1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা, এটাই আসল কথা

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
১০ সেপ্টেম্বর ২০২১

নিজের ঢাক নিজেই পেটাচ্ছে পুলিশ৷ তুলে ধরতে চাইছে তাদের মানবিক মুখ৷ কতটা কাজ হচ্ছে তাতে?

https://p.dw.com/p/40A4F
ছবি: AFP/A. Sankar

ভিডিওটা দেখে চমকে উঠেছিলাম৷ কলকাতার বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে, আবাসনের সামনে হাত মাইক ব্যবহার করে পুলিশের কর্মকর্তারা গাইছেন, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’, ‘আমরা করব জয়’৷ করোনার তখন প্রথম ঢেউ৷ লকডাউন চলছে৷ অপ্রত্যাশিত ভাইরাসের আক্রমণে মানুষ ভীত, সন্ত্রস্ত, ঘরবন্দি এবং বিষাদগ্রস্ত৷ তখন সবাইকে চাঙ্গা রাখতে করোনাজয়ের গান গাইছে পুলিশ৷ ভূতের মুখেো রামনামের মতো, অ্যামেরিকার নাগরিক অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিবাদের এই গান কি না পুলিশের মুখে? যাদের পরিচয়, অধিকারের আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করার জন্য, নির্মমভাবে বেধড়ক লাঠি, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার জন্য৷ তারাই গাইছে এই গান৷ আর তা দেয়া হচ্ছে কলকাতা পুলিশের টুইটারে৷ নেটিজেনরা তা হামলে পড়ে দেখছেন৷ সংবাদপত্র থেকে ডিজিটাল মিডিয়ায় তা খবর হচ্ছে৷

কলকাতা পুলিশ, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ বা ভারতের অন্য কোনো রাজ্যের পুলিশের খবরের কাগজ নেই৷ সংবাদ বুলেটিনও তারা সচরাচর বের করে না৷ তাদের হাতিয়ার হলো সামাজিক মাধ্যম৷ কলকাতা পুলিশের ওয়েবসাইট আছে৷ টুইটারে অতি সক্রিয় তারা৷ এখানে শুধু কলকাতা পুলিশের অ্যাকাউন্টই নয়, বিভিন্ন থানার, পুলিশের বড়কর্তাদের আলাদা অ্যাকাউন্ট আছে৷ সেখানে থেকে সমানে টুইট করা হয়৷ আর সেসব টুইট দেখলে মনে হবে, পুলিশের থেকে বড় বন্ধু আমজনতার আর কেউ নেই৷ মানুষ বিপদে পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তার কাছে হাজির৷ দিল্লি পুলিশের তো স্লোগানই হলো, ‘আপকা সাথ, আপকে লিয়ে সদৈব’, মানে, ‘আপনাদের সঙ্গে, আপনাদের জন্য পুলিশ সবসময় প্রস্তুত’৷ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের স্লোগান হলো, ‘উই কেয়ার, উই ডেয়ার’৷ আর কলকাতা পুলিশের ওয়েবসাইটে গর্বের সঙ্গে জানানো হয়েছে, ‘যে কোনো চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সদা প্রস্তুত’৷

