1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রথিতযশা সংগীত শিল্পীদের অনন্ত দুর্দশা

জনি হক ঢাকা
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

একসময় শিল্পীদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ক্যাসেট-সিডি৷ অনলাইনে গানের বাজার ঢুকে পড়ায় সেসব হয়ে গেছে সোনালি অতীত৷ হালে দেশের বাইরে, এমনকি সংগীতের বাইরেও আর্থিক নিরাপত্তা খুঁজছেন অনেকে৷

https://p.dw.com/p/40niJ
Bangladesch Musiker Gruppe
ছবি: privat

ফিতার ক্যাসেট কিংবা রঙ-বেরঙের সিডি এখন প্রায় অতীত ইতিহাস৷ প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দিনে দিনে গানের বাজার বদলেছে৷ অনলাইনে ইউটিউব এখন গান দেখাশোনার সবচেয়ে বৃহৎ মাধ্যম৷ সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ইউটিউবে সক্রিয় হয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা শিল্পী৷ তাদের কেউ কেউ সফলও হয়েছেন৷ তবে সংখ্যাটা আশাব্যঞ্জক নয়৷ নতুনধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান করার মানসিকতা যেন হারিয়ে ফেলেছেন তাদের অনেকে৷

অনেকেই অনলাইনে মানিয়ে নিতে পারছেন না৷ বয়সের কারণে বা শেখার আগ্রহ না থাকায় খাপ খাওয়াতে পারেননি তারা৷ এক ধরনের অভিমান নিয়েও দূরে আছেন কেউ কেউ৷ গানের ধরন ও প্রচারমাধ্যমে পরিবর্তন আসায় কারো কারো জন্য সংগীত পরিবেশন করে উপার্জনটা কঠিন হয়ে পড়েছে৷ এ কারণে পুরনোদের নতুন গান শোনা যায় কালেভদ্রে৷

‘সিনিয়র' শিল্পীরা এমনিতেই কনসার্টে খুব একটা ডাক পান না৷ আগেই সংখ্যাটা কম ছিল৷ করোনাকালে তো কনসার্ট, গানের আসর ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধই আছে বলা চলে৷ ফলে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ আরো কমে গেছে৷ ফলে আধুনিক, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, লোকগীতিসহ বিভিন্ন ধারার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর আয়ই আর আগের পর্যায়ে নেই৷

টিভি চ্যানেলে সম্মান অনেক, সম্মানী সামান্য

একুশে পদকপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলম ডয়চে ভেলেকে জানালেন, বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে টুকটাক গান করছেন তিনি৷ তার কথায়, ‘‘আমার ক্যারিয়ারের শুরু থেকে ২০১৬ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে যে গানগুলো গেয়েছিলাম, এখন সেগুলোই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে গাই৷ গান এখনো আমার কাছে পেশা৷ আমার ফিক্সড কিছু জায়গা আছে, যেখান থেকে গান গেয়ে পয়সা পাই৷ যেমন বিটিভি, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, মাছরাঙা টিভি সবসময় ডাকে৷ হয়তো গাইতে ডাকে, না হয় ছেলে-মেয়েদের গানের উচ্চারণ ঠিক করে দিতে বলে৷''

‘অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের জন্য একটা গান ভিডিও করে আপলোড দেওয়া অনেক সহজ’

লালনসংগীত শিল্পী ফরিদা পারভীন ইন্টারনেট যুগে আসা করোনাকালে নিজের অবস্থা জানাতে গিয়ে হতাশার সুরেই ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন তেমন কোনো আয় নেই৷ বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) দুই-একটা রেকর্ডিংয়ে অংশ নিয়েছি৷ অনেকদিন পর চ্যানেল আইতে গাইলাম৷ কিন্তু ওই টাকা দিয়ে তো মাস চলে না৷ চ্যানেলগুলো সম্মানটা হয়ত দিচ্ছে, সম্মানী ওভাবে দিতে পারছে না৷ করোনাকালে তারাও বিপর্যস্ত৷''

