1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নারী এবং শিশুর জন্য আরো সহজ হোক জীবন

রুমা মোদক
রুমা মোদক
২৫ জানুয়ারি ২০২৩

আমার ঘরে গৃহকর্মীর কাজ করে যে মেয়েটি, সে স্বামী পরিত্যক্ত। একমাত্র সন্তানটিও মায়ের সাথে আমার বাসায়ই থাকে।

https://p.dw.com/p/4Mfqi
বাবা, মা এবং আইনগত অভিভাবক- এই তিন বিকল্পের একটি ব্যবহার করলেই চলবে বলে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট৷
বাবা, মা এবং আইনগত অভিভাবক- এই তিন বিকল্পের একটি ব্যবহার করলেই চলবে বলে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট৷ছবি: UNFPA Bangladesh/Naymuzzaman Prince

তার বয়স পাঁচ অতিক্রান্ত হয়েছে ২০২২-এর এপ্রিল মাসে। আমি উদ্যোগ নিয়ে সেবছর জানুয়ারি মাসে তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রি প্রাইমারিতে ভর্তি করে দিলাম। দুয়েক মাস পরই দেখি সে আর স্কুলে যায় না। তার মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘ওকে স্কুলে পাঠাও না কেন?'' ওর মায়ের কড়া উত্তর, ‘‘কী হবে স্কুলে গিয়ে? জন্ম নিবন্ধন নাই।''

জন্ম নিবন্ধনের সাথে স্কুলে যাওয়ার কী সম্পর্ক জানতে স্কুলে গেলাম। জানলাম প্রাথমিক স্কুলে লেখাপড়াকালীন উপবৃত্তিসহ যে কোনো সুযোগ-সুবিধার জন্য শিশুর জন্ম নিবন্ধন আবশ্যক।জন্ম নিবন্ধন ছাড়া শিশু কোনো সুবিধা প্রাপ্তির যোগ্য নয়।

এবার শিশুটির জন্ম নিবন্ধনের জন্য গেলাম পৌরসভায়। গিয়ে জানলাম পিতার এনআইডি ছাড়া তার জন্ম নিবন্ধন সম্ভব নয়। নানা তর্ক-বিতর্ক করলাম,যে জন্মদাতা (পিতা শব্দটি তার জন্য প্রযোজ্য নয়) সন্তানের খোঁজ নেয় না,ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয় না তার এনআইডি লাগবে কেন? লাগলেই বা পাবে কই? এই বাচ্চার মা তো জানেই না শিশুটির জন্মদাতা কোথায় আছে! যে জন্মদাতা জন্মের পর সন্তানসহ স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে চলে যায় আর কোনোদিন খোঁজই নেয় না, তার পরিচয়ের জন্য শিশুটির জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রমটি সম্পন্ন হবে না?তারা নিরুত্তর। আসলে তাদের কাছে কোনো উত্তর নেই। এমন ভুক্তভোগী অসংখ্য শিশু আমাদের চারপাশে, নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক জটিলতায় এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

এই শিশুসহ শিশুর মায়েদের তাদের জন্মদাতা পরিত্যাগ করেছে, কিংবা কোনো কারণে জন্মদাতা এবং জন্মদাত্রীর সংসার ভেঙে গেছে, জীবনের নানা ক্ষেত্রে সবচেয়ে হয়রানির শিকার ‘ভাঙা' পরিবারের শিশু সন্তানটি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংসার ভেঙে গেলে শিশুসন্তান মায়ের সাথেই থাকে। ভরণ-পোষণ থেকে শুরু করে সব দায়িত্ব মা পালন করা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় সব কাগজ পত্রে জন্মদাতার নাম উল্লেখ করতে হবে। শুধু তাই নয়, জন্মদাতার এন আই ডি, সাক্ষরসহ নানা কিছুর প্রয়োজন পড়ে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সবক্ষেত্রে। এ যে একা মায়ের জন্য কী ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তা ভুক্তভোগী নারীমাত্র হাড়েমজ্জায় টের পান।

গতকাল মহামান্য হাইকোর্ট একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছে

যে রায়ের ফলে পাসপোর্টসহ সব ধরনের ফরম পূরণে অভিভাবক হিসাবে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম উল্লেখ করা যাবে।

গত মঙ্গলবার ২৪ জানুয়ারি অভিভাবক হিসাবে মা কিংবা অন্য আইনগত অভিভাবকের নাম লেখার স্বীকৃতি দেওয়া সংক্রান্ত রিটের শুনানি নিয়ে জারিকৃত রুল যথাযথ ঘোষণা করে এ রায় দেন বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

এর আগে ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে রাজশাহী ঠাকুরগাঁয়ে বাবার নাম না লেখার কারণে পাবলিক পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে দেয়া হয়নি। সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২ আগস্ট বাংলাদেশ লিগাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), মহিলা পরিষদ এবং নারীপক্ষ শুধুমাত্র বাবার নাম লেখার বিপক্ষে রিট আবেদন করে।

৩ আগস্ট বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহম্মেদ ও বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ মানবাধিকার সমতার পরিপন্থি বিশেষভাবে শিক্ষার অধিকারে প্রবেশযোগ্যতার বাধাস্বরূপ বিদ্যমান বৈষম্যমূলক বিধানকে কেন আইনের পরিপন্থি ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা যাবে না- এ বিষয়ে রুল জারি করেন।

