কলকাতার ঐতিহ্যবাহী হোটেল
২৫ নভেম্বর ২০১৩গত ১৯ নভেম্বর ছিল প্রয়াত শিল্পোদ্যোগী ললিত সুরির জন্মদিন, আট বছর আগে যিনি অনেক স্বপ্ন নিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া, নানা সমস্যায় জীর্ণ ঐতিহাসিক গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলকে কিনে নিয়েছিলেন৷ এই হোটেলের পুনরুজ্জীবন নিয়ে অনেক ভাবনা ছিল তাঁর৷ হয়ত কাজ শেষ হতে অনেক দেরিই হয়ে গেল, সেটাও এমন একটা সময়ে, যখন ললিত সুরি আর নেই৷ কিন্তু তাঁর সংস্থা ভারত হোটেলস তাঁর স্বপ্নকে হারিয়ে যেতে দেয়নি৷ সাকার হয়েছে দ্য ললিত-গ্রেট ইস্টার্ন৷ সংস্থার বর্তমান কর্নধার, ললিত সুরির স্ত্রী জ্যোস্না সুরি জানালেন, আর তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে ললিত গ্রেট ইস্টার্নের নতুন অংশটির দরজা খুলে যাবে অতিথিদের জন্য৷ তবে এই হোটেলের হেরিটেজ অংশটি, স্থাপত্যরীতির বিচারে যা এলিজাবেথান এবং এডোয়ার্ডিয়ান, এই দুভাগে বিভক্ত, তার সংস্কারের কাজ শেষ হতে আরও অন্তত মাস ছয়েক লাগবে৷
দ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্নের হেরিটেজ অংশটি যতদূর সম্ভব অবিকৃত রাখার চেষ্টা হয়েছে৷ এর সম্মুখভাগ একেবারেই অপরিবর্তিত থাকছে, ঠিক যেমনটা ছিল মূল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের৷ তবে হোটেলের মূল প্রবেশ-প্রস্থানের পথটি সরিয়ে নিয়ে পাশের ওয়াটারলু স্ট্রিটে এখন নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ আধুনিক হোটেলের পক্ষে উপযোগী আরও নানা সংযোজন হয়েছে, যা পুরনো গ্রেট ইস্টার্নে ছিল না৷ কাজেই ঐতিহ্য এবং আধুনিকতা মিলে মিশে রয়েছে এই নতুন হোটেলবাড়িটিতে৷
অবশ্য কেবলমাত্র হোটেল বললে খাটো করে দেখা হয় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বকে৷ ১৭৩ বছর আগে, ১৮৪১ সালে, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী শহর কলকাতায়, এখনকার রাজভবন, সে আমলে লাটসাহেবের বাড়ির উল্টোদিকে ওই রাজকীয় হোটেলের পত্তন করেন ডেভিড উইলসন৷ কলকাতায় এবং ভারতে তো বটেই, সারা এশিয়াতে অমন অতিকায় এবং বিলাসবহুল হোটেল আর ছিল না৷ তখন ভারতের ভাইসরয় বা বড়লাট লর্ড অকল্যান্ডের নামে হোটেলের নামকরণ হয় অকল্যান্ড হোটেল৷ যদিও লোকমুখে সেটা উইলসন হোটেল হিসেবেই পরিচিত ছিল, যে হোটেল ক্রমশ হয়ে উঠেছিল বিত্তবান বাঙালি নব্য যুবকদের বখামির সেরা ঠিকানা৷ তথাকথিত বাবু কালচারে মগ্ন কলকাতায় তখন একটা প্রবাদ চালু হয়ে গিয়েছিল – ‘জাত মারলে তিন সেন৷ কেশব সেন, উইলসেন এবং ইস্টিসেন!' কেশব সেন, যেহেতু তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের প্রবর্তকদের একজন, রেল স্টেশন, যেহেতু সেখানকার ভিড়ে জাতি-বর্ণ-ধর্ম মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় এবং উইলসেন, অর্থাৎ উইলসনের হোটেল, যেখানে সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ খাদ্য-পানীয়ের সঙ্গে সখ্যতা হয়!
অকল্যান্ড হোটেলের নাম বদলে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল হয় ১৯১৫ সালে৷ ১৯৩০ সালে হোটেলের পরিচালনভার শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে পুরোপুরিভাবে চলে আসে এ দেশীয় কর্তাদের হাতে৷ ১৯৭৫ সালে, আইন করে হোটেলের পরিচালনভার নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার, তখন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়৷ ১৯৮০ সালে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আমলে রাজ্য সরকার হোটেলটি সম্পূর্ণত অধিগ্রহণ করে৷ কিন্তু এর পর থেকেই দুরবস্থা শুরু হয় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের৷ বিখ্যাত বেকারিটি প্রথমে বন্ধ হয়ে যায়, তার পর একে একে বন্ধ হয়ে যায় সবকটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ এবং পানশালা৷ কর্মী অসন্তোষ, ট্রেড উইনিয়নের দৌরাত্ম্য এবং পরিষেবার সার্বিক অদক্ষতার পাশাপাশি হোটেল পরিচালনায় চূড়ান্ত ব্যর্থতা কার্যত শেষ করে দেয় গ্রেট ইস্টার্নকে৷
২০০৫ সালে হোটেলটির ৯০ শতাংশ মালিকানা শিল্পপতি ও হোটেল ব্যবসায়ী ললিত সুরির ভারত হোটেলস-কে বিক্রি করে দেয় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার৷ তার পরও হোটেলটি চালু করার পরিকল্পনা ধাক্কা খায় ২০০৬ সালে ললিত সুরির আকস্মিক মৃত্যুতে৷ দীর্ঘ ৮ বছর পর, ২৬০ কোটি টাকা খরচ করে সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ শেষ হতে চলেছে ঐতিহাসিক এই হোটেলের৷ আর দু-তিন সপ্তাহের মধ্যেই দরজা খুলে যাবে দ্য ললিত-গ্রেট ইস্টার্নের৷ কাঁটা-চামচ আর বোন চায়নার টুং টাং, পিয়ানোর সুরেলা আওয়াজ, সুগন্ধি আর ডিজাইনার পোশাকের খসখস শব্দে আবার ভরে উঠবে ১৭৩ বছরের ঐতিহ্য আগলে দাঁড়িয়ে থাকা এই ইমারত৷