লোকসংগীত ও বাউল গানের আসর করোনার কারণে শূন্যের কোঠায়৷ লোকজ গানের শিল্পী কুদ্দুস বয়াতি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন— পালাগান, জারিগান, সারিগান, গম্ভীরা, কবিগানসহ লোকসংগীত ও বাউল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক শিল্পী এখন বেকার৷ গ্রাম-গঞ্জে লোকসংগীতের আসর কমে যাওয়ায় এমনিতেই তারা সংকটে ছিলেন৷ কোভিড-১৯ মহামারি তাদের আরো অসহায় করে দিয়েছে৷ সবারই এখন করুণ দশা৷

বাউল ও লোকগানের শিল্পী কিরণ চন্দ্র রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিল্পীরা মোটামুটি রুজি করে খেয়েপরে থাকে৷ তারা কখনো অর্থবিত্তের পেছনে দৌড়ায় না৷ শিল্পীরা তো একেবারে ছাপোষা মানুষ৷ তারা গান গায়, উপার্জন করে দুটো ডালভাত খায়৷ করোনায় তাদের পেটে ঘা লেগে গেছে৷''

রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা মনে করেন, শুধু কবিগুরুর গান গেয়ে এখন জীবিকা নির্বাহ করা খুব কঠিন৷ তিনি অ্যামেরিকা থেকে টেলিফোনে ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘হাতেগোনা দুই-একজন রবীন্দ্রসংগীতকে পেশা হিসেবে নিতে পেরেছে, এর বেশি না৷ সেই পর্যায়ে আমাদের দেশ এখনো যায়নি৷ তরুণ আয়োজকরা তাদের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীতকে যুক্ত করে না৷''

‘অনলাইনের মাধ্যমে তো আর সংগীত হতে পারে না’

নজরুলসংগীত শিল্পী সুজিত মোস্তফারও একই মন্তব্য, ‘‘রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলসংগীত গেয়ে আয় করা শিল্পীর সংখ্যা হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন৷ কিন্তু এমন অনেক প্রতিভাবান আছে, যাদের কর্পোরেট আঙিনাতে রাখা হয় না, তারা দেশ-বিদেশেও ডাক পায় না৷ করোনার আগেও আমি ডাক পেতাম না, করোনাকালেও দেখলাম অনুষ্ঠান নেই৷ নজরুলসংগীতের অবস্থা খুবই নাজুক৷ নজরুলের গানের কোনো জনপ্রিয়তা নেই৷ নজরুল সংগীতের দুরবস্থা আগেই ছিল, করোনায় সেটি আরো ওলটপালট হয়ে গেছে৷''

রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অদিতি মহসিনের কথায়, ‘‘আমি তো রবীন্দ্রনাথের গান করাকে পেশা হিসেবে নিয়েছি৷ আমার পরের প্রজন্মের কেউ শুধুই রবীন্দ্রসংগীতকে পেশা হিসেবে নিতে পেরেছে কিনা জানি না৷ আমি তো পেরেছি৷ তবে এখন করোনাকালে আমাদের রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে৷''

অনলাইনবিমুখ,  নাকি  অনলাইনমুখী

প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পুরনো শিল্পীরা ইউটিউবে চ্যানেল খুলেছেন৷ তাছাড়া করোনাকালে অনলাইনমুখী হতে হয়েছে অনেককে৷ যদিও বেশিরভাগ ‘সিনিয়র' শিল্পীই এই মাধ্যমকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন না৷

ফরিদা পারভীন যেমন ডয়েচে ভেলেকে জানালেন, তার ফাউন্ডেশন পরিচালিত অচিন পাখি সংগীত একাডেমির মাসে খরচ ১ লাখ টাকা৷ শিক্ষকদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে করোনাকালে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে অনলাইনে ক্লাস রেখেছিলেন৷ তার মন্তব্য, ‘‘আমার স্কুলে লালন ফকিরের গান, চিত্রকলা, বাঁশি, এসরাজসহ বিভিন্ন বিষয়ে তালিম দেওয়া হয়৷ কিন্তু অনলাইনে গান-বাজনা শুদ্ধভাবে শেখা যায় না৷''

