1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অনিশ্চিত পথে দুই শিশু

৩০ এপ্রিল ২০১৪

আরো ৬১ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে মাছ ধরার নৌকায় চেপে ১৫ বছর বয়সি মুহাম্মদ হুসেইন আর তার ৯ বছর বয়সি বোন সেনোয়ারা বেগম যখন অজানার উদ্দেশ্যে রওনা হলো – তারা কল্পনাও করতে পারেনি, কি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হবে৷

https://p.dw.com/p/1Bqj2
ছবি: Reuters

প্রায় দুই বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মুসলমানদের গ্রামে বৌদ্ধদের হামলার সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এই দুই রোহিঙ্গা শিশু৷ হামলাকারীরা পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার পর দীর্ঘদিন খুঁজেও বাবা-মায়ের সন্ধান না পেয়ে তাঁদের জীবিত দেখার আশা ছেড়ে দেয় হুসেইন আর সেনোয়ারা৷ মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় সাগরপথে দেশ ত্যাগ করা হাজার হাজার শিশুর মতো তারাও উঠে পড়ে নৌকায়৷

সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করা মিয়ানমার সরকার সংখ্যালঘু ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে বলছে ‘অবৈধ অভিবাসী', যদিও তাঁরা রাখাইন রাজ্যে রয়েছে কয়েক প্রজন্ম ধরে৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের হামলায় গত তিন বছরে অন্তত ২৮০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন, দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ৷

মালয়েশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া – সবাই এখন এমন আইন-কানুন করেছে, যাতে এই রোহিঙ্গারা সাগরে ভেসে ভেসে কোনোভাবেই তাঁদের দেশে আশ্রয় নিতে না পারে৷ জাতিসংঘের আহ্বানের পরও আশেপাশের কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসাবে জায়গা দিতে রাজি হয়নি৷বেসরকারি সংস্থা আরাকান প্রোজেক্টের তথ্য অনুযায়ী, দেশ ত্যাগে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে যাঁরা সাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত দুই হাজার লোকের হয় সলিল সমাধি হয়েছে, নয়ত তাঁরা নিখোঁজ৷

Myanmar Zyklon Mahasen Golf von Bengalen 15.05.2013 OVERLAY GEEIGNET
সবাই এখন এমন আইন-কানুন করেছে, যাতে রোহিঙ্গারা সাগরে ভেসে ভেসে তাঁদের দেশে আশ্রয় নিতে না পারেছবি: Soe Than Win/AFP/Getty Images

এমনই এক অভিযাত্রায় হুসেইন ও সেনোয়ারাকে আশ্রয়ের খোঁজে সাগরে ভেসে ভেসে ঘুরতে হয়েছে মিয়ানমার থেকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড৷ তাদের সঙ্গী হয়েছে ক্ষুধা, নির্যাতন আর আতঙ্ক৷ তাদের নৌকার ৬৩ জন আরোহীর মধ্যে ১০ জন ছিলেন নারী আর ১৪ জন শিশু৷ সাগরের বুকে প্রখর রোদে তাঁদের দিনের পর দিন পুড়তে হয়েছে৷ প্রবল ঢেউয়ের দুলুনিতে গলা দিয়ে উঠে এসেছে বমি৷ যাত্রা শুরুর সপ্তাহখানেক পর মিয়ানমারের নৌ-বাহিনীর একটি টহল বোটের নজরে পড়ে যায় রোহিঙ্গাদের বহনকারী নৌকাটি৷ লাথি-ঘুষির সঙ্গে কাঠের তক্তা আর লোহার রড দিয়ে পেটানো হয় পুরুষ আরোহীদের৷ হুসেইনের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে কনুইয়ে ধরা হয় জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি৷

এই নির্যাতন আর সৈন্যদের অট্টহাসি বন্ধ হয় কেউ একজন তাঁদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেয়ার পর৷ নৌকাটি ছেড়ে দেয়া হয়৷ মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের নৌ-বাহিনী ওইরকম কোনো নৌকা আটকায়নি৷আবার যাত্রা শুরু হলেও নৌকার ফুটো দিয়ে আসা পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেনোয়ারার সঙ্গে থাকা যৎসামান্য চাল আর রুটি৷ নৌকা যখন থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছায়, তখনো তারা জানে না, কোথায় তারা এসেছে, কি ঘটতে যাচ্ছে তাদের ভাগ্যে৷

কয়েক বছর আগেও সাগরপথে থাইল্যান্ডে আসা অবৈধ অভিবাসীদের খাবার-পানি-জ্বালানি ছাড়াই সাগরে ফেরত পাঠানো হতো বলে অভিযোগ রয়েছে৷ এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর আগে তাঁদের ন্যূনতম খাবার-পানি দেয়া শুরু করে থাই কর্তৃপক্ষ৷

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, থাই উপকূলে আটক করার পর এই শরণার্থীদের এমন জায়গায় ছেড়ে দেয়া হয়, যাতে তাঁরা মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে৷ যাঁদের কাছ থেকে পাচারকারীরা কোনো অর্থ আদায় করতে পারে না, তাঁদের বিক্রি করে দেয়া হয় মাছের ট্রলারের ‘দাস' হিসাবে৷

থাইল্যান্ড উপকূলে নৌকার অন্য আরোহীদের সঙ্গে হুসেইন আর সেনোয়ারাকেও ভাত আর শুঁটকি মাছ খেতে দেয়া হয়৷ এরপর তুলে দেয়া হয় ইঞ্জিনবিহীন আরেকটি ছোট নৌকায়৷ থাই নৌ-বাহিনীর বোটের পেছনে বেঁধে সেই নৌকাটি টেনে নেয়া হয় গভীর সমুদ্রে৷ তারপর খাবার বা পানি ছাড়াই তাঁদের সেখানে ছেড়ে আসা হয়৷

