1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দলবদলের রাজনীতিতে আদর্শের সমাধি!

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১২ মার্চ ২০২২

পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের রাজনীতিতে দলবদলের প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে৷ দল বদলানো নেতারা ভোটে জিতেও যাচ্ছেন৷ তাহলে কি রাজনীতিতে আদর্শ ও বিশ্বাসের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে?

https://p.dw.com/p/48OFz
Westbengalen Vorwürfe gegen der Regierung durch die Oppositionsparteien
ছবি: Payel Samanta/DW

ভারতের রাজনীতিতে আয়ারাম-গয়ারাম কথাটা বেশ চালু৷ তবে হরিয়ানার দলবদলুদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত এই প্রবাদ মিথে পরিণত হয়েছে৷ গো-বলয়ের রাজনৈতিক মহলে রাতারাতি দল বদলে ফেলা নতুন কিছু নয়৷ সেই ঝোঁক পশ্চিমবঙ্গেও দেখা যাচ্ছে৷

গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের একঝাঁক নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন৷ বিজেপি হেরে যাওয়ায় মুকুল রায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী দত্তের মতো নেতারা আবার ঘাসফুল শিবিরে ফিরে এসেছেন৷ আর এই ধারায় সর্বশেষ সংযোজন জয়প্রকাশ মজুমদার৷

কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন এই নেতা৷ মুখ্যমন্ত্রীর প্রবল সমালোচক জয়প্রকাশকে বিজেপি সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছিল৷ এরপর তিনি এ সপ্তাহে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে৷

বৃহস্পতিবার রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির জয়ের পর তিনি টিভি চ্যানেলে বসে তৃণমূলের পক্ষে সওয়াল করেছেন৷

এই জয়প্রকাশ মজুমদার নজর কেড়েছিলেন তিন বছর আগের একটি ঘটনায়৷ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে নদিয়ার একটি ভোটকেন্দ্রের কাছে তৃণমূলের এক কর্মী জয়প্রকাশকে সজোরে লাথি মেরেছিলেন৷

তার অভিঘাতে ঝোপের মধ্যে জয়প্রকাশের হামাগুড়ি দেওয়ার দৃশ্য ভাইরাল হয়৷ সেই নেতা তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় অনেকে তির্যক প্রশ্ন ছুড়ছেন, আদর্শ না হোক, দলবদলের ক্ষেত্রে এ ধরনের অপমানও কোনো বাধা নয়?

কীসের টানে অতীত মুছে রাজনৈতিক নেতারা অম্লান মুখে দল বদলে ফেলছেন?

‘মূল্যবোধের রাজনীতির ঝোঁক কমছে’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নীলাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে এক নতুন রাজনৈতিক প্রবণতা তৈরি হয়েছে দেশে৷ সেটা হচ্ছে সুযোগসন্ধানী রাজনীতি৷ এক্ষেত্রে মতাদর্শ থেকে যাচ্ছে পিছনে৷ নিজের স্বার্থই বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ রাজনীতি হয়ে উঠেছে  পেশা৷ সে কারণেই দল বদল করা জলভাত হয়ে গিয়েছে৷’’

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম (এডিআর) দেশের দলবদলুদের নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে৷ তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-২১ সালে সবচেয়ে বেশি নেতা কংগ্রেস ছেড়েছেন৷ ২২২ জন প্রার্থী অন্য দলে যোগ দিয়েছেন৷ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বহুজন সমাজ পার্টি৷ তাদের ১৫৩ জন প্রার্থী দলত্যাগ করেছেন৷ একই সময়কালে কংগ্রেস ছেড়েছেন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জনপ্রতিনিধি৷ ১৭৭ জন বিধায়ক-সাংসদ কংগ্রেস ত্যাগ করেছেন৷ বিজেপি ছেড়েছেন ৩৩ জন জনপ্রতিনিধি৷ 

কেউ যদি দল বদলাতে চান, সেক্ষেত্রে সংসদ বা বিধানসভার সদস্যপদ ছেড়ে দেওয়া উচিত৷ এমনটাই মত কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষের৷ প্রাক্তন বিধায়ক অরুণাভ দলের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বিধায়ক পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ আর সম্প্রতি বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর সংসদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন৷

কিন্তু ভোটের মুখে দলত্যাগ না করলে অধিকাংশ নেতা আইনসভার সদস্যপদ ছাড়ছেন না৷ বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী মুকুল রায় গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির টিকিটে জিতে পরে তৃণমূল কংগ্রেসের ফিরে যান৷ দলত্যাগ বিরোধী আইনে তাঁর বিরুদ্ধে স্পিকারের কাছে অভিযোগ জানায় বিজেপি৷ বিষয়টি গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য মুকুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ খারিজ হয়ে গিয়েছে৷ তবে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আমলে বিষয়টি অন্যরকম ছিল৷  ১৯৮৫ সালে সংবিধানের ৫২তম সংশোধনী অনুযায়ী দুই-তৃতীয়াংশের কম সদস্য দল পরিবর্তন করলে সেটা বেআইনি হবে৷ অভিযোগ আছে, আইন থাকলেও দলবদলের অভিযোগের নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লাগে অথবা রাজনৈতিক প্রভাবে সুবিচার হয় না৷