কিরণ চন্দ্র রায়ও একই অভিমত ব্যক্ত করলেন, ‘‘অনলাইনের মাধ্যমে তো আর সংগীত হতে পারে না৷ হয়ত দায়ে পড়ে আমরা দুই-একটা অনুষ্ঠান করতে বাধ্য হয়েছি৷ তবে সেটিকে পথ হিসেবে বিবেচনা করছি না৷ আগেও করিনি, ভবিষ্যতেও করবো না৷ গান-বাজনা করার জন্য অনলাইনকেন্দ্রিক হওয়ার কোনো কারণ নেই৷''

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার মুখে শোনা গেল, ‘‘করোনাকালে অনেকে অনলাইনে গানের অনুষ্ঠান করেছে৷ কিন্তু অনলাইনে আমাদের দেশে যেসব অনুষ্ঠান হয়েছে সেগুলো একেবারেই অপেশাদারি ছিল৷ যারা গেয়েছে তারা কেউ টাকা-পয়সা পায়নি বা দেওয়া হয়নি৷ এটা মূলত পয়সা ছাড়া অনুষ্ঠান৷ জীবিকা নির্বাহের জন্য ছিল না তা৷ আমরা সুরের ধারা থেকে অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস রেখেছি৷ কিন্তু গানে আনুষঙ্গিক তবলার সঙ্গে সংযোগ করা যায়নি৷''

‘নজরুলসংগীত শিল্পীরা প্রযুক্তির সঙ্গে তত পরিচিত নন, যতটা মানিয়ে নিয়েছেন আধুনিক শিল্পীরা’

ক্যাসেটের সময় থেকে জনপ্রিয়তা পাওয়া আসিফ আকবর অবশ্য প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে একটা পরিক্রমা হিসেবে দেখেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘প্রযুক্তি সবসময় বদলাতে থাকে ক্রমশ৷ প্রতিটি পরিবর্তনের সময় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা ও সংগ্রাম করতে হবে আমাদের৷ আমি পেশাদার লোক হিসেবে ধৈর্য ধরে সংগ্রাম করে টিকে আছি৷''

যুগের সঙ্গে প্রযুক্তির পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবেই দেখেন অদিতি মহসিনও৷ তার মতে, ‘‘এখন গান যদি গাইতে হয় তাহলে তো মানিয়ে নিতে হবে৷ আমাদের জন্য তো ঘুরেফিরে ব্যাপারটা অনেকটা একইরকম৷ শুধু শ্রোতাদের শুনবার মাধ্যমটা পাল্টেছে৷ তারা আগে ক্যাসেট বা সিডি বাজিয়ে শুনতেন, এখন ইউটিউবে শোনেন৷ কিন্তু আমাদের রেকর্ডিং করবার বা যা কিছু করবার সেই ব্যাপারটা একই রয়েছে৷ সেটা কিছু বদলায়নি৷''

তবে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার মত ভিন্ন, ‘‘তরুণ যারা এখন গান গাইছে, তারা গান করে ভিডিও বানিয়ে দিচ্ছে৷ আমার ধারণা অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের জন্য একটা গান ভিডিও করে আপলোড দেওয়া অনেক সহজ৷ তারা গানটা একটুখানি করলো, তারপর ভিডিও করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আপলোড করতে পারছে৷ কিন্তু সিনিয়র শিল্পীরা খুব একটা মানিয়ে নিতে পারছে বলে আমার নিজের কাছে মনে হচ্ছে না৷ আমি অন্তত পারছি না৷ আমার ধারণা অন্যরাও পারছে না৷ এখন তো গানের পুরো ব্যাপারটাই শ্রুতিনির্ভর না হয়ে দৃষ্টিনির্ভর হয়ে গেছে৷''

