দেবব্রত বিশ্বাসের সেই বাড়ি এখন কেতাদুরস্ত ক্যাফে
১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের একতলার ঘরটি ছিল প্রবাদপ্রতিম শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের সংগীতের সাম্রাজ্য৷ এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন কলিম শরাফি৷ সেই বাড়ি এখন মাড ক্যাফে৷ দেখুন ছবিঘরে..
সেই অমোঘ ব্যারিটোনের তার ছেঁড়েনি কখনো
কলকাতার ট্র্যাঙ্গুলার পার্ক লাগোয়া এই বাড়িতে চার দশক আগে থাকতেন জর্জ বিশ্বাস৷ সরু গলি পেরিয়ে ছিল কাঠের দরজা৷ ভিতর থেকে ভেসে আসত ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ কিংবা ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায়’৷ সেখানেই একটি ক্যাফে হয়েছে ২০১৪ সালে৷ ক্যাফেতে সারাক্ষণই বাজে দেবব্রত বিশ্বাসের গান৷ পালিত হয় জন্মদিন ও প্রয়াণের দিবসও৷ সেই দুই দিনে বিনামূল্যে দেয়া হয় কফি-স্ন্যাকস৷
একলা ঘরের শিল্পী
ঘরের ভিতর ঢুকলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোপধরা পিকদান, অগোছালো বিছানায় ডাঁই করে রাখা গানের খাতা, ক্যাসেট, হটব্যাগ, মার্ফি রেডিও, ছোট্ট টিভি, ইনহেলার, হারমোনিয়াম, চিঠির ফাইল, পানের বাক্স, জাঁতি, দিলীপের জর্দা চোখে পড়তো৷ এখন অগোছালো সেই ঘরই ঝকঝকে, কেতাদুরস্ত ক্যাফে৷
তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী
একতলার এই ঘরে ভিড় জমাতেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী-সহ গণনাট্য আন্দোলনের অনেক যোদ্ধা৷ এসেছেন ঋত্বিক ঘটক, উত্তমকুমার, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ৷ জীবনের শেষের দিকে এই ভাড়াবাড়ি থেকে উঠে যাওয়ার তাগাদাও দেওয়া হয়েছিল জর্জ দা-কে৷
শিক্ষক দেবব্রত
এই বাড়িতে জর্জদার কাছে গান শিখতে আসতেন অর্ঘ্য সেন, গীতা ঘটক, শ্রীলা সেন, আরতি মুখোপাধ্যায়, সুব্রতা দাশগুপ্ত, পূরবী মুখোপাধ্যায়রা৷ রাত হয়ে গেলে ছাত্রীদের মোটরবাইকে বসিয়ে পৌঁছে দিতেন বাড়ি৷ আজ এই ক্যাফেতে গানের গুঞ্জনের সঙ্গে নির্বাক দাঁড়িয়ে সেই লাল সিঁড়ি, যা জর্জ বিশ্বাস ব্যবহার করতেন৷
সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরই অপমান
উচ্চারণ আর নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে কোনো আপস করেননি তিনি৷ ১৯৩৮ সালে তাঁর প্রথম রেকর্ড ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরই অপমান’ বেরোয়৷কিন্তু ১৯৬৪ সাল থেকেই তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ন, সংগীত আয়োজন ইত্যাদি নিয়ে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়৷ আত্মজীবনী ‘ব্রাত্য জনের রুদ্ধ সংগীত’-এ জর্জদা সবিস্তারে লিখেছেন সেই সময়ের কথা৷
বাংলাদেশে নাড়ির টান
কিশোরগঞ্জের জর্জ দেশভাগে ব্যথিত হয়েছেন৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের হৃদয়ে৷ তাঁর এই ছোট্ট ভাড়াবাড়িতে গোপনে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কলিম শরাফি৷ সাতদিন এই বাড়ির খাটের তলায় লুকিয়ে ছিলেন কলিম৷
মোর ভুলিবার সাধনায়
শুধু রবীন্দ্রসংগীত নয়, পাশাপাশি তিনি গণসংগীত ও অন্যান্য গানও গেয়েছেন৷ তাঁর আত্মজীবনী ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত থেকে জানা যায়, নজরুল নিজের দুটি গান তাঁকে শিখিয়ে সেগুলি রেকর্ডও করিয়েছিলেন৷ দেবব্রতর ঘরের কাঠের তাকে থাকতো স্বরবিতান৷ কাউকে হাত দিতে দিতেন না৷ আজ ক্যাফের তাকে শুধুই তাঁর স্মৃতি৷
ইতিহাসের পুনরুদ্ধার
ব্যাংকে বন্ধক ছিল বাড়িটি, আর ছাড়ানো যায়নি৷ দুই দশক আগে বাড়িটি বিক্রি করে দেয় ব্যাংক৷ এরপর সেটি কেনেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অর্ণব মিত্র৷ একখানা ইলেকট্রিক বিলে তিনি পেলেন দেবব্রত বিশ্বাসের নাম৷ তখনই তিনি ঠিক করলেন, স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি ভাঙা যাবে না৷ তাঁর ভাবনাতেই গড়ে উঠলো মাড ক্যাফে৷
পিছু ডাকে ভোরের আলোয়
জর্জের শরীরও ভাঙতে শুরু করে দিয়েছে তখন৷ দৃষ্টিশক্তি কমে গিয়েছে৷ বারবার ইনহেলার ব্যবহার করে আরাম মিলতো৷ চিকিৎসকের পরামর্শে ঘরের ভিতরে জানালার জাল কেটে ফেলা হল৷ সারাক্ষণ ইজিচেয়ারে শুয়ে কাটাতেন তিনি৷ সামনে টুলের উপর রাখা থাকতো হারমোনিয়াম৷ আজও সেই জানলা অক্ষত, ইজিচেয়ার রয়ে গিয়েছে স্মৃতিতে৷
ভরা থাক স্মৃতিসুধায়
পঙ্কজকুমার মল্লিক বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসংগীতে অন্য এক তরঙ্গ বইয়ে দিলেও দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতে মূর্ত হলো বাণীর মহিমা৷ ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে তাঁর গান কোনো বাঙালি কি ভুলতে পারবেন কখনো? বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরীর রেখায় এই ক্যাফেতে প্রাণ পেয়েছে তার প্রাণবন্ত প্রতিকৃতি৷
ম্যাড ক্যাফেতে যা পাবেন
জর্জদার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি আজ ক্যাফে৷ কর্তৃপক্ষ যুগলদের জন্য বিশেষ আয়োজন করেছিলেন প্রণয় পক্ষে৷ মাড ক্যাফেয় চিংড়ির খিচুড়ি থেকে কড়াইশুঁটির কচুরির মতো বাঙালি পদ পাওয়া যায় সারা বছর৷ আর বিপন্ন সময়ে একমাত্র আশ্রয় জর্জদার গান তো রইলোই ক্যাফেজুড়ে৷