1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ধর্ষণের পরেও এত অপমান!

গৌতম হোড়
১ অক্টোবর ২০২০

উত্তর প্রদেশে পরপর দুই দলিত মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো দেশকে। পুলিশের আচরণ এবং বিক্ষোভ আটকানোর চেষ্টা নিয়ে শুরু হয়েছে প্রবল বিতর্ক।

https://p.dw.com/p/3jGoX
ছবি: picture alliance/NurPhoto/S. Pal Chaudhury

উত্তর প্রদেশে হত্যা, পুলিশের এনকাউন্টার এখন গা সওয়া ঘটনা। দিল্লি ঘেঁষা নয়ডা ও গাজিয়াবাদ থেকে শুরু করে রাজ্যের প্রায় সর্বত্র একের পর এক হত্যা হচ্ছে। সাংবাদিককে গুলি করা হচ্ছে। মারা যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাই বলে প্রায় প্রতিদিন দিনেদুপুরে ধর্ষণ? তাও জাতের নামে? দলিত মেয়েদের উপর অসহনীয় অত্যাচার?

মাঠে ঘাস কাটতে গেলে ধর্যণ, কলেজে ভর্তির ফর্ম জমা দিতে যাওয়ার পথে ধর্ষণ। এ কোন সময়ে বাস করছি আমরা? আর তারপর সেই ধর্ষিতার মৃতদেহ পরিবারের কাছে না দিয়ে মাঝরাতে পুড়িয়ে ফেলে পুলিশ! এমন অমর্যাদাকর ঘটনার পরেও কারো শাস্তি হবে না?

হাথরাসে মা, বোন, ভাইয়ের সঙ্গে মাঠে ঘাস কাটছিল উনিশ বছরের দলিত মেয়েটি। তাঁকে ধরে ওড়না দিয়ে মুখ বেঁধে পাশের বজরা ক্ষেতে নিয়ে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে। বলরামপুরে কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য বেরিয়েছিল এক দলিত ছাত্রী। তাঁকে অপহরণ করে, অজ্ঞান করে, ধর্ষণ ও অত্যাচার করা হয়। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ধর্ষকরা একটি টোটোতে করে মেয়েটিকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। ধর্ষিতার পায়ের হাড় ভাঙা, কোমরের হাড় ভাঙা। মায়ের কাছে তাঁর একটাই আবেদন ছিল, ''মা আমি বাঁচতে চাই।'' বাঁচতে পারেনি সে। বলরামপুর থেকে লখনউয়ে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যান ওই দলিত তরুণী।

তা হলে কি অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, কলেজে ভর্তি হতে গেলেও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হতে হবে মেয়েদের? নিজের বাড়ির কাছে ঘাস কাটতে গিয়ে ধর্ষিতা হতে হবে? হাথরাসের ধর্ষিতার জিভ কেটে দেয়া হয়েছিল। ধর্ষণের পর তাঁকে এমন অত্যাচার করা হয়েছিল যে দুই সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেও হেরে গেলেন তিনি। একই অবস্থা বলরামপুরের মেয়েটিরও।

হাথরাসের দলিত মেয়েটিকে বেঁচে থাকা অবস্থায় ধর্ষণ করে তাঁর চরম মর্যাদাহানি করল চারজন উচ্চবর্ণের লোক। আর মরার পরে পুলিশ সামান্য মর্যাদাটুকু দিল না। রাতে পুলিশ তাঁর দেহ নিয়ে গেল গ্রামে। কিন্তু দেহ তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে দিল না। তাঁর অন্ত্যেষ্টি বাড়ির লোক করতে পারলেন না। রাত দুটোর সময় পরিবারের লোকেদের তালাবন্ধ করে রেখে পুলিশই মেয়েটির শেষকৃত্য করে। কেন? এর কোনো জবাব পরিবারের কাছে নেই।

পুলিশ যখন এই রকম আচরণ করে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই একটি প্রশ্ন ওঠে। পুলিশ কি কিছু লুকোতে চাইছে? কী লুকোতে চাইছিল পুলিশ, যার জন্য এরকম অমানবিক কাজ করা হলো? মৃত্যুর পরও অন্ত্যেষ্টির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো পরিবারকে? কেন মেয়েটির এরকম অমর্যাদা করা হলো? কোনো যুক্তিগ্রাহ্য জবাব নেই। বরং বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। 

অন্য সময় বিরোধীরা সোচ্চার হলে রাজনীতি করার অভিযোগ তুলে বিজেপি তাদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করে। এই বার প্রতিবাদ বিজেপি-র অন্দর থেকেও এসেছে। দিল্লির বিজেপি সাংসদ হংস রাজ হংস চিঠি লিখে বসেছেন যোগী আদিত্যনাথকে। সেখানে তিনি বলেছেন, পুলিশ অফিসার ও কর্মীদের কাছ থেকে আগে জবাবদিহি চাওয়া হোক, কেন তাঁরা এই অমানবিক কাজ করল? তদন্ত হোক। তদন্তে তারা দোষী প্রমাণিত হলে কঠোরতম ব্যবস্থা নেয়া হোক। হংস রাজ হংস নিজেও দলিত। তাই দলিত মেয়ের এই নিদারুণ অসম্মান তিনি মুখ বুজে মেনে নিতে পারেননি।

