1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ধর্ষকদের রক্ষা করলে পুলিশের কেন শাস্তি হবে না

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
৯ অক্টোবর ২০২০

ধর্ষণ থামছে না। কড়া আইন সত্ত্বেও না। ফাঁসির ভয়ও থামাতে পারছে না ধর্ষণ। বরং ধর্ষণের পর অত্যাচার করে হত্যার ঘটনা বাড়ছে।

https://p.dw.com/p/3jg6N
hra)
ছবি: picture-alliance/Zuma/Masrat Zahra

নির্ভয়াকাণ্ডের পর ভারতে যখন আইন বদল করে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি করা হলো, তখন কংগ্রেস, বিজেপি থেকে শুরু করে সব চেয়ে ছোট দলের সাংসদও দাবি করেছিলেন, এর ফলে ধর্ষণ কমবে। এর ফলে ধর্ষকদের মনে ভয় ঢুকে যাবে। তারা ভয়ের চোটে আর ধর্ষণের দিকে যাবে না। এই আইন প্রতিরোধকের কাজ করবে।

সেই আইন চালু হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর। তারপরও ধর্ষণ কমা দূরস্থান, বেড়েই যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে ধর্ষকদের সাহস, বেড়ে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা, বেড়ে যাচ্ছে ধর্ষণ করার পর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, বেড়ে যাচ্ছে ধর্ষকদের বাঁচাতে পুলিশের প্রাণান্তকর প্রয়াস, প্রশাসনের নির্লজ্জতা।

আইন বদল করে ধর্ষকদের চরম শান্তি ফাঁসি করা হয়েছে। সেই মতো নির্ভয়ার ধর্ষকদের তিহার জেলে ফাঁসিও হয়ে গেছে। সম্প্রতি রাজস্থানের আদালত ধর্ষকদের সারা জীবনের জন্য কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে। তাই ধর্ষকদের কড়া শাস্তি যে হচ্ছে না তা নয়। তা সত্ত্বেও কী করে বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা?

কী করে ব্যাখ্যা দেয়া যাবে হাথরাসে চার বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনার? তাঁর মাসতুতো ভাই মেয়েটিকে ধর্ষণ ও অত্যাচার করেছে। আর মাসী তাতে মদত দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে পুলিশ। সেই অত্যাচারিত শিশু মারা গেছে। তার মাসুতুতো দাদা ও মাসী তো কড়া আইনের কথা জানত। এও জানত, এই অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না। তা সত্ত্বেও ওই ঘটনা ঘটল।

হাথরাসের দলিত নারীকে ধর্ষণ করার ঘটনা, যা এখন নাড়িয়ে দিয়েছে ভারতকে, তার কথাই ধরুন। আশেপাশে মা, বোন আছে। তবুও চার অকুতোভয় ধর্ষক ঘাস কাটতে আসা সেই নারীকে ধরে পাশের বজরা ক্ষেতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করল। মেয়েটি যাতে চিৎকার করতে না পারে, তার জন্য জিভ কেটে দিল। তাদের অত্যাচারে মেয়েটির কোমর ভেঙে গেল। এই সব ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে 'পাশবিক' নামক ক্লিশে হয়ে যাওয়া বিশেষণটা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোন পশু এই ধরনের আচরণ করে বলুন তো? কেউ করে না। মানুষ নামক বুদ্ধিমান প্রজাতির বিকৃতমনস্ক, কামোন্মাদ কিছু লোক দিনের পর দিন এই কাজ করে যাচ্ছে। আর এই অপরাধীদের সাফাই গাওয়ার জন্য পুরুষতান্ত্রিকতার পুরোধারা সবসময় মেয়েদের দিকে আঙুল তুলে বলে, মেয়েরা কম পোশাক পরে, একাধিক বন্ধুদের সঙ্গে মেশে বলে এরকম হচ্ছে। এককথায় বলে দেয়া হয়, তাঁর চরিত্র খারাপ। সে জন্যই কিছু কামোন্মাদের ধর্ষণ করার অধিকার জন্মায়? সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ, তেমনই বিচিত্র এই যুক্তি।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতপাত। এমনিতেই অনেক পুরুষের মনের ভিতরের বিশ্বাস, মেয়েরা হলো ভোগ্যপণ্য। তার উপর দলিত মেয়ে হলে, আদিবাসী মেয়ে হলে, দুর্বলতর শ্রেণির মেয়ে হলে তো কথাই নেই। তাঁদের ধরে যা খুশি তাই করা যায়। তাই উত্তর প্রদেশে একের পর এক দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করে মারা হয়, আর পুলিশ যুক্তি দেয়, রাজ্যের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা হচ্ছে। তবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, শুধু বিজেপি শাসিত রাজ্যে পুলিশ এই ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাইছে। কংগ্রেস শাসিত বা অন্য বিরোধী শাসিত রাজ্যে পুলিশ একেবারে আইন মেনে ব্যবস্থা নিচ্ছে। কংগ্রেস শাসিত ছত্তিশগড়ে ধর্ষিতা মেয়েটি আত্মহত্যা করল। তারপর দুই মাসের বেশি সময় কেটে গেল। পরিবার পুলিশের কাছে গিয়ে সব আশা হারাতে বসল। তারপর ধর্ষিতার বাবা যখন আত্মহত্যা করতে গেলেন, তা নিয়ে মিডিয়ায় হইচই শুরু হলো, তখন চাপে পড়ে পুলিশ ব্যবস্থা নিল। এতদিন কেন পুলিশ নড়েচড়ে বসেনি। এরপর কেন রাহুল ও সনিয়া সেই পরিবারের কাছে গেলেন না?