হ্যাঁ, যা বলছিলাম, কলকাতা পুলিশের টুইট দেখলে রীতিমতো অবাক হয়ে যেতে হয়৷ এত মানবিক, এত সাহায্যকারী যে বলার নয়৷ অনেকটা অনুপম রায়ের গানের লাইনের মতো, বাড়িয়ে দাও তোমার হাত৷ তাহলেই পুলিশ সেই হাত ধরে সব সমস্যার সমাধান করে দেবে৷ যেমন গত ৪ সেপ্টেম্বর জোড়াসাঁকো থানা এলাকায় এক বৃদ্ধকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ৷ তার পায়ে পচন ধরতে শুরু করেছিল৷ একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ তিনি এখন সুস্থ৷ অথবা এয়ারটেল ও ক্রাই ইন্ডিয়ার সঙ্গে জোট বেঁধে গরিব বাচ্চাদের স্মার্ট ফোন এবং ফ্রি ডেটা সহ সিম কার্ড দেয়ার কাজ করছে কলকাতা পুলিশ৷ করোনাকালে জীবানুমুক্ত করার কাজ নিয়মিত চালাচ্ছে তারা৷ চুরি যাওয়া মোবাইল ফোন ফিরিয়ে দিচ্ছে মালিকদের কাছে৷ রাস্তায় পড়ে থাকা এটিএম কার্ড ও টাকা খুঁজে বের করে মালিকের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে৷ করোনাকালে তো খাবার পৌঁছে দেয়া, হাসপাতালে পৌঁছে দেয়ার কাজ খুবই সক্রিয়তার সঙ্গে করেছে পুলিশ৷ এসবই উঠে এসেছে তাদের টুইটার অ্যাকাউন্টে৷ রীতিমতো সক্রিয় প্রচার চলছে৷

এমন নয় যে, মানুষের পাশে থাকার এই কাজগুলো পুলিশ করেনি৷ করেছে৷ সাধারণ লোককে সাহায্য করার কাজ তারা অবশ্যই করছে৷ তার জন্য তারা প্রচারও করতে পারে সামাজিক মাধ্যমে৷ ভালো কাজের প্রচার তারা কেন করবে না৷ অবশ্যই করবে৷ কারণ, মিডিয়ায় তো তাদের ভালো কাজের কথা সাধারণত আসে না৷ তাই দরকার হলে তারা বুলেটিন বের করবে৷ চাইলে কাগজও বের করতে পারে৷ কিন্তু মুশকিল হলো, এই কিঞ্চিত ভালো কাজ সত্ত্বেও যে পুলিশকে নিয়ে সাধারণ মানুষের লাখ লাখ অভিযোগ আছে৷  অভিযোগ, এই পুলিশই ঘুস ছাড়া কোনো কাজ করে না৷ খুব গরিব খেটে খাওয়া মানুষের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা তোলে৷ ট্রাক, ম্যাটাডোরের কাছ থেকে ঘুষ খাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে তো মানুষের চোখ পচে গেছে৷ তা আর নতুন করে কোনো বিতৃষ্ণার জন্ম দেয় না৷ থানায় গেলে পুলিশ এফআইআর নিতে চায় না৷ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে ফল হয় না৷ তারা শত অন্যায় করলেও পুলিশ নড়ে বসে না৷ ক্ষমতাসীন দল, মন্ত্রী, আমলাদের হয়ে তারা হেন কাজ নেই যা করে না৷ পুলিশের এই যে ভাবমূর্তি আমজনতার মনে গেঁথে গেছে, যাদের অভিজ্ঞতা বলে, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা, তারা যখন পুলিশেরই এই মানবিক মুখ দেখেন, তখন কি তাদের মনে একটু সহানুভূতি জাগে?

প্রশ্নটা মাথায় আসতেই ফোন ঘোরালাম বন্ধু, পরিচিতদের কাছে৷ তারা সকলেই একবাক্যে বললেন, পুলিশ যখন মানবিক কাজ করে, সাহায্যের হাত বাড়ায়, তখন যে ভালোলাগা জন্মায় তা আদতে বেশিক্ষণ টেকে না৷ কারণ, এরপরই তো পুলিশের সেই চিরাচরিত ছবিটা সামনে চলে আসে৷ যার মধ্যে না কি মানবিকতার ছিঁটেফোটাও থাকে না৷  তাই নিতান্ত বাধ্য না হলে কেউ আইনরক্ষকের কাছে যান না৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

