পশ্চিমবঙ্গে নারীর শাড়ি ও শাড়িশিল্পীর জীবন, জীবিকা
বাংলার তাঁতের সঙ্গে জুড়ে আছে অক্লান্ত শ্রম, সৃজনশীলতা ও ঐতিহ্য৷ পশ্চিমবঙ্গে নারীদের অতি প্রিয় বালুচরী, ধনেখালি ও শান্তিপুরী শাড়িতেও এই তিন মিশে একাকার৷ ছবিঘরে শাড়ির সৌন্দর্যের সঙ্গে থাকছে শিল্পীদের জীবন, জীবিকার কথাও...
ধনেখালির তাঁত
খুব অল্প সময়ে বহর, মান, বৈচিত্র্য আর রং দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সব প্রান্তের মানুষের মন জয় করে নেয় এই শাড়ি৷ হুগলি-দামোদর সমভূমির ধনেখালির তাঁতিরা নানা সুতোর নিপুণ বুননে তৈরি করেন এই তাঁতের শাড়ি৷ ধনেখালি শাড়িকে তাঁতের শাড়ির মধ্যে ‘সোনার ফসল’ বলা হয়৷ অতীতে ঐতিহ্যগতভাবে লাল বা কালো পাড় রাখা হতো৷ ইদানীং অন্যান্য রঙের পাড়ও ব্যবহার হচ্ছে৷
বালুচরীর আভিজাত্য
মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ সংলগ্ন বালুচর নামক এলাকায় বালুচরীর জন্ম৷ পরে বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আবার বালুচরীর সমৃদ্ধি ঘটে৷ বালুচরী শাড়ি যেন কথা বলে৷ পুরাণ কাহিনি থেকে মহাভারতের গল্প বছরের পর বছর ফুটে উঠেছে বালুচরীতে৷ ইদানীং বাঁকুড়ার টেরাকোটা, ডোকরা বালুচরী শাড়িতে ফুটিয়ে তুলছেন শিল্পীরা৷ এরকম একেকটি শাড়ি তৈরি করতে শিল্পীদের এক সপ্তাহ বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগে।
শান্তিপুরী শাড়ি
তাঁতের শাড়ির ইতিহাসে শান্তিপুর– ফুলিয়া খুব উল্লেখযোগ্য৷ শান্তিপুরী শাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নদিয়ার শান্তিপুর অঞ্চলের অর্থনীতি৷ ১৮০৯ সালে গৌড়ের রাজা গণেশ দানু সাধনদেবের সময়ে শান্তিপুরে প্রথম শাড়ি বোনা হয়৷ তারপর স্বাধীনতাত্তোর কালে বাংলাদেশ থেকে তাঁতিরা শান্তিপুরে এলে শ্রীবৃদ্ধি ঘটে৷ একসময় নীলাম্বরী শান্তিপুরীর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া৷
টিমটিমে হ্যান্ডলুম
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ৭ আগস্টকে ন্যাশনাল হ্যান্ডলুম দিবস ঘোষণা করেন৷ তাঁতিদের আয় বৃদ্ধিতে জোর দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য৷ কিন্তু সরকারি উদাসীনতায় হস্তচালিত তাঁত বিলুপ্তির পথে৷ জ্যাকার্ড তাঁতের আগমনে মাঠা তাঁতের সংখ্যা কমতে শুরু করে৷ কিন্তু পাওয়ার লুমের আগমনে এই দুটিই হারিয়ে যেতে বসেছে৷
পাওয়ারলুমের রমরমা
প্রাকৃতিক তন্তু (যেমন, সুতো, রেশম) সবচেয়ে ভালো বোনা যায় হস্তচালিত তাঁতেই৷ এর পরিবর্তে এখন কম দামে বাজার ছেয়েছে পলিয়েস্টার তন্তু৷ প্রকৃতিতে এটি সহজে নষ্ট হয় না৷ পাওয়ারলুমেও এই তন্তু ব্যবহার করে সহজে বোনা যায়৷ আজকাল বাজারে হ্যান্ডলুম বলে পাওয়ারলুমের শাড়িই বিক্রি করা হচ্ছে৷ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সৌজন্যে উন্নত মানের পাওয়ার লুমে এবার তৈরি হবে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ইউনিফর্ম৷
