বাংলাদেশ দেয় আম, পাকিস্তান দেয় পাকিস্তানি ‘কালচার'
২৫ জুলাই ২০২২এর আগেও বাংলাদেশের জন্য অবমননাকর অনেক ঘটনাই ঘটিয়েছে একাত্তরে গণহত্যা ও ধর্ষণ, লুটপাটের জন্য এখনো ক্ষমা না চাওয়া পাকিস্তান৷
গত ৩ জুলাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফকে একটন আম্রপলি” আম উপহার হিসেবে পাঠান৷ওই আমের খুশবু বাতাসে মিলানোর আগেই বাংলাদেশে পাকিস্তান হাইকমিশন তাদের ফেসবুক পেজে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বিকৃত করল৷ তারা তাদের ফেসবুকের কাভার পেজে গ্রাফিক্স-এর মাধ্যমে পাকিস্তানের পতাকার সাথে বাংলাদেশের পতাকা এক করে আপলোড করে গত বৃহস্পতিবার৷ তবে প্রতিবাদের মুখে পরে ওই পতাকা ফেসবুক থেকে রবিবার সরিয়ে নেয়া হয়৷
ঘটনা সম্পর্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন,"আমরা তাদের (পাকিস্তান) বলেছি, এটা আমাদের পছন্দ নয়৷ তবে তারা জানিয়েছেন, তারা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই ছবি প্রকাশ করেনি৷” পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া এই কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ এর আগে শনিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তান দূতাবাসকে পতাকা সরিয়ে ফেলতে বলে৷
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ পাকিস্তানের প্রতি নমনীয় আচরণ করছে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ তারা মনে করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের এত ঘনিষ্ঠতার দরকার নেই৷ কারণ, পাকিস্তান এখনো চায় বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে একীভূত হোক৷
এর আগের বছর ২০২১ সালের জুলাই মাসে ইমরান খান যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এক হাজার কেজি ‘হাঁড়িভাঙা' আম পাঠিয়েছিলেন৷ এটাকে দেখা হয়েছে ‘‘ম্যাঙ্গো ডিপ্লোম্যাসি'' হিসেবে৷'' তবেপাকিস্তান বাংলাদেশের ব্যাপারে কখনোই ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নিবলে মনে করেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির৷ তিনি বলেন, পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি৷ তারা তাদের পরাজয়কে মেনে নেয়নি৷ তাই তারা যখনই সুযোগ পেয়েছে, তখনই বাংলাদেশকে অপমান করার চেষ্টা করেছে৷
আর সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন বলেন, পাকিস্তান একাত্তরের গণহত্যার বিচার না চেয়ে তার ধারাবাহিকতাই রক্ষা করছে৷
২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম পাকিস্তানকে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলেন৷ তার সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী দেখা করতে গেলে তিনি এই আহ্বান জানান৷ কিন্তু জানানো হয়, পাকিস্তান ক্ষমা চাইবে না৷ ২০০৯ সালে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি পাকিস্তানি দূত আলী বাসারকে একই আহ্বান জানান৷ কিন্তু তখনও জানানো হয় পাকিস্তান ক্ষমা চাইবে না৷
ঢাকার মাঠে পাকিস্তানি পতাকা: ২০২১ সালের নভেম্বরে ঢাকার মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে মাঠে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় পাকিস্তানি খোলোয়াড়রা পাকিস্তানের পতাকা ওড়ায় পতাকাবিধি লঙ্ঘন করে৷ ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে তারা ক্ষান্ত দেয়৷
মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা: ২০২১ সালের অক্টোবরে ঢাকায় পাকিস্তান দূতবাসের ওয়েব সাইটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়৷ ৯ অক্টোবর পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় প্রতিবাদ জানালে ভিডিওটি সরিয়ে ফেলা হয়৷ ২০১৯ সালে পাকিস্তানের একটি অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করা হয়৷
কূটনীতিক বহিষ্কার: ২০০০ সালে পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার ইরফান-উর রাজাকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এক সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে চরম অবমাননাকর মন্তব্য করার কারণে৷
যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে পাকিস্তান: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যখনই জামায়াতের কোনো নেতা একাত্তরের অপরাধের জন্যদণ্ডিত হয়েছেন, তখনই পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও ইমরান খানের দল তেহরিক-ই ইনসাফ, তার প্রতিবাদ করেছে৷ জামায়াত নেতাদের ফাঁসির নিন্দা জানিয়ে পকিস্তানের জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবও পাস হয়েছে৷
জঙ্গিদের মদতদাতা পাক কূটনীতিক: ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় পাকিস্তানি দূতাবাসের কনস্যুলার কর্মকর্তা মাজহার খানকে বহিস্কার করা হয়৷ তিনি জঙ্গিদের কাছে জাল টাকা হস্তান্তর করার সময় গুলশানের এক হোটেলে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েন৷
বহিষ্কৃত আরেক ‘জঙ্গিবান্ধব' কূটনীতিক: ২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ঢাকা থেকে বহিস্কার করা হয় আরেক পাকিস্তানি কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে৷ ওই ঘটনার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানও বাংলাদেশের এক নারী কূটনীতিককে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করেছিল৷
বিশ্লেষকরা যা বলেন
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘‘পাকিস্তানের সাথে তো আমাদের এত প্রেম-প্রীতির দরকার নেই৷ প্রথম বার যখন প্রধানমন্ত্রী আম পাঠিয়েছেন তখনো আমরা প্রতিবাদ করেছি৷ কিন্তু আমরা দেখছি পাকিস্তানের প্রতি বাংলাদেশের নমনীয় আচরণ৷ বাংলাদেশের ৩০ লাখ শহিদের প্রতি যদি কারুর দায়বদ্ধতা থাকে, তাহলে পাকিস্তানের প্রতি এ ধরনের নমনীয় আচরণ উচিত না৷”
তার কথা, ‘‘ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে৷ তারা এটা মেনে নিতে পারেনি৷ তাই যখনই তারা পেরেছে তখনই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷ তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে তো আমরা আমাদের পাওনা আদায় করতে পারবো না৷ তাই আমাদের পাস্তিানের সাথে সর্বনিম্ন কূটনৈতিক সম্পর্কের বেশি কোনো সম্পর্ক রাখার দরকার নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘এবার পতাকা বিকৃতির পরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে সাধারণ নমনীয় ভাষা ব্যবহার করেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়৷
আর সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানে যে সরকার ছিল, তাদের উচিত ছিল বাংলাদেশে তারা যে গণহত্যা করেছে, অপরাধ করেছে তার জন্য ক্ষমা চাওয়া৷ কিন্তু তারা সেটা করেনি৷ তার পরের সরকারগুলোও একই অবস্থানে থেকেছে৷ হয়ত রাজনৈতিক কারণে, অথবা তাদের মনোভাবই এটা৷ ফলে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো হয়নি৷ ক্ষমা চাইলে সম্পর্ক ভালো হতে পারতো৷ আর ওই মনোভাবের কারণেই তারা এখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানাভাবে তৎপর৷ তা না হলে বাংলাদেশে বাংলাদেশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে তো হইচই করার কিছু নেই৷''
এরপরও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ কি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘না আমি সেটা মনে করি না৷ বাংলাদেশকে কি যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করতে হবে? বাস্তব অবস্থা হলো, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো নয়৷ সেটা পাকিস্তানের কারণেই৷ কিন্তু তারা যদি ক্ষমা চাইতো, ওইসব আচরণ বন্ধ করতো, তাহলে ভালো হতে পারতো৷ কারণ, এখন তো ওই বিষয় ছাড়া তাদের সাথে আমাদের স্বার্থের তেমন কোনো সংঘাত নেই৷ তাদের আচরণের কারণেই সম্পর্ক ভালো হচ্ছে না৷”
তার কথায় , ‘‘আমাদের মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকরা আমাদের সাথে কোনো অন্যায় করেনি৷ করেছে একাত্তরে পাকিস্তানের সরকার৷ পরবর্তী সরকারগুলোও একই আচরণ করছে৷ হতে পারে তাদের কালচারই এরকম৷ ''