কিছুদিন আগের কথা৷ করোনাকালেনরওয়ের প্রধানমন্ত্রীকে জরিমানা করেছিল সেদেশের পুলিশ৷ আমাদের দেশের টাকায় এক লাখেরও বেশি জরিমানা৷ প্রধানমন্ত্রীর অপরাধ ছিল, তিনি নিজের জন্মদিন পালন করতে গিয়ে করোনাবিধি ভেঙেছিলেন৷ দশজন আমন্ত্রিতের জায়গায় ১৩ জনকে ডেকেছিলেন৷ আর প্রধানমন্ত্রী রীতিমতো ক্ষমা চেয়ে জরিমানা দিয়েছিলেন৷ আমাদের এই উপমহাদেশে কবে যে এরকম দৃশ্য দেখা যাবে! কবে যে ক্ষমতার সঙ্গে নয়, ন্যায়ের সঙ্গে থাকতে শিখবে পুলিশ৷ কবে যে দেখতে পারব, ঘুষ নেয়ার জন্য, অন্যায়ভাবে লাঠি চালানোর জন্য, সাধারণ মানুষের উপর জোরজুলুম করার জন্য পুলিশের শাস্তি হচ্ছে আর সেকথা সগর্বে টুইট করছে পুলিশ নিজেই৷ অথবা কোনো রাজনৈতিক দল, তাদের কর্তারা অন্যায় আবদার করলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিচ্ছে এবং সেকথা টুইটারে জানাচ্ছে, অথবা নিয়মিত কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সেই কথা ফলাও করে বলছে তারা৷ তখন বোঝা যাবে, সত্যি সত্যি পুলিশ নিজেদের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষের দিকে৷ তাদের বাঁচার কাজ সহজ করছে৷ গুণ্ডারা ভয় দেখাচ্ছে না, সিন্ডিকেটের কাছ থেকে বালি, ইট কিনতে হচ্ছে না, থানায় গেলে অভিযোগ লেখা হচ্ছে, সেই অভিযোগের সুরাহা হচ্ছে৷ না হলে কয়েকটা মানবিক ঘটনা তুলে ধরে যে ভাবমূর্তির বদল হয় না, হবে না৷

বামেরা একসময় স্লোগান দিতেন, পুলিশ তুমি যতই মার, মাইনে তোমার একশ বারো৷ সে পুলিশ তো এখন নেই৷ সপ্তম বেতন আয়োগের সুপারিশ কর্যকর হওয়ার পর পুলিশের মাইনেও প্রচুর বেড়েছে৷ তাদের দিন আনি দিন খাই অবস্থা আর নেই৷ তাহলে কেন ঘুসের, তোলাবাজির অভিযোগ উঠবে পুলিশের বিরুদ্ধে?

অথচ, পুলিশ চাইলে কী না করতে পারে৷ বইমেলায় হারিয়ে যাওয়া চাবি পর্যন্ত উদ্ধার করে দিতে পারে৷ অবশ্য সেই চাবি যদি কোনো প্রভাবশালী মানুষের হয়, তাহলেই তা উদ্ধার করা হবে৷ যে কোনো অপরাধীকে তারা চেষ্টা করলেই ধরে ফেলতে পারে৷ পকেটমার, ছিনতাইকারী, চোর, ডাকাত চাইলেই ধরতে পারে৷ কিন্তু.....৷

নিজের আসল কাজটা ঠিকভাবে না করলে শুধু টুইট করে, কাগজ বের করে, টিভি চ্যানেল চালিয়ে এবং প্রচারের সব কটা মাধ্যম ব্যবহার করে, উই শ্যাল ওভারকাম গয়ে নিজেদের ভাবমূর্তি বদল করতে পারবে না তারা৷ তাদের মানবিক মুখ বারবার ঢেকে যাবে অমানবিক বিজ্ঞাপনে৷ আর বলতেই হচ্ছে, সে বড় সুখের সময় নয়৷ তাই দয়া করে, নিজেদের কাজটা ঠিকভাবে করুক পুলিশ৷ তখন আর প্রচারের জন্য কিছু না করলেই চলবে৷ মানুষের ধারণা আপনেই বদলে যাবে৷