1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নকল পায়ে পর্বত জয় অরুণিমার

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১০ জানুয়ারি ২০১৯

ভারতের অরুণিমা সিংহ এভারেস্টের পর এবার আন্টার্কটিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গও জয় করলেন৷ এক পা নিয়ে তাঁর এমন সাফল্য বিস্মিত করেছে সারা বিশ্বকে৷ এর আগে এক পা হারানো কোনো নারী অ্যান্টার্কটিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করতে পারেননি৷

https://p.dw.com/p/3BJ5q
ছবি: Getty Images/AFP

হার না মানা অরুণিমা

উত্তরপ্রদেশের আম্বেদকর নগরের বাসিন্দা অরুণিমা৷ নকল প্রস্থেটিক পা নিয়ে তিনি জয় করেছেন অ্যান্টার্কটিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট ভিনসন৷ তবে এই অসাধ্যসাধন তাঁর প্রথম নয়৷ এর আগে তিনি জয় করেছেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট৷ অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘অরুণিমা অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে আলাদা করে তুলেছেন৷’’

সত্যিই পরিশ্রম ও অধ্যবসায় ছাড়া কারো পক্ষে এই উচ্চতা ছোঁয়া সম্ভব হয় না৷ কিন্তু পর্বতারোহণের এমন স্বপ্ন অরুণিমার প্রথমদিন থেকে ছিল না৷ এই তরুণী ছিলেন জাতীয় স্তরের ভলিবল খেলোয়াড়৷ ৩০ বছরের অরুণিমার জীবন পাল্টে দিয়েছিল একটি দুর্ঘটনা৷ তাঁর সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ নষ্ট করে দিয়েছিল৷ ট্রেনের কামরায় ওঠা দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অরুণিমা দিয়েছেন চরম মূল্য৷ সাত বছর আগের ঘটনা৷ লুঠপাট করতে ট্রেনে উঠেছিল দুষ্কৃতীদের দল৷ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ডাকাবুকো তরুণী৷ ট্রেন থেকে দুষ্কৃতীরা তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়৷ মারাত্মক চোট পান তিনি৷ প্রাণে বাঁচলেও এই ঘটনায় বাঁ পা হারান অরুণিমা৷

কিন্তু পা হারালেও জীবনের ছন্দ হারাতে দেননি৷ বরং নিজের প্রতিবন্ধকতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নয়া লক্ষ্য স্থির করেন অরুণিমা৷ সিদ্ধান্ত নেন, নকল পা নিয়েই পর্বতারোহণ শুরু করবেন৷ প্রস্থেটিক পা নিয়েই তিনি শুরু করেন অভীষ্ট লক্ষ্যে যাত্রা৷ ২০১৩ সালে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন৷ তাঁর ঝুলিতে শুধু এভারেস্ট নয়, মাউন্ট কিলিমাঞ্জেরো, মাউন্ট এব্রাস, মাউন্ট কোসিয়াজকো, মাউন্ট অ্যাকোনকাগুয়া জয়ের কৃতিত্বও রয়েছে৷ এবার মুকুটে নতুন পালক অ্যান্টার্কটিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট ভিনসন৷

স্বপ্ন যখন আকাশছোঁয়া

‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’ জয় করার বাসনা মানুষের অনেককালের৷ এই বাসনায় যুগে যুগে মানুষ অনেক নজির তৈরি করেছে৷ ভারতীয় সাঁতারু মাসুদুর রহমান বৈদ্য প্রথম প্রতিবন্ধী সাঁতারু হিসেবে জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়েছিলেন৷ শৈশবে রেল দুর্ঘটনায় তিনি পা হারান৷ নজির গড়ার পরও প্রতিবন্ধীর তকমা দিয়ে উটকো সহানুভূতি দেখানো হতো তাঁকে৷ তাই একটা কথা তাঁর মুখে প্রায়ই শোনা যেতো, ‘‘আমি প্রতিবন্ধী নই৷ এবার কি এভারেস্ট জয় করলে সেটা প্রমাণ হবে?’’ মাসুদুরের কথাটাই আক্ষরিকভাবে প্রমাণ করেছেন অরুণিমা৷ রেল দুর্ঘটনায় পা হারানোর ট্র্যাজেডি তাঁর জীবনে রয়েছে৷ রেললাইনে পড়ে থেকে সারারাত যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে অরুনিমা দেখেছিলেন, তাঁর কাটা পড়া পায়ে ইঁদুরের দলের সশব্দ উপস্থিতি৷ গড়পরতা মানুষের জীবন এখানেই থেমে যায়৷ কিন্তু, হাসপাতালের শয্যায় শুয়েই তরুণী ঠিক করেছিলেন, তিনি পর্বতারোহী হবেন৷ আরো কঠিন, দুঃসাধ্য লক্ষ্য অর্জনে নামবেন৷ এরপর পরিকল্পনা মতো প্রশিক্ষণ নিয়েছেন৷ ছুটে গিয়েছেন এভারেস্টজয়ী বাচেন্দ্রী পালের কাছে৷ এই লড়াইয়ের কাহিনি মনে করিয়ে দেয় কৃতী নৃত্যশিল্পী, তথা অভিনেত্রী সুধা চন্দ্রনের কথা৷ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যা-ই থাক, মনের জোর ও অধ্যবসায়ে যে পায়ের অভাবও পুষিয়ে দেওয়া যায়, তা প্রমাণ করেছিলেন সুধা৷ অরুণিমা তাঁরই উত্তরসূরি৷

