1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘পুঁজির পাচার স্বীকার করে ব্যবস্থা না নিলে সংকট কাটবে না’

সমীর কুমার দে ঢাকা
২ ডিসেম্বর ২০২২

এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় বিদেশে টাকা পাচার এবং রিজার্ভ কমে যাওয়া৷ কেন রিজার্ভ এত কমে যাচ্ছে? পাচার করা টাকাই বা কেন ফেরানো যাচ্ছে না? কিভাবে এই টাকা ফেরানো সম্ভব? অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরবেই বা কীভাবে?

https://p.dw.com/p/4KO4f
অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম
অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলামছবি: DW

এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম৷

ডয়চে ভেলে : সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে কী ব্যাংকের উপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে? 

ড. মইনুল ইসলাম : এটা বলা ঠিক হবে না৷ তবে কিছুটা আস্থাহীনতা তো তৈরি হয়েছে৷ বিশেষ করে খেলাপি ঋণ নিয়ে সরকার একটা লুকোচুরি খেলছে৷ সত্যি ঘটনাটা বলছে না৷ আমার মতে, খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে৷ কিন্তু ক্লাসিফায়েড লোনের যে হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক দিচ্ছে সেখানে বলা হচ্ছে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা৷ এখানে লুকিয়ে ফেলার একটা প্রবণতা আছে৷ বিচারাধীন মামলাগুলো বছরের পর পর ঝুলে রয়েছে৷ খেলাপি ঋণগুলো বারবার পুনঃতফসিল করা হচ্ছে৷ আর মন্দঋণ যেগুলো আছে সেগুলোও ক্লাসিফায়েড লোনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না৷ এগুলো যোগ করলে সেটা এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা নয়, চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে৷ এই যে খেলাপি ঋণকে লুকিয়ে ফেলার যে মানসিকতা আমাদের অর্থমন্ত্রীর মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা কোনোভাবেই সঠিক নয়৷ বরং খেলাপি ঋণকে ‘লাই’ দেওয়া হচ্ছে৷ তাদের শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে উল্টো উৎসাহিত করতে দুই শতাংশ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য রেগুলার করার যে ব্যবস্থা এটা ঠিক পন্থা নয়৷ এগুলো করাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে৷ তবে যে গুজব রটানো হচ্ছে ব্যাংকে আমানতের ঘাটতি, এটাও ঠিক নয়৷

‘বাংলাদেশ ব্যাংক পুরোপুরি অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনায় চলছে’

অর্থনৈতিক মন্দারোধে ব্যাংকিং খাত যে সরকারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সেটা দেখিয়ে এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন তিনজন ব্যাংকার৷ কিন্তু বাংলাদেশে চিত্রটা পুরো উল্টো? এর কারণ কী?

বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টরে ট্রান্সপারেন্সির অভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি৷ ৬৪টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে৷ যেটার কোন দরকার ছিল না৷ প্রধানমন্ত্রী নিজের ইচ্ছায়, পছন্দের লোকজনকে, ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোকে এই লাইসেন্স দিয়েছেন৷ একই সঙ্গে সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ এসআলম গ্রুপের কাছে পুঞ্জিভূত হয়ে গেছে৷ সরকার সে ব্যাপারে কিছুই করছে না৷ অতি সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের লোনের বিষয়গুলো নিয়ে যে নানারকম কথা বাজারে শোনা যাচ্ছে, পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে, এগুলো মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করতে বাধ্য৷ দেশের ব্যাংকিং খাতে সরকার ট্রান্সপারেন্সি নিয়ে কাজ করছে না৷ এগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে৷ এই যে পিকে হালদারের কেস বা বেসিক ব্যাংকের আব্দুল হাই বাচ্চুকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না৷ ব্যাংকিং খাতে সরকারের ভূমিকা স্বচ্ছ বলা যাবে না৷

যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে পরিশোধ করেন সেই সাধারণ মানুষকে ঋণ পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়৷ কিন্তু বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো, যারা ঋণ পরিশোধ করে না, তাদের কীভাবে এত টাকা দেওয়া হয়?

তারা তো ব্যাংকের মালিক, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি৷ আমরা দেখব, কয়েক হাজার মানুষের কাছে ব্যাংকের ঋণ পুঞ্জিভূত হয়ে আছে৷ ব্যাংকে আমানতের কোন ঘাটতি হবে না, এই কারণে যে এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ বিদেশে কাজ করছেন৷ তারা যে অর্থ পাচ্ছেন সেটা ব্যাংকিং চ্যানেলেই হোক আর হুন্ডির মাধ্যমেই হোক সেই টাকা শেষ পর্যন্ত আমানত হিসেবে ব্যাংকে জমা পড়বে৷ ফলে এ পর্যন্ত আমানতের কোন ঘাটতি হয়নি, হবেও না৷ বরং তারল্য উদ্বৃত্ত রয়েছে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ ঋণ নিতে  নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয় এবং তাদের অনেক ফরমালিটিজ তাদের মেনটেন করতে হয়৷ সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাংকের ঋণ নেওয়া অলমোস্ট ইমপসিবল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন৷ কিন্তু ব্যাংকের মালিক, বড় ব্যবসায়ীরা প্রভাব খাটিয়ে ঋণ বের করে নিচ্ছেন এবং এর বড় অংশ দেশের বাইরে পাচার করে দিচ্ছেন৷

কোন ব্যাংক কাউকে বড় অংকের ঋণ দিলে সেটা তো বাংলাদেশ ব্যাংক সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারে৷ তখন কেন তারা তদারক করে না৷ লুটপাটের এই দায় কী বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারে?

বাংলাদেশ ব্যাংককে যে স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার কথা ছিল, সেটা দেওয়া হয়নি৷ বাংলাদেশ ব্যাংক পুরোপুরি অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনায় চলছে৷ বর্তমান গর্ভনর অর্থমন্ত্রীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক৷ বাংলাদেশ ব্যাংক খুব বেশি সাহসী ভূমিকা পালন করতে পারছে না৷ অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকেও দুর্নীতি গেড়ে বসেছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন ডেপুটি গভর্নরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে৷ লুৎফুজ্জামান সরকার বা ফরাসউদ্দিনের সময় আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে যে সাহসী ভূমিকা নিতে দেখতাম এখন আর সেটা দেখছি না৷

সম্প্রতি পাবনায় মাত্র ২৫ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ১২ জন কৃষককে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে৷ আবার উল্টো বড় ঋণ খেলাপিদের ঋণ পরিশোধে নানা সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে৷ এই দ্বৈতনীতি কেন?

এই দ্বৈতনীতি ব্যাংকিংয়ের প্রধান সমস্যা৷ বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি বেক্সিমকো গ্রুপ৷ এই গ্রুপের সালমান এফ রহমান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা৷ তিনি যখন সরকারি এবং বেসরকারি খাতের নীতি নির্ধারণী ভূমিকায় চলে গেছেন বা মোস্তাফা কামাল যখন অর্থমন্ত্রী তখন বিষয়টা আপনাকে বুঝতে হবে এই সরকার বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে৷ তাদের সঙ্গে সরকারি দলের লেনদেনের ভূমিকা এত শক্তিশালী হয়ে গেছে, যে কারণে এই সরকারের কাছে স্বচ্ছতা বা নিয়মানুবর্তিতা আশা করা ঠিক হবে না৷

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা এমন আলোচনাও আছে৷ এই টাকা কীভাবে উদ্ধার হতে পারে?

এই টাকা উদ্ধারের কোন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এই সরকার দেখায়নি৷ বর্তমান অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর খেলাপি ঋণ বা এই টাকা উদ্ধারে কোন ভূমিকা পালন করছেন না৷ বরং অর্থমন্ত্রী সাত শতাংশ কর দিয়ে পাচার করা টাকা দেশে আনার যে কথা বাজেটে বলেছেন, সেটা তিনি জাতির সঙ্গে মশকরা করেছেন৷ আমরা দেখছি গত চার মাসে একটি টাকাও এভাবে দেশে আনতে কেউ আবেদন করেননি৷ বছরের শেষেও দেখা যাবে ফলাফল শূন্য৷ আমি বলব, বর্তমান সরকারের ভূমিকা টাকা পাচারের ব্যাপারে অত্যন্ত নেতিবাচক৷ তারা কঠোরভাবে এটা দমন করছে না৷ পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডি গত সেপ্টেম্বরে বলেছে, প্রতি বছর শুধু হুন্ডির মাধ্যমে ৭৫ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে বিদেশে পাচার হচ্ছে৷ তার মানে হুন্ডি কত শক্তিশালী হয়েছে৷ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত এক বছরে ২২ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে৷ সেই ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে আইএমএফের হিসাব করে দেখা যাচ্ছে ২৬ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে৷ এক বছরে ২২ বিলিয়ন ডলারের পতন একটা অত্যন্ত বিপদজ্জনক একটা ধারা৷ এটাকে থামানোর কোন প্রক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি না৷ এটা থামাতে হলে বিদেশে পুঁজি পাচার বন্ধ করতে হবে৷ 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর পাচার হচ্ছে গড়ে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা৷ এই টাকা চলে যাওয়ায় অর্থনীতিতে কী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে?

তারা ৭৩ হাজার কোটি টাকার কথা বলেছিল পুঁজি পাচার৷ আর সিআইডি বলছে, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় পাচার হচ্ছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা৷ তার সঙ্গে আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং বা রপ্তানির টাকা দেশে ফেরত না এনে বাইরে বাড়ি ঘর কেনা বা বেগমপাড়া বানানো, এগুলো বিবেচনা করলে দেশ থেকে প্রতি বছর ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হচ্ছে৷ আমি মনে করি, আমাদের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি করছে পুঁজি পাচার৷ সেটা সরকার যতক্ষণ স্বীকার না করছে এবং এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করছে ততক্ষণ অর্থনীতির সংকট কাটবে না৷

আগের ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না নেওয়ার কারণেই কী ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট বেড়েই চলছে? এ থেকে পরিত্রাণের পথ কী?

বর্তমান অর্থমন্ত্রী বা সালমান এফ রহমানেরা যতক্ষণ এই দায়িত্বে থাকবেন ততক্ষণ এই সংকট থেকে পরিত্রানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ কারণ তারাই এই সংকটের জন্য দায়ী৷ খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের প্রশ্রয় দেওয়া, তাদের উৎসাহিত করা এগুলো বর্তমান অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারের মধ্যে গেড়ে বসে আছে৷ সালমান রহমান তো তার বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ ২ শতাংশ দিয়ে ১০ বছরের জন্য পূনঃতফসিল করে নিয়েছেন৷ ফলে এগুলো থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকার নিষ্কৃতি পাবে ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরবে বলে আমি মনে করি না৷