তা নিয়েই গতকাল এই যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করা হয়।

রায়ে বলা হয়েছে 'পিতৃপরিচয়হীন'। রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণে হয়ত এই পিতৃপরিচয়হীনতার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। তবে জনমনে প্রত্যাশা এই পিতৃপরিচয়হীন শব্দ যেন সীমাবদ্ধ হয়ে না পড়ে গুটি কয়েক ক্ষেত্রে। বরং তা যেন সকল নারী, তথা সকল একা মায়ের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখে।

মূলত প্রকৃতি পুরুষকে দায় দেয়নি। মানুষ ছাড়া আর কোনো (ব্যতিক্রম দুয়েকটি ছাড়া) প্রানীর মধ্যে পিতৃত্বের ধারণা নেই, আধিপত্য দূরে থাক, হদিসই নেই। মানুষের পিতৃত্বের ধারণা সভ্যতাজাত। মানুষ যত সভ্য হয়েছে, ততই তার সমাজ সুগঠিত ও সুসংহত করতে মানুষে মানুষে সম্পর্কের নানা নাম হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে মূল্যবোধ ও নানা বিধি-বিধান,ধ্যান-ধারণা। এরই একটি পিতৃত্ব। জৈবিক সম্পর্ককে মানুষ দায় এবং দায়িত্বে মহৎ করে তুলেছে। যে পুরুষ যতটা পিতা হতে পেরেছে, সে ততটা মহৎ হতে পেরেছে৷ পিতৃত্ব মহৎ মানবিক গুণ। প্রকৃতি যে দায় তাকে দিতে পারেনি সমাজ তাকে সে দায়ের বন্ধন দিয়েছে।

রুমা মোদক, শিক্ষিকা
রুমা মোদক, শিক্ষিকাছবি: privat

মূল্যবোধ, সংস্কার, সামাজিক দায় আবার অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদে ভিন্ন হয়। উচ্চবিত্ত, যাদের সামাজিক দায় নেই, সমাজকে যারা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলতে পারে, তারা এই মহৎ হবার দায়িত্ব দিব্যি অস্বীকার করতে পারে। আর নিম্নবিত্ত, যাদের শিক্ষা,রুচি,জীবনাচারের কাছে এসব দায়-দায়িত্বের কোনো মূল্য নেই, তারাও অনায়াসে স্ত্রী-সন্তান পরিত্যাগ করতে পারে। বাকি রইলো মধ্যবিত্ত। সামাজিক দায় এবং দায়িত্ব যে শ্রেণির সবচেয়ে বেশি। মূল্যবোধ, সংস্কার যে শ্রেণির মানুষকে প্রভাবিত করে, নিয়ন্ত্রিত করে এবং এই প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ সে লালন করে নানা শ্লাঘায় এবং মহিমায়৷ হতে পারে কখনো তার নাম বংশ মর্যাদা,হতে পারে সামাজিক মর্যাদা হতে পারে তার নাম জাতীয় মর্যাদা। যার মূল্য কখনো সে সানন্দে দেয়, কখনো মহত্ত্বে দেয়, কখনো দায়বদ্ধতায় দেয়।

কিন্তু সময় খুব দ্রুত পাল্টাচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে পাল্টাচ্ছে মানুষের জীবনের জটিলতা। যে সংকট ও টানাপোড়েন মাত্র এক প্রজন্ম আগেও মধ্যবিত্ত অস্বীকার করতো সামাজিক কারণে। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষই ব্যক্তিমর্যাদা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে সোচ্চার। নিজের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে সামাজিকতার খাতিরে হার মানতে নারাজ। ফলে মুখ বুঁজে 'লোকে কী বলবে' র মতো ধারণার কাছে পরাজিত হয়ে জীবন বিসর্জন দেওয়া বোকামির সমার্থক। ফলে টান পড়েছে পরিবারপ্রথায়। ভেঙে যাচ্ছে 'বিয়ে' নামক সংস্কারকে যেন-তেনভাবে টিকিয়ে রাখার প্রবণতা।

কিন্তু বৃহত্তর সমাজ, কিংবা রাষ্ট্র কেউ তেমনভাবে তৈরি হয়নি এই বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে। যার নেতিবাচক ফল ভোগ করছে আমাদের ভেঙে যাওয়া পরিবারের শিশুরা। স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে প্রায় সর্বক্ষেত্রে প্রচলিত মূল্যবোধের অসহায় বলি হচ্ছে এই শিশুরা। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বাদ দিলাম, তা বদলানো হয়ত সময়সাপেক্ষ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিমালাও তাদের অনুকূলে নেই।

এই রায় সেদিক থেকে এক বিরাট বৈপ্লবিক রায়। যে রায়ে আমাদের মেয়েরা ফিরে পেয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অধিকার। নিশ্চিত হয়েছে শিশুদের শিক্ষা ও সমতা নির্ধারণ করা অন্যান্য ক্ষেত্র।

এই রায় যত তাড়াতাড়ি কার্যকর হবে ততই সন্তান জন্ম দিয়ে দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করা পুরুষের পরিচয় দেয়ার মতো মর্যাদাহানি থেকে মুক্তি পাবে ভুক্তভোগী নারীরা। নিরাপদ হবে আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ।