে তাদের৷ ক্রিকেটাররা বলছেন, ‘‘ আমরা বিনে পয়সায় খেলবো, তবু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগটা দিন!''
ওয়েস্টইন্ডিজ আর জিম্বাবোয়ের মতো অনেক সাফল্যই এখনো পাওয়া হয়নি বাংলাদেশের৷ তবে পাওয়া সম্ভব৷ দরকার শুধু সফল দল আর সফল থেকে ব্যর্থতার অতলে তলিয়ে যাওয়া দলগুলোর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া৷ দরকার নতুন খেলোয়াড় তৈরির দিকে জরুরি ভিত্তিতে আরো মনোনিবেশ করা৷ বাংলাদেশে ক্রিকেট অনেক জনপ্রিয়৷ মানুষ ক্রিকেটকে অনেক ভালেবাসে৷ কিন্তু দরজা দিয়ে ব্যর্থতা বেশি বেশি এলে ভালোবাসা হয়ত একসময় জানালা দিয়ে পালাতে পালাতে নিঃশেষ হয়ে যাবে৷ বাংলাদেশে ফুটবলের তো সেই দশাই হয়েছে৷
দেশে গত কয়েক বছরে অনেক ক্রিকেট অ্যাকাডেমি গড়ে উঠেছে৷ রাজধানীতেই নাকি আছে শতাধিক অ্যাকাডেমি৷ খুব সুশৃঙ্খল, খুব পরিকল্পিত মনে না হলেও খেলোয়াড় তৈরিতে সম্প্রতি বিসিবির কিছু উদ্যোগও চোখে পড়েছে৷ তার মধ্যে ৬৪ জেলায় কোচ নিয়োগ দিয়ে প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচির কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়৷ অবশ্য প্রতিভা খুঁজে বের করলেই হবে না, জেলা থেকে বিভাগ, বিভাগ থেকে জাতীয় পর্যায় এবং সেখান থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কঠিন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো করে গড়ে তুলতে হবে তাদের৷