নয়া নীতিতে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবায় সংকটের আশঙ্কা
২১ ডিসেম্বর ২০১৯জেলায় জেলায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল৷ কিন্তু তাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব৷ সেটা মেটাতে সরকার আগামী বছর থেকে এমডি পঠনপাঠনে নিয়ন্ত্রণ জারি করতে চলেছে৷ নতুন নিয়মে সরকারি চিকিৎসকরা এমডি পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন না৷ এমডি ডিগ্রি লাভের পর চিকিৎসকরা রোগী পরিষেবায় যোগ দিচ্ছেন না, শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হচ্ছেন বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের অভিযোগ৷ এর ফলে রোগীরা পরিষেবা পাচ্ছেন না৷ এই সমস্যা বেশি ধরা পড়ছে গ্রামীণ অঞ্চলে৷ সেখানে হাসপাতাল গড়ে উঠলেও পাওয়া যাচ্ছে না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক৷ পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক বছরে অনেকগুলি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে৷ এর মধ্যে কয়েকটি মাল্টি সুপার স্পেশালিটি৷ জেলায় জেলায় এই পরিকাঠামো গড়ার উদ্দেশ্য শহরের চিকিৎসা পরিষেবার উপর চাপ কমানো৷ কিন্তু পরিকাঠামো গড়লেও চিকিৎসকের অভাবে পরিকল্পনা কার্যকর হচ্ছে না৷
এমডি ডিগ্রি নিয়ে প্রতি বছর যত চিকিৎসক পাশ করছেন, তার একটা বড় অংশ চিকিৎসার কাজে যোগ দিচ্ছে না৷ স্বাস্থ্য দফতরের হিসেব অনুযায়ী, এই সংখ্যা পাশ করা চিকিৎসকদের প্রায় অর্ধেক৷ এই সমস্যা মেটাতে নয়া নীতির পরিকল্পনা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ একমাত্র এমডি পঠনপাঠনে ঝোঁক কমালে তবেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতি দূর করা যাবে৷ সরকার কোনো এমডি ডাক্তারকে শিক্ষকতায় যোগ দেওয়া থেকে বিরত করতে পারে না৷ তাই স্বাস্থ্য দফতরের পরিকল্পনা, সরকারি চিকিৎসকদের এমডি পঠনপাঠনে নিয়ন্ত্রণ জারি করলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বেশি সংখ্যায় গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবায় পাওয়া যাবে৷ এই চিকিৎসকরা এমডি পড়ার ক্ষেত্রে যে সংরক্ষণ বা কোটার সুবিধা পান, একে বলা হয় সার্ভিস ক্যাটেগরি৷ এই সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হবে৷ সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার অর্থ, অনেক চিকিৎসকের এমডি পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হবে৷
পশ্চিমবঙ্গে পাশ করা চিকিৎসকের সংখ্যা ৭০ হাজার৷ এর মধ্যে ৮০ শতাংশ চিকিৎসকই শহরমুখী৷ তাঁদের গ্রামীণ পরিষেবার দিকে ঠেলে দেওয়ার যে সরকারি পরিকল্পনা, তার বিরোধিতা করছে সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন ‘সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম'৷ এই সংগঠনের সদস্য, বাঁকুড়া জেলার চিকিৎসক ডা. সজল বিশ্বাস বলেন, ‘‘চিকিৎসকদের জেলায় যেকে অনীহার অন্যতম কারণ সরকারি বদলি, পদোন্নতি, পোস্টিং নিয়ে দুর্নীতি৷ সরকারি চিকিৎসকদের এমডি, এমএস করার বিশেষ সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ সার্ভিস ক্যাটেগরি তুলে দিলে লাভ কিছু হবে না৷ এতে গ্রামীণ চিকিৎসা পরিষেবা ভেঙে পড়বে৷'' এক সরকারি চিকিৎসক জানান, ‘‘প্রশাসনের উদাসীনতার জন্য পশ্চিমবঙ্গে ১০,৩৪৬ জন রোগীপিছু রয়েছেন মাত্র একজন সরকারি চিকিৎসক৷ এই সংখ্যা সর্বভারতীয় স্তরে আরো খারাপ, ১১,৪৩৫ জন রোগীর জন্য একজন সরকারি চিকিৎসক রয়েছেন৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) এক হাজার জন রোগীপিছু একজন চিকিৎসকের কথা বলেছে৷''
চিকিৎসকদের বক্তব্য, সার্ভিস কোটা তুলে দেওয়ার নীতি কেন্দ্রীয় সরকারের, রাজ্য যা বাস্তবায়িত করছে৷ ২০১৯ সালেও সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েছেন চিকিৎসকরা, আগামী বছর থেকে উঠে যেতে পারে৷ উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. স্বপন বিশ্বাস বলেন, ‘‘নব্বইয়ের দশক থেকে এই সুবিধা চালু হয়৷ তিন বছর গ্রামে থাকলে চিকিৎসকরা উচ্চতর পঠনপাঠনে কোটার সুবিধা পান৷ সেটা উঠে গেলে গ্রামে যাওয়ার আগ্রহ কমবে৷'' এটাকে চিকিৎসা পরিষেবার বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ বলে মনে করছেন তিনি৷ ডা. বিশ্বাসের বক্তব্য, ‘‘একজন চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতালে চলে যেতে পারেন, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারেন৷ এতে তাঁর বিশেষ ক্ষতি নেই৷ ক্ষতি হবে গ্রামীণ জনতার৷''
বীরভূমের দুবরাজপুর গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শুভজিৎ রায় সংরক্ষণ প্রত্যাহারের পরিকল্পনায় উদ্বিগ্ন৷ বিপুল রোগীর ভার সামলাতে হয় তাঁকে৷ তিনি বলেন, ‘‘গ্রামীণ এলাকায় একজন চিকিৎসককে তিনজনের কাজ করতে হয়৷ অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ চালাতে হয়৷ আমরা একেক জন গড়ে একবেলায় ৩০০জন রোগী দেখি৷ সংরক্ষণ উঠে গেলে গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়বে৷ এটা গরিব মানুষকে বেসরকারি হাসপাতাল ও বীমা সংস্থার দিকে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত বলে মনে হচ্ছে৷''