প্রচণ্ড তৃষ্ণায় সাগরের পানি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে সেনোয়ারা৷ পরদিন তাদের দেখা পায় ইন্দোনেশিয়ার একটি মাছ ধরার নৌকা৷ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সহানুভূতি দেখালেও তাদের সরকারও মিয়ানমারের শরণার্থীদের জন্য দরজা উন্মুক্ত করেনি৷ কেবল অন্য কোথাও সরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁদের ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থান করার সুযোগ দেয়া হয়৷

ইন্দোনেশিয়ার অভিবাসন কর্মকর্তা ইয়ান ভেলি বলেন, ‘‘জাতীয় স্বার্থেই এ ব্যবস্থা৷ না হলে অভিবাসীদের স্রোত আমরা সামাল দিতে পারব না৷'' জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ সালে ইন্দোনেশিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৩৯ জন৷ গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৯৫ জনে৷ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছানোর পর সে দেশের সরকার ও জাতিসংঘের মাধ্যমে কোনো আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই পেতে অনেক সময় বছর পেরিয়ে যায়৷ এ কারণে অনেকেই আগে আদম পাচারকারীদের টাকা দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার কোনো দ্বীপে পৌঁছানোর চেষ্টা করতেন৷ অস্ট্রেলিয়া সরকার সম্প্রতি এ বিষয়ে কড়াকড়ি বাড়ানোয় আশ্রয়প্রার্থীরা পাপুয়া নিউ গিনি হয়ে অন্য কোনো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷

ইন্দোনেশিয়ায় হুসেইন আর সেনোয়ারার ঠাঁই হয় নোংরা এক বন্দিশিবিরে৷ সেখানে হঠাৎ একদিন রোহিঙ্গা শরণার্থী ও মিয়ানমারের বৌদ্ধ জেলেদের মধ্যে দাঙ্গা বেঁধে যায়৷ পিটিয়ে হত্যা করা হয় আট বৌদ্ধকে৷

দাঙ্গার পর আরো কয়েকজনের সঙ্গে হুসেইনকেও বন্দিশিবির থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়৷ মেয়েদের সঙ্গে আলাদাভাবে রাখা হয়েছিল বলে সেনোয়ারাকে আটকেই থাকতে হয়৷ দেশ ছাড়ার পর প্রথমবারের মতো বিচ্ছেদ ঘটে ভাই-বোনের৷ বয়স কম বলে কয়ক মাস জেল খেটেই মুক্ত পায় হুসেইন৷ এরপর সে পাড়ি জমায় পাশের দেশ মালয়েশিয়ায়, যেখানে কাগজে-কলেম ৩৩ হাজার এবং বাস্তবে তার প্রায় দ্বিগুণ রোহিঙ্গার বসবাস৷

সেখানে মাসে ৭০ ডলারে রাস্তার ঝাড়ুদারের কাজ পায় সে৷ আরো ১৭ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে তার জায়গা হয় এক বস্তিতে৷ জীবনে প্রথমবারের মতো রোজগার শুরু করলেও ছোট্ট বোনটার জন্য দুঃশ্চিন্তা তাকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে৷ দাঙ্গার পর শরণার্থী হিসাবে নিবন্ধনের আবেদন করে সেনোয়ারা৷ আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তত্ত্বাবধানে তাকে রাখায় হয় ইন্দোনেশিয়ার একটি আশ্রয় শিবিরে৷

এদিকে মিয়ানমারের গ্রামে হামলার রাতে নয় সন্তানের মধ্যে হুসেইন ও সেনোয়ারাকে হারিয়ে ফেলে আশেপাশের সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করেন মা আনোয়ার বেগম ও বাবা মোহাম্মদ ইদ্রিস৷ আট মাস পর রাখাইন রাজ্যে তাঁদের আশ্রয় কেন্দ্রে ফোন করে এক রোহিঙ্গা জানান যে, তাঁদের দুই ছেলে-মেয়ে ভালোই আছে৷

তিন দেশে ছড়িয়ে থাকা এই পরিবার এখন একসঙ্গে হতে পারে কবল প্রযুক্তির কল্যাণে৷ হুসেইন মালয়েশিয়ায় বসে ধারণ করা ভিডিওতে দেখতে পায় – তার ছোট্ট বোনটি ইন্দোনেশিয়ার আশ্রয়কেন্দ্র ফুটবল খেলছে৷ আর মিয়ানমারে বসে স্কাইপ-এর মাধ্যমে মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ মোছেন মা আনোয়ার বেগম৷আর সব মা-বাবার মতো একই প্রশ্ন তাঁরা বারবার জানতে চান – মেয়েটা ভালো আছে তো? স্কুলে সে কেমন করছে? ঠিকমতো খেতে পাচ্ছে?

স্কাইপে কথোপকথন শেষ হলেও অনেক্ষণ চোখ ফেরাতে পারে না সেনোয়ারা৷ আবারো কোনোদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে – এমন ভরসাও সে পায় না৷মোহাম্মদ ইদ্রিস তীব্রভাবে আশা করেন, ছেলে-মেয়েরা একদিন আবারো তাঁদের সঙ্গে মিলিত হবে৷ কিন্তু তিনি এটাও বোঝেন, মিয়ানমারে তাঁদের সঙ্গে থাকার চেয়ে দূরেই ভালো আছে হুসেইন আর সেনোয়ারা৷

জেকে/ডিজি (এপি, এএফপি)