কিন্তু তিনি যা বলেননি, তা টিভি চ্যানেলে ও সামাজিক মাধ্যমের ভিডিওতে পরিষ্কার। পুলিশ পরিবারকে যেতে দেয়নি অন্ত্যেষ্টিতে। নিজেরাই সেই কাজ করেছে। কার নির্দেশে সেই কাজ হয়েছে? কোন বিষয়টা গোপন করতে চেয়েছিল পুলিশ ও প্রশাসন? কেন একজন পুলিশ কর্মী বা জেলার প্রশাসনিক  প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো না?  ধর্ষিতা, অত্যাচারিতা নারীকে এবং একজন দলিতের বিরুদ্ধে এমন অন্যায় করার অধিকার কে পুলিশকে দিলো? প্রশ্ন তো আরো উঠছে, এরপরও মুখ্যমন্ত্রী শুধু বিশেষ তদন্তকারী দল বা এসআইটি গঠন করে চুপ করে বসে আছেন কেন? পুলিশ ও প্রশাসন কি যা খুশি তাই করতে পারে, তাঁদের জবাবদিহি করতে হয় না? নাকি উত্তর প্রদেশে এখন তারাই সর্বশক্তিমান? আর পুলিশের বিরুদ্ধে, প্রশাসনের কর্তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ?

অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, এই ধরনের সময় শুধু কালক্ষেপ করা হয়। অন্তত এই উপমহাদেশের পুলিশ ও প্রশাসন জানে, সমস্যায় পড়লেই কালক্ষেপ করতে হবে। সময় মানুষকে সব ভুলিয়ে দেয়। প্রতিবাদের স্পৃহা কমে যায়। তার আগে যে টুকু প্রতিবাদ হচ্ছে, সেটাকেও বন্ধ করে দিতে হবে।

Goutam Hore
ছবি: privat

হাথরাসের ওই গ্রাম বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সিল করে দেয়া হয়েছে। এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সিল করে দেয়া হয়েছে দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের সীমানা। কেন? প্রশাসনের জবাব, করোনার জন্য এই পদক্ষেপ। এটা নতুন কিছু নয়। ১ সেপ্টেম্বর থেকেই চালু আছে। সেটাকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হলো। প্রচুর পুলিশ না কি করোনায় মারা গেছেন। এখন তো আনলকপর্ব চলছে। সব খোলা। সেখানে করোনা হলো পুলিশ ও প্রশাসনের ঢাল।

কংগ্রেসের দাবি, যেই রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা গান্ধী হাথরাসে গিয়ে দলিত পরিবারের সঙ্গে দেখা করার কথা বললেন, অমনি সব বন্ধ করে দেয়া হলো। রাহুল ও প্রিয়ঙ্কাকে হাথরাসে যেতে দেয়া হয়নি। আটকে দেয়া হয় গ্রেটার নয়ডাতে। তারপর তাঁরা হাঁটতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত রাহুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। লাঠি মারাও হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ। 

শুধু রাহুল নন। দলিত নেতা ও ভিম আর্মির প্রধান চন্দ্রশেখরকেও ঘরবন্দি করেছে উত্তর প্রদেশের পুলিশ। চন্দ্রশেখর ওই দলিত মেয়ের পরিবারের সঙ্গে হাথরাস যাচ্ছিলেন। মাঝপথেই পুলিশ তাঁকে আটকে দেয়। এখন সাহরানপুরে তাঁকে ঘরবন্দি করা হয়েছে। সমাজবাদী পার্টির কর্মীদেরও হাথরাসে ঢুকতে দেয়া হয়নি। অর্থাৎ প্রতিবাদও করতে দেয়া হচ্ছে না।

প্রতিবাদ হলো গণতন্ত্রের অভিন্ন অঙ্গ। এত বড় একটা ঘটনা ঘটবে, তার কোনো প্রতিবাদ হবে না? ওই পরিবারের কাছে কাউকে যেতে দেয়া হবে না? বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছিল, যোগী আদিত্যনাথের উত্তর প্রদেশে পুলিশ সর্বশক্তিমান। এখন দেখা যাচ্ছে সত্যিই তাই।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, যতই সবকিছু বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে, ততই বিতর্ক বাড়ছে। আর সেই সঙ্গে বাড়ছে বিজেপির আশঙ্কা। সামনে বিহারের ভোট। দলিত ভোট না পেলে সরকার গঠন করা মুশকিল হবে। হাথরাস, বলরামপুরের ঘটনার পর বিতর্ক যে জায়গায় যাচ্ছে, তাতে বিহারের দলিতরা যদি মুখ ফিরিয়ে নেন? রাজনীতির সবটাই তো ভোট নির্ভর। এই ভয়ই কি উত্তর প্রদেশের দুই ধর্ষিতা দলিত মেয়েকে ন্যায় দেবে? অন্তত মৃত্যুর পর?