নিম্ন আদালত ভার্চুয়াল থেকে আবার বাস্তবের মাটিতে
করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেই প্রায় আড়াই মাস পর গত রোববার থেকে আবার সকল অধস্তন বা নিম্ন আদালতে শারীরিক উপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে৷ আদালতপাড়ার সবাই কী চোখে দেখছেন বিষয়টিকে?
‘আদালত নিয়মিত না চললে সবার ক্ষতি’
ঢাকার এক নিম্ন আদালতের মুহুরি মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘‘আদালত নিয়মিতভাবে পরিচালিত হলে সবকিছু ‘মেন্টেন’ করতে সুবিধা হয়৷’’ এভাবে বারবার আদালত বন্ধ থাকার কারণে চলমান মামলাগুলো আরো দীর্ঘসূত্রিতার মাঝে পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি৷
এক মামলায় ১১ বছর
ঢাকার জেলা দায়রা জজ আদালতে কথা হলো এক মামলার বিবাদী বাচ্চু মোল্লার সঙ্গে৷ জমিজমা সংক্রান্ত মামলায় তার শুনানির নির্ধারিত তারিখ ছিল গত এপ্রিল মাসে৷ কিন্তু করোনার কারণে আদালত বন্ধ থাকায় বিচারকাজ এতদিন বন্ধ ছিল৷ মামলাটি প্রায় ১১ বছর যাবত চলছে জানিয়ে লকডাউনের কারণে আদালত একাধিকবার বন্ধ থাকার বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি৷
‘কোর্ট খুলসে ঠিক, কিন্তু ব্যবসা খারাপ’
ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণের চা-দোকানি মো. মনির বলেন, ‘‘কী আর বলবো স্যার, এ বছরের শুরু থেকেই ব্যবসা অনেক খারাপ৷ গতবছর ব্যবসা তা-ও চলসে কোনোরকম, কিন্তু এইবার একদমই পেটে-ভাতে যাইতেসে৷ কোর্ট চারদিন হইলো খুলসে ঠিক আছে, কিন্তু মানুষ নাই৷ লকডাউন আর করোনার কারণে আদালতে আগের ৫ ভাগের এক ভাগ লোকও হইতেসে না৷’’
‘করোনায় জমানো টাকা সব শেষ’
জজ কোর্ট প্রাঙ্গণে ২০ বছর ধরে স্ট্যাম্প ভেন্ডার হিসেবে কর্মরত আবু ইউসুফ জানান, গত বছর থেকে দুই দফা আদালত বন্ধ থাকায় তাদের আয়ে বড় রকমের ভাটা পড়েছে৷ আদালত বন্ধ থাকায় কোনোরকম আয় হয়নি গত আড়াই মাসে৷ জমানো টাকা যা ছিল, সবই প্রায় শেষের দিকে৷ এখন আদালত খুললেও মানুষের উপস্থিতি নেই বললেই চলে৷ এই সংকট সামনের বছরেও কাটবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় প্রকাশ করেন তিনি৷
‘ভার্চুয়াল আর একচুয়াল তো এক বিষয় না’
২১ বছর ধরে পেশকার হিসেবে কর্মরত মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা যে-কোনো পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য৷ তবে আদালত চালু থাকলে সেটা বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের জন্যই ভালো৷ সবকিছু তো অনলাইনে করা সম্ভব না, এতে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হয়৷ আমরা স্বাস্থ্যবিধি যতটুকু মানা সম্ভব সেটা মেনে জনগণকে সেবা দিচ্ছি, এতে কোনো অবহেলা করা হচ্ছে না৷’’
‘আমার মামলার রায় এতদিনে হয়া যাইতো’
ঢাকার বাড্ডা নতুন বাজার থেকে মুনমুন বেগম তার চার বছরের সন্তানকে নিয়ে আদালতে এসেছেন৷ এসেছেন সন্তানের পিতৃপরিচয় নিশ্চিতে ডিএনএ-র নমুনা বিষয়ে আদালতের আদেশের জন্য৷ তিনি জানাস, স্বামী সন্তানের ভরণপোষণ দিচ্ছে না, তাই দুই বছর আগে এ মামলা করেন৷ আদালত বন্ধ থাকার কারণে মামলার আদেশের তারিখও পাচ্ছিলেন না৷ তার মতো আরো অনেকেরই এই ভোগান্তি হচ্ছে বলে জানান তিনি৷
‘দৈনিক খরচ উঠানোই দায়’
জেলা ও দায়রা জজ কোর্ট প্রাঙ্গণের ভ্রাম্যমাণ হকার মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘১৫ কিলোমিটার দূর থেকে প্রতিদিন এখানে আসি দোকানে৷ যদি ব্যবসা-বাণিজ্য এমন খারাপ চলতেই থাকে, তাহলে অন্য কিছু করতে হবে৷ মাঝের দুই মাস বাসাতেই বেকার বসা আছিলাম৷ এখন কোর্টে মানুষ নাই, মাস্ক টুকটাক যা বিক্রি হয়, দিনের খরচাপাতি উঠানোই দায় হইয়া গেসে৷’’
‘আদালত খুলে দেওয়াকে সমর্থন করি না’
ঢাকার নিম্ন আদালতের আইনজীবী নূর মো. মাহবুবুর রহমান আদালত খুলে দেওয়া প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘করোনার এই পরিস্থিতিতে আদালত এভাবে খুলে আমাদের সবাইকে ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে৷ আমার দুইজন কলিগ মারা গেছেন করোনায়, অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন ইতিমধ্যে৷ কোর্ট খুলে দিলে আমরা আসতে বাধ্য, কিন্তু সবাই আতঙ্ক নিয়েই কাজ করছি৷ পেশাগত ক্ষতি বিশ্বব্যাপীই হচ্ছে, তাই বলে জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু হতে পারে না৷’’
‘ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠায় আদালতে শারীরিক উপস্থিতি প্রয়োজন’
চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নেজারত বিভাগের প্রধান নাজির মো. শাকিলুর রহমান বলেন, ‘‘অনলাইনে বিচারকাজ পরিচালনা করা যায়, কিন্তু সেটি যথাযথ হওয়া কঠিন৷ অনেক সময় বিচারকগণ অপরাধীদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ দেখে নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ তাছাড়া মোটামুটি সবই খোলা আছে, এক্ষেত্রে আদালতের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান খোলা রাখায় আমি ভুল কিছু দেখছি না৷’’