একই সুরে মন্তব্য করলেন সুজিত মোস্তফা, ‘‘গান যখন শ্রবণ থেকে দর্শনে এসেছে, তখন থেকেই গানের অধঃপতন শুরু হয়েছে৷ সেটি ইউটিউবের যুগে না, টিভিতে গান আসার পরই৷ ইউটিউবে যখন মিউজিক ভিডিওর যুগ শুরু হলো, তখন এই ক্ষতি আরো ব্যাপক হয়েছে৷ শুধু নজরুলসংগীত নয়, সব সংগীতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ যদি অন্য গানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হয়, তাহলে নজরুলগীতিকে একটা গল্পে রূপান্তর করতে হবে৷ যদিও নজরুলসংগীত শিল্পীরা প্রযুক্তির সঙ্গে তত পরিচিত নন, যতটা মানিয়ে নিয়েছেন আধুনিক গানের শিল্পীরা৷''

কিরণ চন্দ্র রায় মনে করেন, পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করে প্রেক্ষাপটের ওপর৷ তাই লোকশিল্পী, আধুনিকশিল্পী, নজরুল, রবীন্দ্র কোনোটিকেই আলাদা করে ভাবার অবকাশ দেখেন না তিনি, ‘‘প্রতিটি সংগীতের ধারা তো একটিই— সেটি হচ্ছে সংগীত৷ আর এগুলো হচ্ছে সংগীতের শাখা৷ উচ্চাঙ্গসংগীত থেকে শুরু করে ঠুমরি, কীর্তনসহ সব শিল্পীরই একই দশা৷ কারণ, এই পরিবর্তনীয় রূপটি শৈল্পিক নয়৷ যেহেতু শৈল্পিক নয়, সেহেতু কমিটমেন্ট যুক্ত শিল্পীর অভাব দেখা দিয়েছে৷ আমি মনে করি, এটি সংগীতাঙ্গনের জন্য একটি অশনি সংকেত৷''

আধুনিক  প্রযুক্তি, প্রেমহীন  সমাজ

বর্তমান সংগীতাঙ্গনকে ফরিদা পারভীন মূল্যায়ন করলেন এভাবে, ‘‘লালন ফকিরের কথায় বলা যায়— সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সবই দেখি তা-না-না-না… সারা পৃথিবী জুড়েই তা-না-না-না চলছে৷ আধুনিক প্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে, কিন্তু প্রেমহীন সমাজ তৈরি হয়েছে৷''

আসিফ আকবর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে মেলে ধরলেন এভাবে, ‘‘মিউজিক ভিডিওর সময় যখন এলো, আমাদের গানের টাকা চলে যাচ্ছিল কর্পোরেটের হাতে৷ রঙঢঙ করে গানের ওপর থেকে ফোকাস চলে গেল মডেলের ওপর৷ গানটা আর হচ্ছিল না৷ গানের যে মূল মর্ম, অর্থ বা শব্দ এগুলো আর ভেতর থেকে আসতো না৷''

এখনকার গানে স্থায়িত্ব কম বলে মনে করেন খুরশিদ আলম৷ তার বর্ণনায়, ‘‘২০১৬ পর্যন্ত সিনেমার গান গেয়েছি৷ আগে ছিল অ্যানালগ পদ্ধতি৷ একটি মাইক্রোফোন দিয়েই দুইজন গান করতাম, কখনো কখনো চারজন৷ এখন তো ধর তকতা মার পেরেক! পাঁচ মিনিটে গান লিখে ফেললো, তারপর সেটি মোবাইল ফোনে পাঠিয়ে দিলো৷ প্রযুক্তি কোথায় চলে গেছে! তবে যতকিছুই করেন, আবার আপনাকে ঘুরেফিরে একই জায়গায় আসতে হবে৷ এই ধরুন রুনা লায়লার গান, সাবিনা ইয়াসমিনের গান, ফেরদৌসী রহমানের গান, সৈয়দ আবদুল হাদীর গান ২০২১ সালে এসেও কেন গাওয়া হচ্ছে? কারণ, এগুলোর মধ্যে টেকসই থাকার গুণাগুণ ছিল৷''

‘অডিও প্রযোজকরা তাদের সমস্ত টাকা সরিয়ে ফেলেছেন অন্য ব্যবসায়’