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

আসলে পুলিশের শাস্তি হয় না। প্রশাসনে যারা আছেন, তাঁদের শাস্তি হয় না। খুব বেশি হলে কিছুদিন সাসপেন্ড হয়ে থাকতে হয়। তারপরেই আবার বহাল তবিয়তে তাঁরা চাকরি করেন। ফলে তাঁরা জানেন, তাঁরা যা খুশি করুন না কেন, তাঁদের চাকরি যাবে না। জেলে যেতে হবে না। আইন বদল করে ধর্ষকদের শাস্তি ফাঁসি করা হয়েছে, সারা জীবনের জন্য কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু যে পুলিশ ও প্রশাসনের ব্যক্তিরা ওই ধর্ষকদের বাঁচাবার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন, ধর্ষিতার পরিবারকে গিয়ে প্রতিদিন শাসানি দিয়ে বললেন, এ সব মিডিয়া দুই দিনের জন্য আছে, আমরা চিরকাল থাকব। আমাদের কথা শোন। যাঁরা ধর্ষকদের দিনের পর দিন ধরবেন না। ধরলেও এমনভাবে মামলা সাজানো হবে, যাতে তা লঘু হয়ে যায়, তাঁদের কেন ফাঁসি হবে না? কেন তাঁরা সারাজীবনের জন্য জেলে বন্দি থাকবেন না? যতদিন পুলিশ ও প্রশাসনের মনে শাস্তির ভয় থাকবে না, ততদিন তারা এভাবেই কাজ করে যাবেন। কখনো রাজনৈতিক প্রভুদের খুশি করতে, কখনো টনিক এমের প্রভাবে, কখনো বা জাতপাতের অদৃশ্য শক্তির বশবর্তী হয়ে।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটা গল্পে ছিল, পুলিশ একজনের বাড়ি ঘিরে ধরে সার্চ করতে ঢুকেছে। বাড়ির ঠাকুমা বা সমগোত্রীয় কেউ চেঁচাচ্ছেন, ওরে ডাকাত পড়েছে, পুলিশে খবর দে। একজন ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলল, আরে পুলিশ ঢুকেছে। অদম্য ঠাকুমা তখন চেঁচাতে থাকলেন, ওরে পুলিশ পড়েছে, ডাকাতদের খবর দে। এখন প্রায় সেই অবস্থাই হয়েছে। তাই ধর্ষকদের কড়া শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু সেই বিধান কার্যকর করার পথে যাদের অন্যতম ভূমিকা তারা যদি কাজ না করে, সবকিছু উল্টে দেয়, তা হলে তাদের শাস্তির বিধান থাকবে না কেন? ধর্ষণের ঘটনাগুলি হওয়ার পর মিডিয়া রিপোর্ট করে পাঁচজনকে ধরা হয়েছে। কিন্তু তাদের শেষ পর্যন্ত শাস্তি হলো কি না, সেই খবর আর জানা যায় না।  যদি না তা নির্ভয়ার মতো মামলা হয়।

সেই সঙ্গে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে তাদের জন্য, যারা নারীদের প্রতি সমানে অপমানসূচক মন্তব্য করে। খোলাখুলি। সামাজিক মাধ্যমে। খবরের কাগজে। হাথরাসের পর বিজেপির বিধায়ক বলেছেন, ''আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে ধর্ষণের সমস্যার সমাধান হবে না। ধর্ষণ বন্ধ হবে তখনই, যখন বাবা-মা মেয়েদের মূল্যবোধের শিক্ষা দেবেন। তাঁরা উপযুক্ত পোশাক পরবেন।'' যেন ছেলে ধর্ষকদের ধর্ষণের অধিকার আছে। 

একবারের জন্যও ভাববেন না, এই ভাবনা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের। বরং অনেকের মনেই এই ভাবনার ঘোরাফেরা। হাথরাসে উচ্চবর্ণের লোকেরা এক নেতার বাড়িতে জমায়েত হয়ে দাবি করেছে, দলিত পরিবারকে মিথ্যা অভিযোগের জন্য শাস্তি দিতে হবে। চোরের মায়ের বড় গলা। কোনো ক্ষেত্রেই তো কোনো ভয় নেই। যে যা খুশি বলতে পারেন, করতে পারেন। ফলে এই মাৎস্যন্যায়ের অবস্থায় ধর্ষকরাই বা ভয় পাবে কেন?