পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন ও একজন আসিয়া বিবি
আসিয়া বিবি পাকিস্তানের এক খ্রিষ্টান নারী৷৷ ২০১০ সালে তাঁকে পাকিস্তানের এক আদালত ব্লাসফেমির দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ কে এই আসিয়া, কেনই বা তাঁর এই মামলা কেড়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর?
পানি নিয়ে বিরোধ
২০০৯ সালে পাঞ্জাবের শেখুপুরা জেলায় এক মাঠে কাজ করার সময় মহানবি হযরত মোহাম্মদকে অপমান করার অভিযোগ ওঠে আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে৷ মাঠে মুসলিম ধর্মাবলম্বী কিছু নারী কাজ করছিলেন৷ আসিয়া বিবি পানি নিতে গেলে ‘অমুসলিম’ বলে তাঁকে পানির পাত্র ধরতে দেননি তাঁরা৷ তারপর তাঁরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আসিয়া বেগমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনেন৷
স্পর্শকাতর বিষয়
মাঠের বাকবিতণ্ডার পর আসিয়ার বাসায় কিছু ‘ক্ষুব্ধ জনতা’ হামলা চালায় বলে জানায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যম৷ পরে পুলিশ আসিয়াকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা ব্লাসফেমির অভিযোগের তদন্ত শুরু করে৷ ৯৭ শতাংশ মুসলিমের দেশ পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননাকে বেশ স্পর্শকাতর বিবেচনা করা হয়৷
বিতর্কিত আইন
১৯৮০ সালে সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ব্লাসফেমি আইন চালু করেন৷ অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, অনেকক্ষেত্রেই এই আইনকে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হয়৷ খ্রিস্টান, হিন্দু, এমনকি ইসলামের সংখ্যালঘু গোত্র আহমাদিয়াদের বিরুদ্ধেও এই আইনের অপপ্রয়োগ করা হয়৷
রাষ্ট্র বনাম আসিয়া
২০১০ সালে এক আদালত আসিয়াকে ধর্ম অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে৷ বাদীর আইনজীবী অভিযোগ করেন, ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছে৷ কিন্তু আদালত আসিয়ার ফাঁসির রায় দেন৷ ২০১০ সাল থেকেই আসিয়ার পরিবার ভয়ের মধ্যে বাস করছে৷ তখন থেকে আসিয়ার মুক্তির জন্য তাঁর স্বামী আশিক মাসিহ আইনি-যুদ্ধ করে চলেছেন৷
গুপ্তহত্যার শিকার সমালোচকরা
২০১০ সালে পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর সালমান তাসির আসিয়ার পক্ষে দাঁড়ান৷ ব্লাসফেমি আইনের সংস্কারেরও দাবি তুলে তিনি৷ তাঁর এই অবস্থানে ক্ষুব্ধ হয় চরমপন্থিরা৷ ২০১১ সালে ইসলামাবাদে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন তাসির৷ একই বছর ব্লাসফেমি আইনের আরেক সমালোচক তৎকালীন সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিও বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন৷
হত্যাকারীকে সংবর্ধনা
তাসিরের হত্যার পর চরমপন্থি নেতা কাদরি রীতিমতো নায়কে পরিণত হন৷ তাকে কারাগারে নেয়ার সময় লাল গোলাপ ছিটিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয়৷ ২০১৬ সালে কাদরিকে ফাঁসি দেয়া হয়৷ কাদরির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজার হাজার ইসলামপন্থি জড়ো হয়েছিলেন৷ এমনকি কাদরির নামে তার স্মরণে একটি মাজারও প্রতিষ্ঠা করে তার সমর্থকরা৷
বিচার বিভাগে ভীতি
ব্লাসফেমি আইনের সমালোচকদের হত্যাকাণ্ডে ভয় ঢুকেছে আইনজীবীদের মধ্যেও৷ আসিয়ার পক্ষে হাই কোর্টে লড়তে কোনো আইনজীবীই সম্মতি জানাননি৷ ২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্ট আসিয়ার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে৷ ২০১৬ সালে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গেলেও এক বিচারক ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে তাতে অংশ নিতে রাজি হননি৷
আইনের খাড়া
অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পাকিস্তানে অন্তত ৪০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সেক্যুলার মুসলিমদের এই আইনের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়৷ এখনো এই আইনের আওতায় কারো বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা না হলেও ক্ষুব্ধ জনতার হাতে মৃত্যুর উদাহরণ রয়েছে অনেক৷
ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন
পাকিস্তানে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা প্রায়ই আইনি ও সামাজিক বৈষম্যের অভিযোগ করেন৷ গত কয়েক বছরে প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র সন্দেহের বশে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে অনেক খ্রিষ্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে৷
ইসলামপন্থিদের হুমকি
আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায় পালটে গেলে ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির’ হুমকি দিয়ে রেখেছে পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা, বিশেষ করে তেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান- টিএলপি৷ দেশটির খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের আশংকা, বিচারকরা রায় পালটানোর সিদ্ধান্ত জানালে পুরো দেশজুড়ে তাঁদের ওপর নৃশংসতা শুরু হতে পারে৷
আন্তর্জাতিক সমর্থন
বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংগঠন আসিয়ার মামলার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছে৷ আসিয়ার মেয়ে ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের সাথে দেখা করে এসেছেন৷২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্টের রায়কে ‘ভয়াবহ অবিচার’ আখ্যা দেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিস আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের নিন্দা জানিয়েছে৷