বিধায়ক পদ বাঁচাতে এখন অনেকে আবার কৌশল নিচ্ছেন৷ সম্প্রতি বিজেপি বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস প্রকাশ্যে তৃণমূলে যোগ দেন৷ যদিও পরে তিনি বলেছেন, বিজেপিতেই আছেন৷ তাই তিনি আসলে বিজেপি না তৃণমূলের সেই ধোঁয়াশা থাকছে৷

প্রশ্ন উঠছে, কোনো জনপ্রতিনিধি একটি দলের টিকিটে জেতার পর যখন অন্য দলে যাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে সাংসদ বা বিধায়ক পদ ছাড়ার নৈতিকতা কেন দেখাচ্ছেন না?

বর্ষীয়ান সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখনকার রাজনীতিকদের ‘পোস্ট আইডিওলজি পলিটিশিয়ান' বলা হয়৷ অর্থাৎ আদর্শ-উত্তর যুগের রাজনীতিক৷ এই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে আর পার্থক্য থাকছে না৷ দলের থেকে ব্যক্তি বড় হয়ে যাচ্ছে৷’’

রাজনৈতিক দলের নেতা দল পরিবর্তন করার পর আবার ভোটে দাঁড়িয়ে অন্য দলের টিকিটে নির্বাচিত হচ্ছেন, এই ঘটনা রাজ্যে রাজ্যে দেখা যাচ্ছে৷ ১৯৯৭ সালে উত্তরপ্রদেশে আস্থাভোটে জেতার জন্য বিজেপি কংগ্রেসের ২২ ও বহুজন সমাজ পার্টির ১২ জন বিধায়ককে দলে টেনেছিল৷ ২০১৭ সালে গোয়ায় বৃহত্তম দল হয়েও কংগ্রেস ক্ষমতা দখল করতে পারেনি, বিজেপি বিধায়কদের ভাঙিয়ে সরকার গড়ে৷

পাঁচ বছর পরে বিজেপি জনতার রায়ে গোয়ার বৃহত্তম দল৷ ২০১১ সালে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে৷ কয়েক মাস পর জোট ভেঙে গেলে কংগ্রেস সরকার থেকে বেরিয়ে যায়৷ পরবর্তীতে ১৭ জন কংগ্রেস ও ৬ বাম বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দেন৷  তৃণমূল শাসনের প্রথম পাঁচ বছরে স্থানীয় প্রশাসন অর্থাৎ পঞ্চায়েত ও পুরসভা দলবদলের ফলে তৃণমূলের হাতে আসে৷ বিরোধীদের অভিযোগ, ভয় দেখিয়ে ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বাম এবং কংগ্রেস জনপ্রতিনিধিদের নিজেদের শিবিরে টেনে আনে তৃণমূল৷ যদিও শাসকের দাবি, স্বেচ্ছায় জনপ্রতিনিধিরা ঘাসফুল শিবিরে যোগ দিয়েছেন৷ তবে দলের ভাঙাগড়া বাংলাতে এই প্রথম নয়৷ ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্টের আমলে প্রফুল্ল ঘোষের নেতৃত্বে ১৭ জন বিধায়ক পিডিএফ গঠন করেন৷ সেই পিডিএফ ভেঙে আবার তৈরি হয়েছিল আইএনডিএফ৷ মোটের উপর এ সব দলবদলের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার অংশীদার হওয়া৷

সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছেন লোকসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল সুভাষ কাশ্যপ৷ তিনি লিখেছেন, ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে দেশে দলবদলের ১৯৬৯টি ঘটনা ঘটেছিল৷ সাধারণ মানুষ দলত্যাগীদের অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাখ্যান করছে না৷ তাহলে কি সমাজের চোখে দলবদল আর কোনো গর্হিত কাজ নয়?