মজুরি কম
হস্তচালিত তাঁতে তৈরি শাড়ির দাম বেশি হয়৷ কিন্তু যন্ত্রচালিত তাঁতে তৈরি প্রায় একইরকম শাড়ি পাওয়া যায় অনেক কম দামে৷ তাই খদ্দেরের কাছে কম দামের শাড়ি গ্রহণযোগ্য৷ একজন তাঁতি দৈনিক ৪৫০-৬৫০ টাকা মজুরি পান৷ তবে এই মজুরি অন্তত আড়াইজনের পরিশ্রমের৷ কেননা সুতোর নলি তৈরি থেকে নানা কাজে পরিবারের সদস্যরাও কাজ করেন৷
সমবায়
তাঁতিদের পণ্য ব্যাপক আকারে বিপণনের লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে সমবায়৷ এই প্রতিষ্ঠান তাঁতিদের শাড়ি তৈরির কাঁচামাল সরবরাহ করে৷ এরপর তৈরি পণ্য তন্তুজ, তন্তুশ্রীর মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা সমবায়গুলির কাজ৷ তাঁতিরা উৎপাদিত শাড়ি সমবায়ে দিয়ে বিনিময়ে পারিশ্রমিক পান৷ ব্যবসার সার্বিক মন্দায় এখন ধুঁকছে এই প্রতিষ্ঠানগুলি৷
রপ্তানী বন্ধ
তাঁতে তৈরি পণ্য শুধু দেশ নয়, বিদেশেও রপ্তানি হতো৷ শাড়ির সঙ্গে ওড়নাসহ নারীদের বস্ত্র সামগ্রী তৈরি করতেন তাঁতিরা৷ এখন রপ্তানি প্রায় বন্ধ থাকায় থরে থরে পড়ে রয়েছে সেই সব সামগ্রী৷ তাঁতিদের দাবি, সরকারিভাবে বিভিন্ন সময় তাঁতশিল্পকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে৷ তবে সার্বিকভাবে কোনোটাই কাজে আসেনি৷
স্বদেশি পণ্যের বিপণী
স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ সরকার বাৎসরিক দেড় লক্ষ পাউন্ডের পণ্য প্রতিবছর রপ্তানি করতো৷ কিন্তু একটা সময় তারা তাঁতশিল্প বন্ধ করে নিজেদের পোশাক বাজারে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল৷ তখন তাঁতশিল্পীরা তার বিরুদ্ধে সরবও হয়েছিলেন৷ শান্তিপুর- ফুলিয়ার অর্থনীতির একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তন্তু ও সেই সংক্রান্ত ব্যবসা৷ তাঁতের গৌরবের দিন অতীত হওয়ায় ভেঙে পড়েছে সেই অর্থনীতি৷ এখনো টিমটিম করে রয়েছে তন্তু ব্যবসার কয়েকটি বিপণী৷
তাঁতশিল্পীর রূপান্তর
তাঁতবস্ত্রের সূক্ষ্মতা এসেছে গ্রামীণ তাঁতশিল্পীদের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ও দক্ষতা থেকে৷ তাঁত বুননের মধ্যে বিভিন্ন ধাপ রয়েছে যা তাঁতশিল্পীদের পরিবারের সকলের সহযোগিতায় হয়৷ তবে অর্থনীতি ভেঙে পড়ায় বিকল্প পেশার দিকে ঝুঁকেছেন অনেকে৷ ফুলিয়ার শ্যামল বসাক ছিলেন দক্ষ তাঁতশিল্পী৷ ব্যবসা না চলায় বিকল্প আয়ের সংস্থান হিসেবে এখন টোটো চালান মাঝবয়সী শ্যামল৷
এবং ফুলিয়ার টাঙ্গাইল শাড়ি
বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো কুটির শিল্প টাঙ্গাইল। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল থেকেই এপারে এসে ফুলিয়ার তাঁতিরা বসতি স্থাপন করেছেন৷ তবে ফুলিয়ায় এসে তাঁতিরা যে শাড়ি বুনতে শুরু করলেন তা নতুন চেহারা পেলো৷ ফুলিয়া থেকে টাঙ্গাইলেও সেই সমস্ত বুননকৌশল পৌঁছায়৷ ফুলিয়ার টাঙ্গাইলের জন্য জিআই ট্যাগের আবদন করা হলেও বাংলাদেশ সরকারের আপত্তিতে তা কার্যকর হয়নি৷