করোনাকালে শিল্পীদের আয় থমকে গেছে৷ গানের বাসিন্দাদের কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন৷ তাছাড়া প্রযুক্তির হাত ধরে সংগীতাঙ্গনে যে বিবর্তন হয়েছে, সেখানে পুরনো শিল্পীদের অনেকেই নেই৷ এর কারণ কী? প্রীতম আহমেদের মন্তব্য, ‘‘আমাদের দেশের যারা মেধাবী শিল্পী, তারা শুধু সংগীতটাই জানেন৷ তারা কিন্তু আর কাজ করছেন না৷ কাজ করছেন তারাই, যারা মার্কেটিংও জানেন, সেলসও জানেন৷ তারাই কিন্তু এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে দাপুটে শিল্পী৷ যারা শুধু গান-বাজনা করতেন, তবে মার্কেটিং জানতেন না, তাদের মধ্যে ১০০ জন শিল্পীর নাম বলা যায় যারা ক্যাসেট-সিডির সময় ছিলেন, এখন তাদের গান না করার পেছনে একটাই কারণ— তারা মার্কেটিং জানেন না৷ যারা প্রত্যক্ষভাবে খুব গুণী সংগীত পরিচালক ছিলেন, তাদের কাছ থেকে কাজটা সরে গেছে৷ এ কারণে তারা টিকতে পারেননি৷ তাদের মেধা ও উৎকর্ষতা শুধু গানটা তৈরির ক্ষেত্রে ছিল৷ এটি বিতরণ বা বিক্রির ক্ষেত্রে তাদের কোনোরকম সংযোগ ছিল না৷''

নেপোয় মারে দই

প্রীতম আহমেদ নিজের অ্যালবাম ও গানগুলো নিজেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাজারজাত করেন, আয় তার নিজের কাছেই আসে৷ কোনো তৃতীয় পক্ষকে টাকা দিতে হয় না তাকে৷ তার দাবি, ‘‘আমার ‘ভোট ফর ঠোঁট' গান থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা তুলে আনতে পেরেছি৷ এটা যদি কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিতাম আর তারা যদি আমাকে বলতো ১০ হাজার টাকা এসেছে, আমাকে কিন্তু সেই ১০ হাজার টাকাই নিতে হতো৷ আমার কাছে কোনো স্পষ্টতা ছিল না৷ আমাদের শিল্পীরা সেভাবে কখনো ভাবেননি, প্রযোজনা করেননি৷''

তবে পুরো ব্যাপারটা আসিফ আকবরের দৃষ্টিভঙ্গিতে এরকম— ‘‘প্রযোজকরা তাদের সমস্ত টাকা সরিয়ে ফেলেছেন অন্য ব্যবসায়৷ গানের ব্যবসায় আর রাখেননি৷ মার্কেট স্থাপন, সিরামিক, টাইলস, ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যবসায় লগ্নি করেছেন তারা৷ আমাদের শিল্পীদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল— প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টাকা দেবে, সুর দেবে, লিরিক দেবে, গান দেবে, তারা গাইবেন, টাকাটা নিয়ে ঘরে থাকবেন৷ এখন আগের ফর্ম্যাট বদলে গেছে৷ ক্রান্তিকালে টিকে থাকার জন্য কিছু বিনিয়োগ করতে হয় বা পরিস্থিতি বোঝার জন্য সময় দিতে হয়৷ সময় দিতে হলে কিছু খরচ হয়৷ পুরনো শিল্পীরা সেটা করেননি৷''

আসিফ আকবর তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, ‘‘গান-বাজনা শেষ ভেবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ সংগীতশিল্পীই চলে গেছেন অ্যার্মেরিকায়৷''

পুরনো শিল্পীদের কারো কারো কাছে গান এখন শখ৷ পলাশের নাম রাখা যায় সেই তালিকায়৷ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী এই কণ্ঠশিল্পী ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি যখনই বুঝতে পেরেছি অডিও শিল্পে ধস নামছে, ২০০৯ সালে পুরো পরিবারসহ অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাই৷ কিন্তু থাকতে না পেরে ২০১০ সালে আবার চলে আসি দেশে৷ তখন একবছর বিরতি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, এই এক বছরেই যে অবস্থা তাতে আমার অন্য কিছু করা উচিত৷ তখন বন্ধুদের সহযোগিতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে ঢুকে পড়ি৷ ফলে গানের ওপর নির্ভর করে থাকা লাগছে না৷ গান করে জীবনযাপন করতে হচ্ছে না৷ গানটা এখন আমার পেশা না৷''

