1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ইতিহাস

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষা করলে নতুন প্রজন্ম ইতিহাস জানবে

সিকদার মো. জুলকারনাইন
৫ এপ্রিল ২০১৭

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে পরিগণিত৷ বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস, জাতিসত্ত্বা বিকাশের সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমা উদঘাটনে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো অনন্য ভূমিকা পালন করছে৷

https://p.dw.com/p/2ahs1
Bangladesch Historische Bauwerke |
ছবি: DW/M. Mamun

আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন স্থাপত্য-বৌদ্ধবিহার, মন্দির, মসজিদ, সাধারণ বসতি, আবাসিক গৃহ, নহবতখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জমিদার প্রাসাদ অথবা রাজপ্রাসাদ, অসংখ্য প্রাচীন পুকুর ও দীঘি শানবাঁধানো ঘাট, পানীয় জলের কুয়া, প্রস্তরলিপি, তাম্রলিপি, মূদ্রা, প্রাচীন পুঁথি-তুলট বা তালপাতায় লেখা, পোড়ামাটির ফলকচিত্র, পোড়ামাটি ও পাথরের ভাস্কর্য, মৃৎপাত্র ইত্যাদি৷  

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার এ দেশের ইতিহাস বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি ও সিলেটের চাকলাপুঞ্জিতে পাওয়া প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ার, মৌর্য যুগে এ অঞ্চলের প্রশাসনিক কেন্দ্র মহাস্থানগড় ও উয়ারি-বটেশ্বরে আদি ঐতিহাসিক পর্বের মানুষের বসতি চিহ্ন, নানা ধরনের মৃৎপাত্র, পাথর ও কাঁচের পুঁতি, পোড়ামাটির গুটিকা, স্থাপত্য কাঠামো চিহ্ন, ছাপাঙ্কিত মুদ্রা ইত্যাদি নানা রকম প্রত্ননিদর্শন৷ বরেন্দ্র অঞ্চলে পাল যুগে নির্মিত দক্ষিণ-এশিয়ার অনুপম স্থাপত্যকর্ম সোমপুর মহাবিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বর্তমানে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র হিসেবে স্থান করে নিয়েছে৷ পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মূল মন্দিরের গায়ে পোড়ামাটির ফলকচিত্র এ দেশের মৃৎশিল্পীদের অনুপম শিল্পনৈপুণ্য প্রকাশ করে৷

এ দেশে পাথরের সংকটের কারণে নির্মাণ উপকরণ হিসেবে পাথরের বিকল্প হিসেবে পোড়ানো ইট এবং ফলকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়৷ পাল আমলে বাংলায় বেশ কিছু বিহার স্থাপত্য নির্মিত হয়৷ সীতাকোট বিহার, ভাসুবিহার, জগদ্দল বিহার, শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, হলুদ বিহার, বিক্রমশীলা মহাবিহার ইত্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এ অঞ্চলে বৌদ্ধ সংস্কৃতি বিকাশের অনন্য উদাহরণ৷

দিনাজপুরের কান্তনগরে মহারাজা প্রাণনাথ ও তাঁর পুত্র রাজা রামনাথ ১৭০৪ হতে ১৭০২২ সালের মধ্যে নির্মাণ করেন কান্তজীও মন্দির৷ বাংলার পোড়ামাটির শিল্পকর্মের এক বিরল দৃষ্টান্ত এই মন্দিরের দেয়ালে পোড়ামাটির শিল্পকর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি ও তৎকালীন সমাজ চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ রাজশাহীর পুঠিয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ শিব মন্দিরটি ১৮২৩ সালে রানী ভুবনময়ী নির্মাণ করেন৷ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পুঠিয়া রানী সেখানে পঞ্চরত্ন গোবিন্দ মন্দিরটি নির্মাণ করেন৷ এছাড়া পুঠিয়াতে বড় আহ্নিক মন্দিরটি টেরাকোটার অলংকরণে দোচালা ও চারচালার সংমিশ্রণে তৈরি ত্রি-মন্দির, যেটি এ অঞ্চলের অনন্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন৷

 এছাড়াও বাংলাদেশের নানা জায়গায় অসংখ্য মন্দির স্থাপত্য জরাজীর্ন অবস্থায় রয়েছে৷ মন্দিরগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে৷

বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রাচীণ মসজিদ স্থাপত্য৷ সুলতানী আমলের  অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনা মসজিদ৷ সুলতান হুসাইন শাহের সময়কালে (১৪৯৩-১৫১৯) পনেরো গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি নির্মিত হয়৷ ইট ও পাথরের তৈরি এই মসজিদে পোড়ামাটির কারুকাজ রয়েছে৷ রাজশাহীর বাঘায় ১৫২৩ সালে নির্মিত বাঘা মসজিদ গুরুত্বপুর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন৷ এছাড়া মুন্সিগঞ্জের রামপালে মালিক কাফুর ১৪৮৩ সালে বাবা আদম শহীদের নামে একটি জামে মসজিদ নির্মাণ করেন৷ রাজশাহী জেলার দূর্গাপুর থানার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে দেখা যায় আমগ্রাম, কিসমত মারিয়া, কাঠালিয়া ও রইপাড়া গ্রামে মোঘলপরবর্তী যুগের ছয়টি মসজিদ স্থাপত্য৷ বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ৷সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের শাসনকালে সুফি সাধক সেনাপতি খানজাহান আলী ১৮৪২ থেকে ১৪৫৯ সাল মধ্যে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন৷

মুঘল সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকায় অনেক স্থাপত্যকীর্তি নির্মিত হয়৷কিন্তু কালের বিবর্তনে খুব কম সংখ্যকই আদিরূপে টিকে আছে৷ টিকে থাকা স্থাপত্যগুলোর মধ্যে মসজিদই প্রধান৷ তবে এ সব পূরনো মসজিদের সামগ্রিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়৷ অপরিকল্পিত সংস্কার ও সম্প্রসারণের কারণে বিনষ্ট হয়েছে অগণিত মসজিদের মূল বৈশিষ্ট্য৷ অনেকক্ষেত্রে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে বিলীন করে আধুনিক রূপ দেয়া হয়েছে৷ যেমন ঢাকায় কালের আঘাত সহ্য করে টিকে থাকা সুলতানী আমলের প্রধানতম মসজিদটি হলো বিনত বিবির মসজিদ৷ ঢাকার নারিন্দায় অবস্থিত এই মসজিদটি সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের শাসনামলে জনৈক মারহামাতের কন্যা বখত বিনত ১৪৫৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেন৷ প্রকৃতপক্ষে নির্মাণকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই দীর্ঘসময় মসজিদের এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে, মসজিদের গায়ে শীলালিপিটিই প্রাচীনত্ব বোঝার একমাত্র সম্বল হয়ে পড়েছে৷ বর্তমানে মসজিদটি ত্রিতল ইমারত, যদিও আদিতে এটি ছিল এক গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদ৷

অপরিকল্পিত সংস্কার ও সম্প্রসারণে মসজিদের আদিরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত এই মসজিদ৷ এছাড়া মুঘল আমলে ঢাকায় গুরুত্বপুর্ণ স্থান কাওরান বাজারে ১৬৭৭-৭৮ সালে নবাব শায়েস্তা খাঁর প্রধান আমাত্য খাজা অম্বর তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যেটি খাজা অম্বর মসজিদ নামে পরিচিত৷ ১৭০৫ সালে  জনৈক খান মোহাম্মাদ মীর্জা  লালবাগে খান মোহাম্মাদ মৃধা মসজিদটি নির্মাণ করেন৷ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে নির্মিত মতিঝিলের দিলখুশা মসজিদটি চিরাচরিত মুঘল স্থাপত্যরীতির তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ৷ মসজিদটি মুলত নবাব সলিমুল্লার ওয়াকফ স্টেটের অধীনে হলেও রাজউকের তত্ত্বাবধানে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে সংস্কার কাজ করে আধুনিক মাত্রা দিয়ে মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও আবেদন নষ্ট করা হয়েছে৷ অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে আরমানিটোলায় মুঘল স্থাপত্যের অন্যান্য মসজিদের ন্যায়ে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট অলংকরণ বর্জিত সাদামাটা একটি মসজিদ নির্মাণ করেন মীর্জা গোলাম পীর৷ গোলাম পীরের মসজিদ নামে পরিচিত সেই মসজিদটি সংস্কারের পরে বর্তমানে ‘তারা মসজিদ' নামে পরিচিত৷

ঢাকার প্রাচীন মসজিদগুলোর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় অপরিকল্পিত সংস্কার ও সম্প্রসারণের ফলে মসজিদগুলোর আদিরূপ ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিনষ্ট হয়েছে৷ আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রাচীন মসজিদই স্থানীয় জনসাধারণের উদ্যোগে রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে থাকে৷ ফলে সর্বসাধারণের অসচেতনতায় নানারূপ অপরিকল্পিত সংস্কার ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমে এসব মূল্যবান নিদর্শন বিনষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত৷ এর সাথে যুক্ত হয় সরকারি সংস্থাগুলোর অদক্ষতা, অবহেলা ও নির্লিপ্ততা৷

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রত্যেক জাতির জন্যই অমূল্য সম্পদ৷ এ সম্পদ আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে৷ অথচ আমাদের দেশের এই মূল্যবান নিদর্শন সংরক্ষণের যথাযথ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি৷ এরই ধারাবাহিকতায় ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের সাক্ষ্যমহামূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রাচীণ স্থাপত্য কাঠামো ও প্রত্ননিদর্শন৷ এগুলোকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার কাজটি করে থাকে আমাদের জাদুঘরগুলো৷ যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার জন্য যে জাদুঘর আমাদের রয়েছে সেগুলো এখনো উনিশ শতকে পড়ে আছে৷ এগুলোকে প্রকৃত অর্থে জাদুঘর না বলে উন্মুক্ত গুদাম বলা যায়৷ কারণ এগুলোতে কেবল সারিবদ্ধভাবে নিদর্শনগুলো প্রদর্শণের মাঝেই সীমাবদ্ধ রেখেছে তাদের কাজ৷ কিন্তু জাদুঘরকে আরও বেশি জনগণসম্পৃক্ত করতে হবে৷ নতুন নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকেন্দ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে৷ দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সুরক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও জাদুঘরগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে৷ তাহলে নতুন প্রজন্ম দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে৷ ভালোবাসতে জানবে দেশের মুল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোকে ও এ দেশের আপামর মানুষকে৷

সিকদার মো. জুলকারনাইন
সিকদার মো. জুলকারনাইন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারি অধ্যাপকছবি: DW

আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা না গেলে আমাদের ঐতিহ্যর ধারক ও বাহক এ সব অমূল্য নিদর্শন অচিরেই বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে৷ তাই এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করার এখনই সময়৷ সে জন্য জনসাধারণকে সচেতন ও সম্পৃক্তকরণ, প্রত্নবস্তু সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট আইনকে যুগোপযোগী করা, পেশাজীবী দক্ষ জনবল তৈরি করা, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণে কাজ করা যেতে পারে৷ সর্বোপরি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের সচেতন ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সুরক্ষায়, সংরক্ষণে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেতে পারে৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