‘অসম্ভব মানসিক জোর না থাকলে এই কাজ করা যায় না’

কঠিন লক্ষ্যপূরণ

এই তরুণীর সাফল্যে অদম্য ইচ্ছাশক্তিই মূলধন, এমনটাই মনে করেন এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী বসন্ত সিংহরায়৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অসম্ভব মানসিক জোর না থাকলে এই কাজ করা যায় না৷ এভারেস্ট জয়ের পরেও তিনি থেমে থাকেননি৷ একজন বিশেষভাবে সক্ষম মানুষের পক্ষে এটা খুবই কঠিন৷ তবে অ্যান্টার্কটিকার চেয়েও এভারেস্ট জয়ই তাঁর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল৷ তার কারণ, এভারেস্টের ওই বিশাল উচ্চতা আর প্রতি মুহূর্তে অক্সিজেনের অভাব৷’’

‘পর্বতারোহীদের প্রায়ই অক্সিজেন ঘাটতির মুখোমুখি হতে হয়’

কতটা কঠিন ছিল অরুণিমার লক্ষ্য অর্জন? সাধারণভাবে অ্যান্টার্কটিকায় কী ধরনের সমস্যা হতে পারে? শ্বাসযন্ত্র ও বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, ‘‘অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা যেহেতু অনেকটাই কম, ফুসফুস সরাসরি ঠান্ডা বায়ুর সংস্পর্শে আসে৷ ফলে ফুসফুসের রক্তবাহী ক্যাপিলারিগুলি সংকুচিত হয়৷ অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়৷’’ তাঁর মতে, ক্রমশ বেশি উচ্চতায় পৌঁছতে থাকলে পর্বতারোহীদের প্রায়ই অক্সিজেন ঘাটতির মুখোমুখি হতে হয়৷ পাশাপাশি আরো যেসব সমস্যার মুখে পড়তে হয় সেগুলির মধ্যে ‘হাই অলটিচিউড পালমোনারি ইডিমা’ অন্যতম৷ একজন বিশেষভাবে সক্ষম মানুষের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরো বড় হয়ে দেখা দেয় বৈকি৷

কৃত্রিম পায়ে এভারেস্টে

এগিয়ে চলার মন্ত্র

অ্যান্টার্কটিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের পরও থেমে নেই অরুণিমা৷ এগোচ্ছেন নতুন লক্ষ্যে৷ মঙ্গলবার যখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, তখন তিনি ছিলেন অ্যান্টার্কটিকার বেস ক্যাম্প চিলির পান্টা এরিনায়৷ কেমন আছেন জানতে চাইলে হোয়াটসঅ্যাপে তিনি  লেখেন, ‘‘মোটের উপর ভালো আছি৷ ছোটখাট শারীরিক সমস্যা রয়েছে৷ ফ্রস্টবাইট না হলেও বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলে ব্যথা রয়েছে৷ ডান হাঁটুতেও ব্যথা৷ মুখের চামড়ায় পোড়া দাগ হয়েছে৷’’ অরুণিমা জানান, তাঁর সাফল্যে দেশবাসীর প্রশংসায় তিনি আপ্লুত৷ ভবিষ্যতেও নতুন নজির গড়ার লক্ষ্যে অবিচল থাকবেন৷ সকলকে বলবেন, কিছুতেই হার মানা যাবে না৷ এগিয়ে যেতে হবে৷ ইমেলে পর্বতারোহী লিখেছেন, ‘‘মাউন্ট ভিনসন জয় উপলক্ষ্যে ১৩ জানুয়ারি ফরিদাবাদে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে৷ সেখানে তাঁর মঙ্গল কামনায় সোয়া লক্ষবার মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করা হবে৷ যজ্ঞে শামিল হবেন শুভানুধ্যায়ীরা৷’’