নব্বই দশকের জনপ্রিয় এই গায়কের দাবি, ‘‘আমার মতো অনেকেই গানের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, অনেকে প্রকাশ করেন, অনেকে প্রকাশ করেন না৷''

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম জনপ্রিয় হওয়ার পর পুরনো গানগুলো বিনা অনুমতিতে অনলাইনে ছেড়ে দেওয়ায় বঞ্চিত হয়েছেন বলে মনে করেন পুরনো শিল্পীরা৷ অদিতি মহসিন বলেন, ‘‘ধরুন, আমার গান দিয়েই অনেকে চ্যানেল খুলে বসে আছে, কিন্তু সেখানে শিল্পী তার যে সম্মানী বা তার যেটা প্রাপ্য ছিল সেটা পায়নি৷ এ জায়গাগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া একটু কঠিন৷ বিনা অনুমতিতে এবং কোনোরকম সম্মানী দেওয়া ছাড়া আমার বা আমার সমসাময়িক শিল্পীদের গান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দিয়ে অনেকে ব্যবসা করছেন৷ এটা ঠিক না৷''

পলাশেরও একই অভিযোগ, ‘‘আমাদের পুরোনো গানগুলো ইউটিউবে অনুমতি ছাড়াই দেওয়া হয়েছে৷ স্বাক্ষর জাল করে কপিরাইট না নিয়ে অবৈধভাবে গানগুলো আপলোড করেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান৷ আমাদের এর কোনো লভ্যাংশ বা কিছুই দেয়নি৷ এজন্য সত্যি বলতে এখন কাজ করতে ইচ্ছে করে না৷ আমরা একসময় চলচ্চিত্রে গান গেয়েছি, তখন ক্যাসেট বা সিডি আকারে বের করার জন্য চুক্তি করি আমরা৷ তাই প্রযোজকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে গানগুলো ক্যাসেট বা সিডিতে বিক্রি করেছে৷ কিন্তু সেসব গান ইউটিউবে আপলোড করে স্বত্ব ভোগ করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান৷ যেমন, আমার ও মমতাজের দ্বৈত কণ্ঠে ‘খায়রুন লো' গানটি ৮৯ মিলিয়নের বেশি ভিউ হয়েছে৷ কিন্তু আমাদের শিল্পীদের পক্ষে যেহেতু কপিরাইট আইন নেই, এ কারণে আমরা কিছুই পেলাম না৷ পুরোপুরি বঞ্চিত৷''

এক্ষেত্রে আশার কথা মনে করিয়ে দিলেন সংগীতশিল্পী প্রীতম আহমেদ, ‘‘পুরনো যেসব গানের সঙ্গে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশের চুক্তি ছিল না, সেগুলোর গীতিকবি, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সমান রয়্যালটি পাবে৷ যারা মারা গেছেন, তাদের পরিবার যেন সেই টাকা পায় সেজন্য এই নীতিমালা৷ যদি ওই গান কেউ নতুন করে গায় তাহলে গীতিকবি-সুরকারের অনুমতি নিতে হবে৷ যে গানের চুক্তি বা সাক্ষী নেই, সেগুলোর ক্ষেত্রেই শুধু এই নীতিমালা প্রযোজ্য৷ এটা মৃত মানুষকে রক্ত সঞ্চালন করে প্রাণ দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা৷''

গীতিকবি সংঘ বাংলাদেশ, মিউজিক কম্পোজার্স সোসাইটি বাংলাদেশ ও সিঙ্গার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ নামের তিনটি সংগঠনের বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কপিরাইট অফিস নতুন সিদ্ধান্তটি নিয়েছে৷ নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সংগঠন তিনটির মাধ্যমে আলাদাভাবে সংগঠিত হয়েছেন কণ্ঠশিল্পী, সুরস্রষ্টা ও গীতিকবিরা৷