1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বিচার ব্যবস্থাভারত

পশ্চিমবঙ্গে কেন ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করলো হাইকোর্ট?

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২৩ মে ২০২৪

লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে বাতিল হয়ে গেল লক্ষ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র।

https://p.dw.com/p/4gBDS
কলকাতা হাইকোর্টের ভবন।
কলকাতা হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। ছবি: Satyajit Shaw /DW

তবে যারা এই সার্টিফিকেট বা  শংসাপত্রের ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের চাকরি বহাল থাকবে।

সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্ট শিক্ষা নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপাতত শিক্ষকদের চাকরি যায়নি। এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যে আরো একটি বড় মাপের রায় দিল আদালত।

আদালতের রায়

হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা ও বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে, ওবিসি অর্থাৎ অন্য অনগ্রসর শ্রেণী বিষয়ক ২০১২ সালের বিধি বাতিল করা হচ্ছে। এই বিধি অনুযায়ী যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনগ্রসর শ্রেণীর শংসাপত্র দেয়া হয়েছিল, তাও বাতিল হচ্ছে।

যদিও আদালত বলেছে, ২০১০ সালের আগে বামফ্রন্টের আমলে যারা ওবিসি শংসাপত্র পেয়েছেন, তাদের কোনো অসুবিধা হবে না। ২০১২ সালের পর থেকে এই রায় কার্যকর হবে। পাঁচ লক্ষ মানুষের ওবিসি শংসাপত্র এতে বাতিল হয়ে গেল। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে আদালত।

দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, ২০১২ সালের শংসাপত্র দিয়ে যারা কোনো সুবিধা পেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই রায় কার্যকর হবে না। অর্থাৎ এই শংসাপত্র দেখিয়ে যদি কেউ চাকরি পেয়ে থাকেন, পরীক্ষায় বসে উত্তীর্ণ হয়ে থাকেন, তাদের চিন্তার কিছু নেই। তবে তারা ভবিষ্যতে এই শংসাপত্র ব্যবহার করে আর কোনো সুবিধা পাবেন না।

আদালত বলেছে, অনগ্রসর শ্রেণীর তালিকা তৈরি সময় ১৯৯৩ সালের ওবিসি আইন অনুসরণ করা হয়নি। কোনো জাতিকে ওবিসি তালিকাভুক্ত করার জন্য যে সমীক্ষার দরকার, সেটাও করা হয়নি। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য তালিকার ভিত্তিতে শুনানি বা রিপোর্ট প্রকাশের অবকাশ রয়েছে। সেই নিয়মও মান্য করা হয়নি বলে সব শংসাপত্র বাতিল করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট।

রাজনৈতিক তরজা

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রায়ের বিরোধিতা করেছেন। বুধবার নির্বাচনী জনসভায় তিনি বলেন, "এই রায় মানছি না, মানব না। এর জন্য যতদূর যেতে হয় যাব। এর আগে বলেছিলাম, শিক্ষক নিয়োগের রায় ঠিক নয়। এখন ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিলের ক্ষেত্রেও সে কথা বলছি।"

এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদীকে নিশানা করেন মমতা। তার পাল্টা জবাব দিল্লির জনসভা থেকে দিয়েছেন মোদী। তার মন্তব্য, "আজ কলকাতা হাইকোর্ট ইন্ডিয়া মঞ্চকে বড় একটা থাপ্পড় মেরেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভোটব্যাংকের জন্য যেভাবে খুশি মুসলমানদের ওবিসি বানানোর জন্য শংসাপত্র দিয়েছিল।"

নির্বাচনী প্রচারে প্রধানমন্ত্রী আগে বলেছেন, বিরোধীরা অনগ্রসর শ্রেণীর সংরক্ষণ কেটে সংখ্যালঘুদের দিতে চান। সেই সুরে অমিত শাহ  বলেন, "তৃণমূল সরকার পিছিয়ে পড়া সমাজের বিরোধী, এটা আদালত ফাঁস করে দিয়েছে। তিনি অনগ্রসরদের সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের দিয়েছেন।"

সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, "তৃণমূল সরকার ওবিসি সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছে। আইন মানা হয়নি। টাকা নিয়ে খোলামকুচির মতো সার্টিফিকেট বিলি করা হয়েছে। এখন তার ফল ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকে।" 

মমতা বলেছেন, "২০১২ সালে তৎকালীন মন্ত্রী উপেন বিশ্বাসকে কমিটির চেয়ারম্যান করে, আইন অনুযায়ী সমীক্ষা করে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। বিজেপি ও সিপিএম সেই সময় কোর্টে গিয়ে সুবিধা করতে পারেনি।" এই শংসাপত্র বজায় রাখতে রাজ্য আইনি লড়াই চালাবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

বাম আমলের আইন

এই বিধির শিকড় রয়েছে বামফ্রন্ট আমলে। তাকে হাতিয়ার করে অবশ্য বামপন্থীদের নিশানা করেননি মুখ্যমন্ত্রী।

এই সংরক্ষণের মাধ্যমে সুবিধা হওয়ার ব্যাপারটি খুব সীমিত হয়ে এসেছে: শুভময় মৈত্র

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তার জমানার শেষের দিকে সাচ্চার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাতে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানদের শোচনীয় ছবি ধরা পড়ে। শিক্ষা থেকে সরকারি চাকরি, সব ক্ষেত্রেই মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে ছিল।

সেই সময় রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান হয়েছে। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ও ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা খেয়েছে বামপন্থিরা। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন ছিল তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লড়াই। তার আগে ২০১০ সালে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় বামফ্রন্ট সরকার।

সেই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাম সরকার পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন গঠন করেছিল। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে বাম সরকার ওবিসি সংরক্ষণকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। মূলত মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশকে এর আওতায় আনা হয়।

পরবর্তীতে ছয় মাসের মধ্যে ৪২টি সম্প্রদায়কে ওবিসি তালিকাভুক্ত করে অনগ্রসর জাতি কমিশন। এর মধ্যে একটি বাদে বাকি সব কটি সম্প্রদায় ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী।

কমিশনের এই তালিকায় বাম সরকার সিলমোহর দেয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই সংরক্ষণের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের সমর্থন ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিল সিপিএম। ক্ষমতায় আসার পর এই সংরক্ষণ বাতিল করেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। তৃণমূলের আমলে ২০১২ সালে আরো ৩৫টি সম্প্রদায় ওবিসি তালিকাভুক্ত হয়।

বিধির ভবিষ্যত

আদালতের নির্দেশে বিষয়টি এখন নির্ধারিত হবে রাজ্য বিধানসভায়। বিচারপতিরা বলেছেন, ১৯৯৩ সালের ওবিসি সংক্রান্ত আইন মেনে ও সংশ্লিষ্ট কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে রাজ্য সরকারকে তালিকা চূড়ান্ত করতে হবে। রাজ্য এই সংক্রান্ত তালিকা বিধানসভায় পেশ করবে। তারপর সেটি আইনের পরিণত করতে হবে।

অর্থনৈতিক মাপকাঠি ওবিসি নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। মামলাকারীর আইনজীবী বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "যারা আর্থিকভাবে সম্পন্ন, অর্থাৎ ক্রিমি লেয়ার, তাদের বাদ দিতে হবে। তাদের বাদ দেয়া হয়নি। কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করে সরাসরি ওবিসি করে দেয়া হয়েছে। ফলে পুরো প্রক্রিয়া অসাংবিধানিক।"

নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে? রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র বলেন, "সরকারি চাকরিতে যে সংরক্ষণের কথা আসে, কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে সেই চাকরি এমন ভাবে কমে যাচ্ছে যে, বুদ্ধিমান মানুষ জানেন, এই সংরক্ষণের মাধ্যমে সুবিধা হওয়ার ব্যাপারটি খুব সীমিত হয়ে এসেছে। তাই সংরক্ষণ কতটা জরুরি বা কাজে আসবে, সেটা মানুষ বিচার করলে বুঝতে পারবেন। চলতি নির্বাচনে ওবিসি সংক্রান্ত রায় খুব সাংঘাতিক প্রভাব ফেলেবে কি না, সেটা ততটা পরিষ্কার নয়।"