নীলাদ্রি বলেন, ‘‘রাজনীতি এখন একটা বাজারে পরিণত হয়েছে৷ অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মানুষের লেনদেনের সম্পর্ক৷ পশ্চিমবঙ্গসহ দেশের সর্বত্রই এটা দেখা যাচ্ছে৷ ভোট দেওয়ার সময় মানুষ দেখছে, সে কীভাবে এই দল বা ব্যক্তির থেকে লাভবান হয়েছে৷ সেই প্রার্থী দল বদলেছেন কি না বা কতটা আদর্শ মেনে চলেন, সেটা বিবেচনায় থাকছে না৷’’

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম (এডিআর)-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার সঞ্চালক উজ্জয়িনী হালিম বলেন, ‘‘মূল্যবোধের রাজনীতির ঝোঁক কমছে৷ জনমুখী প্রকল্পে গুরুত্ব দিচ্ছে অনেক সরকার৷ ধনী-দরিদ্রের বিভেদ ঘুচিয়ে অসাম্য দূর করার কথা বলা হচ্ছে না৷ বরং দিল্লির মহল্লা ক্লিনিক, বাংলার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্প বেশি আবেদন রাখছে৷ কিন্তু এতে কি সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে, এটাও ভেবে দেখা দরকার৷’’

বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক সংকটের তুলনায় নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার ভিত্তিতে ভোট দিতে বেশি পছন্দ করছেন ভোটাররা৷ এর সঙ্গে গণচেতনার যোগ আছে কি? ১৯৫২ সালে ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময় মাত্র ১২ শতাংশ মানুষ সাক্ষর ছিল৷ এখন সাক্ষরতার হার অনেক বেড়েছে৷ অরুণাভ বলেন, ‘‘সাক্ষরতার হার বাড়লেই শিক্ষিতের হার বাড়ে না৷ চেতনা তৈরি হয় না৷ আমাদের দেশে জনশিক্ষার যে হাল, তাতে মানুষ সব সময় নিজের সুদূরপ্রসারী ভালো-মন্দ বিচার করতে পারে না৷ তাই অপরাধীরা ভোটে জিতে যায়৷ সেটা শুধু গায়ের জোরে নয়, জয়ের পিছনে জনসমর্থনও থাকে৷’’

আর উজ্জয়িনী বলেন, ‘‘এভাবে জার্সি বদলের মতো দলবদল করলে মানুষের জনমতকে লঙ্ঘন করা হয়৷ দলবদলকে বন্ধ করার মতো যতো শক্তিশালী আইন থাকার কথা ছিল, সেটাও নেই৷’’

প্রতি নির্বাচনে জনমত একমুখী থাকে না৷ বিধানসভা নির্বাচন এক দল জিতলে, তার বিরোধীরা লোকসভায় সাফল্য পায়৷ জনসমষ্টির একটা বড় অংশ মত পরিবর্তন করে বলেই ফলাফল বদলে যায়৷ তাহলে রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে অবস্থান পরিবর্তনকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হবে কেন? শুভাশিসের বক্তব্য, ‘‘দলবদল মাত্রেই খারাপ, এ কথা বলা হচ্ছে না৷ কী উদ্দেশ্যে দলবদল, সেটা দেখতে হবে৷ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির প্রবল হাওয়া থাকায় দলে দলে নেতারা পদ্ম শিবিরে যোগ দিলেন৷ আবার তৃণমূল জেতায় ঘরে ফিরে আসছেন৷ এর সঙ্গে আদর্শের যোগ কোথায়, প্রশ্ন তো উঠবেই৷’’

‘রাজনীতি এখন একটা বাজারে পরিণত হয়েছে’

অরুণাভের বক্তব্য, ‘‘মানুষের ভোটাধিকারের তাৎপর্য এটাই যে তারা পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেবে৷ বিধানসভায় যাকে ভোট দেবে, লোকসভায় তাকে নাও দিতে পারে৷ এটাই গণতন্ত্রের সার্থকতা৷ কিন্তু কোনো নেতা তাঁর নিজের স্বার্থে ক্ষমতাসীন দলের দিকে ঝুঁকে পড়লে সেটা গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়৷’’

ক্ষমতা ও অর্থ যদি রাজনীতির মূলধারায় বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তা গণতন্ত্রের পক্ষে ইতিবাচক নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷

শুভাশিস বলেন, ‘‘আমাদের গণতন্ত্র দলনির্ভর৷ যদি এই ব্যবস্থা আদর্শশূন্য হয়ে পড়ে তা হলে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাবে৷  আর্থিক যোগ্যতা রাজনীতিতে সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে উঠবে৷ পুরো ব্যবস্থা বিত্তবানদের কুক্ষিগত হয়ে যাবে৷ এই গণতন্ত্র দেশের গরিব মানুষের পক্ষে আদৌ স্বার্থবাহী হবে না৷’’

পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, এই পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষয় হলে একনায়কতন্ত্র বা সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে৷

নীলাদ্রি বলেন, ‘‘আদর্শ একেবারে শেষ হয়ে যাবে না৷ আদর্শ ও প্রতি-আদর্শ থেকে নতুন আদর্শের জন্ম হয়৷ প্রচলিত ধারণা বাইরে আদর্শ তৈরি হবে৷’’ আর শুভাশিসের মতে, ‘‘যদি শাসক অন্যায় করে, যদি তার ব্যাপকতা খুব বেশি হয়, তা হলে জনতা সেই শাসককে উৎখাত করবে৷ এই নিশ্চয়তার দিন এখনো এ দেশে ফুরিয়ে যায়নি৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান