1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পুলিশ মামলার এজাহার পাল্টে দেয়!

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৬ আগস্ট ২০২১

পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যারা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত পুলিশই করে৷ অভিযোগ আছে তদন্ত করতে গিয়ে অপরাধীদের বাঁচিয়ে দেয়ার৷

https://p.dw.com/p/3zWxS
Bangladesch Terror-Anschlag gegen Kontrollpunkt der Polizei in Dhaka
ফাইল ফটোছবি: Getty Images/AFP/STRINGER

এমনকি মামলার এজাহার পরিবর্তন করে সুবিধা করে দেয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে৷

ফেনীতে স্বর্ণ ডাকাতির আসামি পুলিশ সদস্যরা এখনো রিমান্ডে আছেন৷ আর তার মধ্যেই দিনাজপুরে পুলিশ সদস্যরা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন৷

দিনাজপুরের ঘটনায় সিআইডির এএসপি সরোয়র কবীরসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷ প্রকৃতপক্ষে তাদের আটক করেছে সাধারণ মানুষ৷ পরে পুলিশ তাদের আদালতে পাঠায়৷

তারা ২৩ আগস্ট রাতে দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের আবদুলপুর নাইন্দর গ্রাম জোহরা বেগম ও তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলমকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে৷ ওই দুজনকে অপহরণ করার আগে বাড়ির ভিতরে ভাঙচুর করে৷ অপহৃত জাহাঙ্গীরের চাচা মোহাম্মদ আবদুল জলিল বলেন, ‘‘তারা একটি মাইক্রোবাসে করে অপহরণ করে৷ অপহরণের সময় ডিবির পরিচয় দেয়, তবে গায়ে সিআইডি লেখা জ্যাকেট ছিল৷ নিয়ে যাওয়ার পর মোবাইল ফোনে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে৷ আমরা ঘটনাটা থানা পুলিশকে জানাই৷ অন্যদিকে তদের ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেবো বলে জানাই৷ এরপর পুলিশের সহায়তায় তাদের ফোন ট্র্যাক করে মঙ্গলবার দশ মাইল এলাকায় তাদের আটক করি৷’’

তিনি জানান, ‘‘আমরা কয়েকশ’ লোক নিয়ে মোটর সাইকেলে ব্যারিকেড দিয়ে তাদের আটক করি৷ তারা পালানোর চেষ্টা করেছিল৷ তবে এরমধ্যে থানা পুলিশ এসে পড়ায় তারা পালাতে পারেনি৷’’

গোপাল কান্তি দাস

জলিল আরো বলেন, ‘‘আমরা এখনো আতঙ্কে আছি৷ কারণ, শেষ পর্যন্ত পুলিশ ঘটনা কোন দিকে নিয়ে যায় বলতে পারছি না৷ তাদের রিমান্ডে কেন নেয়া হলোনা তা-ও প্রশ্ন৷’’

এদিকে ফেনীতে একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ২০টি সোনার বার লুটের ঘটনায় ডিবির ওসি সাইফুল ইসলাম ও তার পাঁচ সহযোগী ১৭ দিনের রিমান্ডেও কোনো তথ্য বা স্বীকারোক্তি দেয়নি৷ ২০ টি সোনার বারের ১৫টি ঘটনার সময় উদ্ধার হলেও বাকি পাঁচটি সোনার বার এখনো উদ্ধার হয়নি৷ এই মামলার বাদী গোপাল কান্তি দাস এখন আাতঙ্কে আছেন৷ তিনি অভিযোগ করেন,পুলিশ তার এজহার পরিবর্তন করে দিয়েছে৷ তিনি যে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সেটা এজাহার হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি৷ পুলিশ ঘটনার সময় আরো কয়েকটি কাগজে সই নিয়েছিল- এই দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘সেখানে পুলিশের নিজের লেখা একটি এজাহার ছিল৷ থানা সেটাই রেকর্ড করেছে৷ তাতে অনেক তথ্যের গরমিল রয়েছে৷ অনেক অভিযোগ বাদ দেয়া হয়েছে৷ আমি এখন আশঙ্কা করছি মামলাটি দুর্বল করে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের সুবিধা দিতেই অন্য পুলিশ সদস্যরা এই কাজ করেছে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমি ডিআইজি সাহেবের আশ্বাসে অভিযোগ দিয়েছিলাম৷ নয়তো আমার সাহস ছিল না পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করার৷ কয়েকদিন আগে এজাহার পরিবর্তনের বিষয়টি জানার পর আমি ডিআইজি সাহেবকেও জানিয়েছি৷’’

ড. মিজানুর রহমান

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন তার এই অভিযোগের জবাবে বলেন, ‘‘তিনি শুরুতে মামলাই করতে চাননি৷ আমার অনুরোধে মামলা করেছেন৷ তিনি আমার কাছে এসে পরে অভিযোগ করেছেন যে, তার এজাহার রেকর্ড করা হয়নি৷ পুলিশ তাদের মতো এজাহার করেছে৷ এখন মামলা তদন্ত করছে পিবিআই৷ আমি তাকে পিবিআইর কাছে নতুন করে অভিযোগ  লিখে দিতে বলেছি৷ সেটাই গ্রহণ করা হবে৷’’

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন ,‘‘এখানেই হলো আসল সমস্যা৷ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ যদি পুলিশকে দিয়েই তদন্ত করানো হয়, তাহলে ন্যায় বিচার আশা করা যায় না৷ তারা কোনো না কেনোভাবে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের সহায়তা করেন৷ গ্রেপ্তার ও মামলা হলেও তদন্ত উল্টে যায়৷ শেষ পর্যন্ত বিচারের আওতায় আনা যায় না৷ ফলে পুলিশে অপরাধ তো কমেই না বরং আরো বাড়ে৷ তাই আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত আলাদা কোনো সংস্থা বা বিচার বিভাগের মাধ্যমে করা হোক৷’’

সাবেক এআইজি সৈয়দ বজলুল করিম বলেন, ‘‘অপরাধী পুলিশ সদস্যদের প্রতি তাদের সহকর্মীরা সহানুভূতি দেখায়, রিমান্ডে নিয়ে জামাই আদর করে৷ হ্যান্ডকাফ পরায় না৷ অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখতে হবে৷ পুলিশ সদস্যরা অপরাধ করলে তারা পুলিশের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা পায় বলেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে৷ তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে৷ চেইন অব কমান্ডে সমস্যা আছে৷ নজরদারী ও জবাবদিহিতার অভাব আছে৷’’

পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ আরো অনেক আছে৷ গত বছরের ২৯ জানুয়ারি ঢাকার সদরঘাটে সোহেল নামের এক ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৪ লাখ টাকা ছিনতাইয়ে সাত পুলিশ সদস্য জড়িত থাকায় তদের গ্রেপ্তার করা হয়৷
৩ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ডিবি পরিচয়ে আব্দুল মান্নান নামের এক ব্যক্তির বাসায় প্রবেশ করে তাকে তুলে নিয়ে টাকা আদায়ের ঘটনায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য আটক হন৷

গত বছরের অক্টোবরে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ছিনতাইকারী সাজিয়ে রায়হান নামের যুবকের কাছ থেকে টাকা না পেয়ে তাকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়৷ ১৯ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আউটপাড়া এলাকায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে গাজীপুর মহানগর পুলিশের এক কনস্টেবলসহ দুজনকে আটক করেন এলাকাবাসী৷ ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ডিবি পরিচয়ে এক গাড়িচালকের ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়৷

আর গত বছরের ৩১ জুলাই কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের কথা তো সবার জানা৷ ওই মামলায় ওসি প্রদীপসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে৷ কিন্তু বিচার চলাকালে কাঠগড়ায় বসে পুলিশের দেয়া মোবাইল ফোনে বাইরে কথা বলেছেন তিনি৷

পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশের বিরুদ্ধে বছরে ২৫ হাজারের মতো অভিযোগ জমা পড়েলেও গড়ে মাত্র দুই হাজার পুলিশের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতিসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশ সদরদপ্তরে হত্যা, অপহরণ, ছিনতাই, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, যৌন হয়রানি, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া,চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসার মতো অপরাধের অভিযোগ আসে৷ কিন্তু যে কয়জনের শাস্তি হয় তাদেরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘লঘু শাস্তি’ হয়৷

পুলিশের সাবেক আইজি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নূর মোহাম্মদই বলেন, ‘‘যার হাতে ক্ষমতা বেশি, তার অপরাধ করার সুযোগও বেশি৷ পুলিশের ক্ষেত্রে সেরকমই ঘটছে৷ তবে ঘটনা প্রকাশ হলে তাদের যে ছাড় দেয়া হয়, সব সময় তা ঘটে না৷ কিন্তু এখানে সুপারভাজিং অফিসারদের দায়িত্ব আছে৷ তারা যদি তদারকি ঠিকমতো করেন, তাহলে এই অপরাধ প্রবণতা কমবে৷’’

তিনি মনে করেন, ‘‘এইসব কর্মকর্তার ব্যাকগ্রাউন্ড ভালোভবে চেক করা দরকার৷ অন্য পুলিশ সদস্যদেরও৷ সেটা করা হলে আগেই সতর্ক হওয়া যায়৷ আর কঠোর শাস্তির কোনো বিকল্প নাই৷’’