‘পথের পাঁচালী’র বোড়ালে
সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলা ছবির জয়যাত্রার সূচক৷ ৬২ বছর আগে ছবির পরিচালক বেশিরভাগ অংশই ক্যামেরাবন্দী করেন গড়িয়ার কাছে বোড়াল গ্রামে৷ কেমন আছে সিনেমাপ্রেমীদের সেই তীর্থক্ষেত্র?
সত্যজিতের মূর্তি
নিশ্চিন্দিপুর খুঁজতে সত্যজিৎকে সাহায্য করেছিলেন শিল্প-নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত৷ বোড়াল গ্রামের মধ্যে তিনি রেল লাইনের অংশটুকু ছাড়া গোটা নিশ্চিন্দিপুরকেই খুঁজে পেয়েছিলেন৷ বোড়াল গ্রামে প্রতিষ্ঠিত এই সত্যজিৎ মূর্তির ৫০ মিটার দূরেই বিভূতিভূষণ কথিত হরিহর-সর্বজয়ার কুটির৷
অপু দুর্গার বাড়ি
বোড়াল গ্রামের বাসিন্দা মুখোপাধ্যায় পরিবারের এই বাড়িতেই ‘পথের পাঁচালী’-র চরিত্ররা বসবাস করেছে৷ অথচ আজ বাড়িটার কোনো সংরক্ষণ নেই, অনুদান নেই৷ এমনকি এই ইতিহাস রক্ষার সামান্যতম উদ্যোগ বা সচেতনতা নেই৷ কেবল এই বাড়ির বিষণ্ণতার আবেশে মিশে আছে আন্তর্জাতিক কৌতূহল৷
প্রবেশদ্বার
৫০ টাকা মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে সত্যজিৎ রায় এই বাড়িতেই দরিদ্র হরিহরের সংসার সাজিয়েছিলেন৷ ধ্বংসস্তূপের মতো ভাঙাচোরা এক কামরা ঘর ব্যবহার করা হয়েছিল ইন্দির ঠাকুরের ঘর হিসেবে৷ বাকি সেট পরিচালক তৈরি করে নিয়েছিলেন৷ এখন এখানে পাকাবাড়ি তৈরি হয়েছে৷
উঠোন
বোড়ালের অনেক বাসিন্দাই জানেন না যে এই মুখোপাধ্যায় বাড়িতেই শ্যুটিং চলেছে ‘পথের পাঁচালী’-র৷ এই উঠোনেই বহু কালজয়ী দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে৷ বাস্তবে হরিহর রায়ের এক টুকরো উঠোন আজ সংবেদনশীল মানুষের কাছে বড় অচেনা৷
তুলসীমঞ্চ
ছবির বহু দৃশ্যে এই তুলসীমঞ্চ বারবার দেখা গেছে৷ কংক্রিটের সাম্রাজ্যে সর্বজয়ার তুলসীমঞ্চ আজ বড় অযত্নে হারিয়ে গেছে ঝোপের আড়ালে
জলকে চল
মুখোপাধ্যায় বাড়ির কাছে অবস্থিত এই পুকুরেই অপু তার দিদির পুঁতির মালা ফেলে দিয়েছিল৷ ইন্দির ঠাকরুনের অন্ত্যেষ্টির পর এই পুকুরে হরিহর স্নান করে৷ এই পুকুর আজ অব্যবহৃত, কচুরিপানায় পূর্ণ, যেন প্রোমোটারের গ্রাসে পড়ায় অপেক্ষায়!
মন্দির
কাজের খোঁজে নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে যাওয়ার সময় হরিহর এই গ্রামীণ মন্দিরেই প্রার্থনা করে৷ আজও এই মন্দিরে পুজো-প্রার্থনা চলে৷ ১৬৯৮ সালে তৈরি এই মন্দির প্রত্নতত্ত্বের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ আজও৷
হে বিষ্টি ধরে যা
প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এই বকুলগাছ ছবির অপু-দুর্গাকে ভারী বৃষ্টির সময় আশ্রয় দিয়েছিল৷ আজ সে বকুলগাছও নেই, আর গাছের তলায় বসে কেউ প্রার্থনাও করে না, ‘নেবুর পাতায় করমচা, হে বিষ্টি ধরে যা৷’ পেছনের পুকুরটিও মুছে যাওয়ার পথে৷
সেই বাঁশবন
মুখোপাধ্যায় বাড়ির কাছের এই বাঁশবন সত্যজিৎকে চলচ্চিত্রে নিশ্চিন্দিপুরের পরিবেশ ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে৷ ইন্দির ঠাকুরের মৃ্ত্যুদৃশ্যে এই বাঁশবনের দুর্দান্ত ব্যবহার আজ ইতিহাস৷
ভাঙা পাঁচিল
লোকেশন দেখে বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও সত্যজিৎ – এ দু’জন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুখোপাধ্যায়দের ভাঙাচোরা বাড়িটাকেই পুনর্নিমাণ করে দরিদ্র হরিহর রায়ের বাড়ি হিসেবে দেখানো হবে৷ বাইরের এই শ্যাওলা ধরা ভাঙা পাঁচিল সেদিন ছিল না৷ পাঁচিল সহ ভেতরের রান্নাঘর, দরজার সেট তাই সত্যজিৎ রায়কে তৈরি করে নিতে হয়েছিল ছবির স্বার্থে৷
উঠোনে জবা গাছ
রবিনসনের ভাষায়, ‘‘রে’স প্রিন্সিপাল চ্যালেঞ্জ ইন টার্নিং পথের পাঁচালী ইন্টু এ ফিল্ম হোয়াজ, আইরনিক্যালি এনাফ, টু ডিস্পেল হিজ ইগনোরেন্স অফ ভিলেজ লাইফ৷’’ বাড়ির উঠোনে এখনও রয়েছে ছবিতে ব্যবহৃত জবা গাছটি৷ তুলসী মঞ্চের বিপরীতে থাকা এই গাছটিও যেন ছবির আরেক পার্শ্ব চরিত্র৷
প্রকৃতির পাঁচালি
বংশী চন্দ্রগুপ্ত এক বন্ধুর মাধ্যমে বোড়ালের এই মুখোপাধ্যায় বাড়ির খোঁজ পেয়েছিলেন৷ নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন ছবির সেট৷ এই বাড়ির অনেক গাছগাছালি সেই সেট-এর অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল৷ এই গাছগুলো সেই শ্যুটিংয়ের সাক্ষী৷