কলকাতার ‘মিউজিক ওয়ার্ল্ড’
২০ জুন ২০১৩কলকাতার লোকেরা হঠাৎ গান শোনা বন্ধ করে দিয়েছে, এমন কিন্তু কিছু ঘটেনি৷ তারা গান শুনছে, এবং আগের থেকে একটু বেশিই শুনছে৷ আজকাল রাস্তায়ঘাটে, বাসে বা মেট্রোয় কানে হেডফোন পরা ছেলে-মেয়েদের দেখলে, সেটাই মনে হয়৷ এটা হচ্ছে কারণ মোবাইল মিউজিক ব্যাপারটা আগের থেকেও আরও সহজ হয়ে গিয়েছে৷ এখন ছোট্ট একটা আইপড, অথবা চিকনদেহী মোবাইল ফোন আর প্রায় সুতোর মতো সরু তারের হেডফোন থাকলেই জলে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-সমুদ্রে গান শোনার ব্যবস্থা পাকা৷ তার কারণ ডিজিটাল মিউজিক আসলে মিউজিকের ভাঁড়ারে একটা বিপ্লব এনে দিয়েছে৷ ৫০টি অডিও সিডি-র মিউজিক এখন চোখের নিমেষে পুরে ফেলা যায় সূক্ষ্ম একটা বৈদ্যুতিন চিপে, যা আসলে মোবাইল মিউজিকের প্রাণভোমরা৷
অথচ আগে গান শোনার প্রাথমিক শর্ত ছিল কোথাও একটু থিতু হয়ে বসা৷ তারপর এলো মোবাইল মিউজিক – ওয়াকম্যান বা ডিস্কম্যান, যাতে চলতে ফিরতে মিউজিক ক্যাসেট বা সিডি বাজিয়ে শোনা যেত৷ এর পরের পর্বটা এল এমপি-থ্রি ফরম্যাটের৷ মানে সাধারণ অডিও সিডি-তে যতগুলো মিউজিক ফাইল ধরে, এমপি-থ্রি ফরম্যাটে সেভ করলে তার থেকে অনেক বেশি মিউজিক ফাইল স্টোর করা যায়৷ এটাই এমনভাবে নাড়া দিল বাজার এবং গান শোনার অভ্যাসকে যে একটা শোরগোল পড়ে গেল৷ সেই সময় থেকেই বেশ হইচই শুরু হয়েছিল মিউজিক পাইরেসি নিয়ে৷ কিন্তু বাজারের প্রবণতা বুঝতে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর দেরি হয়নি, কারণ তার পরেই ঘটে গেল ঘটনাটা৷ স্টোরেজ মাধ্যমটা বদলে গেল৷ কার্যত শুরু হয়ে গেল এক ডিজিটাল বিপ্লব৷ ছোট্ট একরত্তি একটা মোবাইল ফোন অথবা আইপডের বৈদ্যুতিন মস্তিষ্কে ভরে দেওয়া সম্ভব হলো রাশিরাশি গান, যে ভাঁড়ারঘর ইচ্ছে মতো সাফ করা যায়, ঝাড়াই বাছাই করে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা যায়৷
এটা কিন্তু সংগীতপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার হয়ে উঠল যে, নিজের গানের সংগ্রহকে ব্যাক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী, এমনকি নিজের তাৎক্ষণিক মুড অনুযায়ী বদলে নেওয়া যাবে, বার বার নতুনভাবে সাজিয়ে নেওয়া যায়৷ ধরাবাঁধা ফরম্যাট থেকে এই যে মুক্তি, নিজের মতো গান শোনার এই যে অপার স্বাধীনতা, এটাই আসলে সারা পৃথিবী জুড়ে বাঁধনছাড়া উল্লাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে৷ কলকাতাও তার ব্যাতিক্রম না৷ সুতরাং পার্ক স্ট্রিটের মিউজিক ওয়ার্ল্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে যারা কেবল ইন্টারনেট থেকে মিউজিক ডাউনলোড এবং মিউজিক পাইরেসি-কেই দুষছেন, তারা কিন্তু সমস্যার একটা দিকই কেবল দেখছেন, এবং মূল বিষয়টা দূর্ভাগ্যক্রমে তাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে৷ ইংল্যান্ডে জাতীয় মিউজিক বাণিজ্যের প্রতিভু ধরা হয় যে সংস্থাকে, সেই এইচএমভি পর্যন্ত এই প্রবণতার বলি হয়েছে৷ চলতি বছরের শুরুতে কার্যত বন্ধ হতে বসেছিল বহু বছর ধরে লোকসানে চলা এইচএমভি৷ কলকাতায় যে সংস্থা মিউজিক ওয়ার্ল্ড চালাত, আরপিজি শিল্পগোষ্ঠীর অধীনস্থ সেই মিউজিক সংস্থা সারেগামা ছিল ভারতে এইচএমভি সংস্থারই বাণিজ্যিক দোসর৷
কলকাতার সংগীত শিল্পীরা যদিও সবাই বলছেন, তাঁরা মিউজিক ওয়ার্ল্ডকে মিস করবেন৷ কারণ, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মিউজিক ওয়ার্ল্ডে নতুন অ্যালবাম প্রকাশের সুবাদে সরাসরি শ্রোতাদের সঙ্গে শিল্পীদের যোগাযোগের একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল, যা অনুষ্ঠানমঞ্চ থেকে হয় না৷ সে কারণে ভক্ত শ্রোতাদেরও মন খারাপ৷ তা ছাড়া অনেকেই বলছেন, পার্ক স্ট্রিটের একটা ল্যান্ড মার্ক হয়ে উঠেছিল পিটার ক্যাট রেস্তোরাঁ আর ফ্লুরিস কাফের মাঝখানে, মিউজিক ওয়ার্ল্ডের সুসজ্জিত বিপণিটি৷ শহরের প্রেমিক প্রেমিকাদের দেখা করারও জায়গা ছিল মিউজিক ওয়ার্ল্ড৷ তাছাড়া অনেকেই বলছেন, অভিজাত পার্ক স্ট্রিটে ওটাই একমাত্র দোকান ছিল, যেখানে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত এবং পাঁচতারা হোটেলের বিলাস-ব্যাসনে অনভ্যস্ত বাঙালি গিয়ে স্বস্তিতে কিছুটা সময় কাটাতে পারত৷ এবং সেই অছিলায় কিনেও নিতে পারত একটা মিউজিক সিডি বা ডিভিডি৷
কিন্তু ওই বিক্রিটা যথেষ্ট হচ্ছিল না ব্যবসা চালু রাখার পক্ষে৷ তাই ৩০ জুনের পর বন্ধ হচ্ছে মিউজিক ওয়ার্ল্ডের দরজা৷ ওই জায়গায় আরপিজি গোষ্ঠীর একটি রেস্তোরাঁ খোলা হবে বলে জানা গিয়েছে৷ আর মিউজিক বিপণন আপাতত সীমাবদ্ধ থাকবে পাড়ার ছোট দোকানে, অথবা ক্রসওয়ার্ড বা ল্যান্ডমার্কের মতো বড় বইয়ের দোকানের এক ধারে, আলাদা মিউজিক সেকশনে৷